মিয়ানমারের আরেক পরিচিতি
মিয়ানমারের আরেক পরিচিতি - ছবি : সংগ্রহ
আবারো আটকে গেল দ্বিতীয় দফায় নেয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ। রোহিঙ্গাদের দেয়া শর্ত পূরণ না হওয়ায় এবারো তালিকাভুক্ত কোনো রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেনি। রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তাদের পাঁচটি শর্ত না মানলে তারা কিছুতেই মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। এই পাঁচ শর্ত হচ্ছে- ১. তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে; ২. নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; ৩. তাদের জমিজমা ফেরত দিতে হবে; ৪. নিজেদের গ্রামে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং ৫. অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
যেকোনো বিবেকবান মানুষ স্বীকার করবেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার এসব শর্ত শতভাগ যৌক্তিক। নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাদের রাষ্ট্রহীন করে রাখাই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। সে সমস্যার সমাধান না করে সে দেশে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর অর্থ আবারো তাদের অরক্ষিত অবস্থায় নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয়া। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোন ভরসায় তারা আবারো মিয়ানমারের ধর্মীয় উগ্রবাদী বৌদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর নির্যাতনের সহজ শিকার হতে যাবে, যেমন নির্যাতনের শিকার হয়ে এর আগে নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশে। দেশে ফিরে গেলে জমিজমা ফেরত পাওয়া তাদের ন্যায্য অধিকার। সে অধিকার নিশ্চিতের দাবি কখনোই অপূর্ণ থাকতে পারে না। তাদের নিজ গ্রামে অবাধে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং অবাধে মিয়ানমারের সব স্থানে চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করাসহ সব নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি অযৌক্তিক কিছু নয়।
এসব দাবি না মানার সহজ অর্থ হচ্ছে, কিছুটা আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে রাজি হলেও তাদের আগের মতোই রাষ্ট্রহীন করে রাখতে চায় মিয়ানমার। নাগরিক অধিকার থেকে আগের মতোই বঞ্চিত রেখে রোহিঙ্গাদের আগের মতোই দুর্বল করে রাখতে চায়। তা ছাড়া সব শরণার্থীকে ফেরত নেয়ার ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি মিয়ানমারের কাছ থেকে।
এ দিকে কিছু এনজিওকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হিসেবে দেখছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন। কূটনৈতিক প্রতিবেদকরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে প্রচারণা চালানো এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছেন, ‘মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনেক এনজিও প্রচারণা চালাচ্ছে। এসব এনজিওকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। রোহিঙ্গাদের জীবনে আরাম কমানো হবে, যাতে তারা ফিরতে রাজি হয়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে মনে হয়, তিনি রোহিঙ্গাদের দাবি অপূর্ণ রেখেই যেনতেনভাবে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চান। রোহিঙ্গাদের তোলা দাবিগুলো তার কাছে গুরুত্বহীন বলেই মনে হয়। ড. মোমেন বলেছেন, সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া ‘দুঃখজনক’। তবে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি, মিয়ানমারকেই এর সমাধান দিতে হবে। মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গাদের আস্থাহীনতা দূর করতে হবে।
এ দিকে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য গঠিত জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসন্ধান মিশন গত ৫ আগস্ট প্রকাশ করেছে ১১১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন। এই তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রধান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেনাপ্রধান বেসরকারি খাতে অর্থের জোগান দিয়েছে- এটি এখন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। এসব কোম্পানির সাথে কোনো ধরনের ব্যবসায়ে জড়ালে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। প্রতিবেদনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন সবচেয়ে বড় দু’টি প্রতিষ্ঠান- মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেড এবং মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশনসহ বেশ কিছু কোম্পানির অবৈধ কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়েছে। এসব কোম্পানি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংসতা পরিচালনায় অর্থায়ন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
অপর দিকে গত ২২ আগস্ট প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের এক তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্মূল করতে গণহত্যার অভিপ্রায় থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে এমন উপসংহার টানা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শত শত রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তথ্যপ্রমাণ বলছে, ৮০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনাই ইচ্ছা করে ঘটানো হয়েছে। গণধর্ষণের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, এর ৮২ শতাংশের দায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর।’
এমনই যখন অবস্থা তখন মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আস্থা রাখার জায়গাটি অবশেষ থাকে কি? পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন যথার্থই বলেছেন, মিয়ানমারের ওপর শরণার্থীদের আস্থার অভাব রয়েছে। সে কারণেই এরা দেশে যেতে চাচ্ছে না। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারকেই এর সমাধান দিতে হবে। বিবেকবান প্রত্যেক মানুষই স্বীকার করবেন, এমন আস্থাহীনতার পরিবেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেয়া পাঁচ শর্ত পুরোপুরি যৌক্তিক। আর এই দাবিগুলো যে যৌক্তিক, তা এর আগেই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে আনান কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে। সেখানেও জোর দিয়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান জরুরি।
আমরা জানি, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির অনুরোধের প্রেক্ষাপটে কফি আনান ফাউন্ডেশন ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের কার্যালয় রাখাইন স্টেট সম্পর্কিত একটি অ্যাডভাইজরি কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ছিল একটি ন্যাশনাল এনটিটি। এর বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন মিয়ানমার থেকে। এই কমিশনকে ম্যান্ডেট দেয়া হয় রাখাইন রাজ্যের জটিল চ্যালেঞ্জগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার এবং সেই সাথে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সম্ভাব্য উপায় উদ্ভাবনের।
কফি আনান কমিশনের ফাইনাল রিপোর্টে যে সুপারিশ করা হয়, তাতে মিয়ানমারের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার প্রতি জোর দেয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। সেই সাথে তাদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়। সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়াকে সেখানকার একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এর একটি সমাধানের সুপারিশ করা হয়। তখন রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল (আইআই) কফি আনান কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও এর সুপারিশমালাকে স্বাগত জানায়। আইআই তখন মিয়ানমার সরকারের প্রতি এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়।
আর জোর দেয়, রোহিঙ্গাদের পরিপূর্ণ মানবাধিকার নিশ্চিত করাসহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থার উন্নয়ন এবং রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার সঙ্কটের অবসান ঘটানোর প্রতি। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা ছাড়া এর সুষ্ঠু সমাধান নেই, আনান কমিশনের মূল সুর ছিল এটিই। কিন্তু মিয়ানমার সে বিষয়টি অমীমাংসিত রেখেইে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাইছে। আর মাঝে মধ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, বাংলাদেশের উপযুক্ত সহযোগিতার অভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে ফিরিয়ে নিতে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের নানা দুষ্ট কৌশলের কারণেই এই দুই বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরত পাঠানো যায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের মধ্যে বর্তমান সময়েই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে। আজকের এই সময়ে ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার চেয়েও শরণার্থীর সংখ্যা বেশি। পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্ররোচনায় কিংবা তাদের প্রক্সি হয়ে কাজ করা দেশগুলোর প্ররোচনায় সংঘটিত যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে এসব শরণার্থীর সৃষ্টি। তাই আন্তর্জাতিক সমাজের একটি নৈতিক দায় রয়েছে এই শরণার্থী সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে বাধ্য করা। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা তেমনি একটি সমস্যা। এখানে একটি পরাশক্তিও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নারাজ। যেমন- চীন খোলাখুলি বলে দিয়েছে, বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে দেশটি মিয়ানমারের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে না। সমস্যাটি এখানেই।
বেসামরিক দ্বন্দ্ব-কলহ এবং সেই সাথে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে পরিচালিত জাতিগত নির্যাতন, গণহত্যা ও দেশ থেকে বিতাড়নের ফলেও সৃষ্টি হয় বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর। বার্মা বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত তেমনি ধরনের এক শরণার্থী গোষ্ঠী। এ দেশটির কেন্দ্রীয় ধমনি হিসেবে বিবেচিত দেশটির মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিক বরাবর প্রবাহিত ইরাবতি নদী। দেশটির প্রধান জনগোষ্ঠী হচ্ছে বার্মিজ। জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশই বার্মিজ এবং এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রোহিঙ্গারা মুসলমান। এরা দেখতে বার্মিজদের চেয়ে একটু আলাদা। এরা কমপক্ষে ১২০০ বছর ধরে বার্মায় বসবাস করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গারা সমর্থন জানিয়েছে ব্রিটিশদের প্রতি, বৌদ্ধ বার্মিজরা ছিল জাপানের সমর্থক।
অনেকটা এ কারণে যে, জাপানিরা প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সেই থেকেই রোহিঙ্গা ও বার্মিজদের মধ্যে শত্রুতার সূত্রপাত। এর রেশ আজো অব্যাহত। বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাবিরোধী নানাবিধ অপবাদ ও কুৎসা রটনার পর ১৯৮২ সালে মিয়ানমার জাতীয় আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের করে রাষ্ট্রহীন এক জনগোষ্ঠী। মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ মনে করে ১৯৮২ সালের এই আইন দিয়ে কার্যকরভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদিও ইতিহাসে প্রমাণ মেলে বার্মায় রোহিঙ্গাদের বসবাসের সূচনা সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে। এদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়ার পর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় এদের অবাধ চলাফেরা। বন্ধ হয়ে যায় এদের রাষ্ট্রীয় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ।
সেই সাথে বন্ধ করে দেয়া হয় সরকারি চাকরিতে নিয়োগ। অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রোহিঙ্গাদের এই আইনি বঞ্চনাকে তুলনা করেছেন বর্ণবাদের সাথে। এদের মধ্যে রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সক্রিয়বাদী ও সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বিশপ ডেসমন্ড টিটো। জাতিসঙ্ঘ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বর্ণনা করেছেন ‘মোস্ট পারসিকিউটেড পিপল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে। তা ছাড়া, জাতিসঙ্ঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রোহিঙ্গা নির্যাতনকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসবেও বর্ণনা করেছে। জাতিসঙ্ঘ বলেছে, রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা হচ্ছে একটি ‘টেক্সট বুক এক্সামপল’।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন চালিয়েছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। এদের ওপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক হামলা হয়েছে বহুবার : ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬-১৭ এবং বিশেষত ২০১৭-১৮ সালে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধদের সর্বশেষ যে হামলাটি চালানো হয়, তখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা। ২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সামরিক নির্যাতনের আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ থেকে ১৩ লাখ। ২০১৫ সালের পরবর্তী সময়ে কমপক্ষে ৯ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে শুধু বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। আরো পাশের মুসলিম দেশগুলোতেও পালিয়ে গেছে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আরো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যও রোহিঙ্গাদের মতোই জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি হুমকির মুখে রয়েছে। সেই ১৯৬৩ সাল থেকে, উত্তরাঞ্চলের শান রাজ্যে মিয়ানমারের সঙ্ঘাত চলছে তাং লিবারেশন আর্মির সাথে। এই সশস্ত্র সঙ্ঘাতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে তিন লাখ মানুষ। রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত সেনাবাহিনীর অভিযানের আদলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান জোরদার করেছে কোকাঙ্গদের মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মির বিরুদ্ধেও। উত্তরাঞ্চলের কাচিন খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুরা তাদের গ্রামগুলো রক্ষার জন্য গঠন করেছে কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি। চলমান এই দ্বন্দ্বে অভ্যন্তীরণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে কমপক্ষে এক লাখ ৩৫ হাজার মানুষ। আর দক্ষিণাঞ্চলের দ্বন্দ্ব চলছে ক্যারেনদের (বৌদ্ধ, অ্যানিমিস্ট ও ১৫ শতাংশ খ্রিষ্টান) সাথে। এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে এক লাখ শরণার্থী।
আসলে মিয়ানমার সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি প্রদর্শন করে অমানবিক আচরণ। আর এই দেশটির নেতৃত্ব দেন অং সান সু চি। তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া একটা মকারি ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও তার রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থানের কারণে তিনি চরমভাবে সমালোচিত হয়েছেন বিভিন্ন মহল থেকে।