ভয়ঙ্কর বাস্তবতা : যেভাবে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ল মেয়েগুলো
হাজেরা বেগম। মাত্র আট বছর বয়সে পরিবার থেকে পালিয়ে এসেছেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝির ঘটনা। সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেতে ছোট্ট মেয়েটি ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেয় শহরে। - ছবি : সংগ্রহ
হাজেরা বেগম। মাত্র আট বছর বয়সে পরিবার থেকে পালিয়ে এসেছেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝির ঘটনা। সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেতে ছোট্ট মেয়েটি ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেয় শহরে।
এরপর রাস্তায় আবর্জনা থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে সেগুলো বিক্রি করে, এমনকি ভিক্ষা করে চলত তার জীবন।তবে প্রায়ই নানা হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে হাজেরাকে।
একসময় পুলিশ তাকে কাশীমপুর আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এক সমাজকর্মী তার বাসায় তাকে গৃহপরিচারিকার কাজের জন্য নিয়ে যায়।
তবে আবারো নির্যাতনের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে পালিয়ে পথশিশুর জীবন বেছে নেয়। একদিন শখের বসে মিরপুরে চিড়িয়াখানা দেখতে যায় হাজেরা। সেখানে গণধর্ষণের শিকার হয় সে।
দুর্ভাগ্যের শেষ হয় না হাজেরার। এরপর চাকরি দেয়ার কথা বলে এক লোকের প্রতারণার শিকার হয় সে। তাকে সদরঘাটের কুন্দপট্টি পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয় ওই লোকটি। এভাবেই পতিতায় পরিণত হয় অসহায় মেয়েটি।
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ঘোরাফেরা করা আরেক ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী রওশন আরা (২৭)। তার জীবনকাহিনীও হাজেরার মতোই। ছোটবেলায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে সমাজের নিম্নস্তরে সামাজিক মূল্যবোধের অধঃপতনের কারণে প্রায় ২০ লাখ মেয়ে বাধ্য হয়ে যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর ২০১৫ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ লাখ পথশিশু রয়েছে, যার এক-চতুর্থাংশ তরুণী।
এদের অধিকাংশই পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। কারণ ফুলবিক্রি, ভিক্ষা, আবর্জনা সংগ্রহ করে যথেষ্ট আয় করা যায় না।
তাদের বেশিরভাগই মৌলিক চাহিদা যেমন- নিরাপদ বাসস্থান, পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, স্যানিটেশন সুবিধা এবং বিনোদন থেকে বঞ্চিত।
২০১২ সালে উন্নয়ন অন্বেষণ এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ৭০ শতাংশ পথশিশু (কন্যা) যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এবং ১৯ শতাংশ ১১ বছর বয়স থেকেই পতিতাবৃত্তি শুরু করে।
যৌন কর্মী নেটওয়ার্ক ২০১৬-এর প্রতিবেদন মতে, দেশে ১০ লাখ ২০ হাজারের বেশি যৌনকর্মী রয়েছে, যাদের মধ্যে ২৯ হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক /কমবয়সী।
তাদের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কারওয়ান বাজার, চন্দ্রিমা উদ্যান, হাইকোর্ট মাজার, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, সদরঘাট ও কমলাপুর রেলস্টেশনে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়।
উন্নয়ন অন্বেষণ ও ইউনিসেফ উভয়ের ২০১২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তরুণী মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্য, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, প্রভৃতি।
যৌনকর্মীদের জন্য কাজ করা এনজিও ‘দুর্জয়’ এর সাবেক সভাপতি শাহনাজ বেগম বলেন, পরিবারের সদস্য দ্বারা নির্যাতিত বা প্রেমিক থেকে প্রতারিত মেয়েরা পতিতালয়ে বিক্রি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীদের ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়।
মেয়ে ও নারী বেচা-কেনা এবং তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা মানবপাচার আইন ২০১২ অনুসারে অপরাধ হিসেবে গণ্য হলেও এসব ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ খুব কম দেখা যায়।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতর কর্তৃক প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, এই আইন প্রণয়ন করার পরে সারা দেশের প্রায় ৩,৫০০টি মামলা দায়ের করা হয়।
পথের অসহায় মেয়েদের দিন বা রাত বা উভয় সময় আশ্রয়দানের জন্য দেশের বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র রয়েছে। তবে কম ধারণক্ষমতার কারণে অনেক মেয়ে সেগুলোর সুবিধা নিতে পারে না।
সারাদেশে পথশিশু ও জরুরি আশ্রয় দেয়া অন্তত ২০০ কেন্দ্র পরিচালনাকারী এনজিও অপরাজেয় বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু ইউএনবিকে জানান, যদি এসব মেয়েদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, তাহলে তাদের দুর্ভাগ্য এড়ানো যেতে পারে। তাদের এনজিও কয়েক বছর ধরে প্রকল্প-ভিত্তিক কাজ করছে, তবে ব্যক্তিগত প্রকল্পগুলো তাদের জীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেনি।
‘এর চেয়ে বরং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার দ্বারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং ফলো-আপ করে একটি মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা যেতে পারে’, বলেন তিনি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় রাস্তায় থাকা মেয়েদের জন্য কিছু কাজ করছে। এছাড়া নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সাল থেকে তাদের জন্য কিছু কর্মসূচি শুরু করেছে।
সূত্র : ইউএনবি