সাম্প্রতিক উর্দু কবিতা এবং কিছু প্রসিদ্ধ কবি
সাম্প্রতিক উর্দু কবিতা এবং কিছু প্রসিদ্ধ কবি - ছবি : সংগ্রহ
গোলাম নবী আজাদ
সাম্প্রতিক উর্দু কবিতার রাজ্যে, গোলাম নবী আজাদকে বোধ করি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধ কবি বললে ভুল হবে না। কিন্তু তার পরিচিতি অন্যভাবে থাকায় কবি হিসেবে তিনি মোটেও পরিচিতি পাননি অন্তত আমাদের এই দেশে। আমাদের দেশে তিনি পরিচিত ছিলেন ভারতবর্ষের সাবেক কংগ্রেস সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা এবং সাবেক (ভারত অংশ) কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। কেননা তিনি সাবেক কংগ্রেস সরকারের আমলে ভারতবর্ষের একজনর্ধ্বতন কংগ্রেস নেতা এবং সাবেক কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন! একটি কথা এখানে না বললেই নয়, তিনি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের সময়, বেশ আলোচিত হয়ে ওঠেন, কেননা তার মাতৃভাষা হচ্ছে উর্দু। এমনকি কাশ্মীরের প্রাদেশিক তথা অফিসিয়াল ভাষা উর্দু হওয়া সত্ত্বেও, তিনি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের সময় তার শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন ইংরেজিতে। তাকে শপথবাক্য পাঠ করান ভারতবর্ষের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি ড. প্রতীভা পাতিল। শুধু তাই নয়, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং পরিচালিত লোকসভার নির্বাচনে, তিনিই এক মাত্র কংগ্রেস নেতা, যিনি আগের যেকোনো নির্বাচনে, যেকোনো কংগ্রেস নেতার পাওয়া ভোটের, সব রেকর্ড ভেঙে ঊল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভোট পেয়ে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। তবু শুধু তিনি উর্দু ভাষায় তার শপথ বাক্যপাঠ না করার জন্য, সমগ্র ভারতীয় মুসলমান সমাজ, তথা সারা বিশ্বের উর্দু ভাষার সব কবি সাহিত্যিকের জগৎ থেকে তিনি উপেক্ষিত হয়েছিলেন। এই বিষয়টি ভারতের কোনো প্রদেশের মুসলমানেরাও মেনে নিতে পারেননি। তবু তিনি উর্দু সাহিত্যের একজন প্রবল শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় কবি, এতে কোনো ভুল নেই। শুধু তাই নয়, তার কবিতায় উঠে এসেছে সারা বিশ্বের মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং প্রভূত ইসলামিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কথা, যা উর্দু কাব্যসাহিত্যে এর আগে আর এত সুন্দর এবং সুচারুরূপে কখনো ফুটে ওঠেনি। তবু তার দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য ইংরেজিতে শপথবাক্য পাঠ করার জন্য, তাকে মুখোমুখি হতে হয় তৎকালীন আরেক উর্দু কবি বাহারুল উলুমের। যিনি ছিলেন উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের সংগঠন ইউডিও প্রধান নির্বাহী।
সাজিদ সাজনি : রিখ্ তি, কবিতা ধারার শেষ কবি
তালাক দে তু রাহি হো আতাব-ও-কাহার কি সাথ
মেরা সাহাব ভী লাউ তা দো মেরে মেহের কি সাথ
প্রথমেই এখানে উর্দু কাব্য সাহিত্যের এক দারুণ জনপ্রিয় এবং ধ্রুপদী ধারার লেখা রিখতা ধারার কবিতা সম্পর্কে না বললেই নয়! যে ধারার ইতিহাস এবং ধরন না জানলে বোঝা যাবে না যে, সাজিদ সাজনি কত বড় মাপের কবি ছিলেন। উর্দু কাব্য সাহিত্যে ‘রিখতা’ ধারার কবিতাগুলো ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের ধ্রুপদী গজল ঘরানার সঙ্গীত ধারার কাব্যসাহিত্য। অন্য দিকে, পুরুষের হাতে লিখিত নারী কণ্ঠের মাধ্যমে প্রকাশিত কবিতাগুলো হচ্ছে ‘রিখতি’। প্রাক অষ্টাদশ এবং উত্তর ঊনবিংশ শতাব্দীর সময়ে এই ধারায় কবিতা লেখা হতো, শুধু তৎকালীন চরম প্রতাপশালী সম্রাট ওউদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কথাগুলো প্রতিবাদের ভাষায় প্রকাশ করার জন্য। বলা যায়, আমাদের বাংলাসাহিত্যে অনেকটা কবি নজরুলের গজল ধারার মতো। তবে রিখতি কবিতাগুলো লেখা হতো একেবারে নারীর কণ্ঠে, যে কারণে সম্রাট অত বেশি করে কোনো ধরনেরই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেননি, গ্রহণ করতে পারেননি কোনো কঠিন পদক্ষেপ। অর্থাৎ ‘রিখতা’ হচ্ছে ‘রিখতি’র একেবারে ধারার বিপরীত কাব্যধারা। এখানে এ ঘরানার সার্থক, জনপ্রিয় এবং অত্যন্ত শক্তিশালী কবি সা’দাত ইয়ার খান রাঙ্গিন-এর নাম না বললেই নয়। অবশ্য এই সময়ে তাঁর বিপরীত ঘরানার বেশ শক্তিশালী কবি ছিলেন ইনশা, জুরাত এবং জান সাহিব। শুধু তাই নয়, এই সময়ে নারীর জবানীতে সব ধরনের কাব্য সৃষ্টির একটি প্রচলন ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা বেশ কিছু প্রচলিত জনপ্রিয় এবং মুখে মুখে প্রচারিত নারীদের নাম ব্যবহার করতেন এই ধারার কাব্য রচনার জন্য। যেমন : বেগুমাতী যু’বান, বা’জী, ভাবী, আম্মী, আ’পা, সাহিলী-এত-আল ইত্যাদি।
মোট কথা, এসব কাব্য রচনা পুরুষদের হাতে হলেও, প্রতিটি কবিতাই নারী কণ্ঠে নিঃসৃত। যেখানে থাকে এই পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর একান্ত গোপন কথাগুলো। একেবারে না বলতে পারা দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা তথা পুরুষের অত্যাচারের কথাগুলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব কাব্য রচনার পরও কিন্তু এগুলো প্রকাশও করা হয় না, ঘরে বাইরে তেমন ঘটা করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠ করেও শোনানো হয় না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পুনরায় এই ধারার কাব্য রচনার ইতিহাস যায় পাল্টে। এই ধারার কাব্য রচনা প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, কিন্তু কবি সাজিদ সাজনি পুনরায় নতুন করে, একটু নতুন আঙ্গিকে রচনা শুরু করেন। বলা যায় সেই নতুন আঙ্গিক হচ্ছে সাহিত্যের স্টাইল অব হিউমার, স্যাটায়ার এবং উইটি। এই বিষয়গুলো তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নতুন করে, এই ধারা কাব্যে ব্যবহার করার পরপরই তা পুনরায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। সাজিদ সাজনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২২ সালে বর্তমান ভারতের লক্ষেèৗর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পরে ১৯৪৬ সালে ভূপালে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
প্রখ্যাত উর্দু কবি মাযহার ঈমামের সাহিত্য ভুবন
কবি মাযহার ঈমামের একটি কবিতার দু’টি অত্যন্ত ছোট পঙ্ক্তি উল্লেখ করেই তার সম্পর্কে লেখা শুরু করলেই ভালো হয় বলে মনে করি। তবেই তার কাব্যপ্রতিভার শক্তিটা একটু অনুমান করা যাবে। তিনি লিখেছেন-‘রাসক কারতি হে-ঁই জিতনী ভা-আলে
হামনে ইস তারাহ ই মাত খা-ঈ হাই’
প্রখ্যাত কবি মাযহার ঈমাম এই উপমহাদেশে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ছিলেন উর্দু সাহিত্যে সবার সেরা। তিনি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের দারভাঙ্গা জেলায় ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন একজন পোস্টমাস্টার। সংসারের নানা টানাপড়েন থাকা সত্ত্বেও অনেক দুঃখকষ্টের মাঝে থেকেও তিনি উর্দু এবং ফারসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পরে জীবিকার তাগিদে তিনি চলে আসেন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। সেখান থেকে তিনি টিভি অ্যান্ড ফিল্ম মিডিয়ার ওপর উচ্চতর ডিপ্লোমা লাভ করেন। পরে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি উর্দু ভাষায় গীত রচনা করে উর্দু সাহিত্য তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের সঙ্গীতের বাণীতে আনেন এক অন্য ধরনের শালীনতা, সৌন্দর্য এবং প্রেমের বাণী।
১৯৫১ সালে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত শক্তিশালী দৈনিকি ‘দৈনিক কারাভান’-এ যোগদান করেন। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারলেন না। কেননা তিনি অত্যন্ত অস্থিরচিত্তের মানুষ ছিলেন। পরে একবারে হঠাৎ করেই বলা যায়, তিনি কারভান থেকে চলে গলেন। এ সময় বেশ কিছু দিন তিনি একেবারে বেকার ছিলেন। এরপর তিনি তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, পিতার কর্মক্ষেত্রে মাসিক মাত্র ৬০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেন। ধীরে ধীরে তিনি পুনরায় শিল্পসাহিত্যের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। অল্পকাল পরেই তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। বলা যায়, এখান থেকেই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরে প্রায় তিন দশক এখানে কাটান। বলা যায় এখানে থেকেই তিনি উর্দু সাহিত্যের ‘আযাদ গজল’ সঙ্গীত ধারার প্রতিষ্ঠাতা কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কিংবদন্তির উর্দু কবি জামিল মাযহারী
আল্লামা জমিল মাযহারী একটি নাম, উর্দু সাহিত্য অঙ্গনে যার নাম নেয়া হয় অত্যন্ত মর্যাদার সাথে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই কিংবদন্তি কবির রচনাগুলো কিন্তু প্রকাশিত হয় এই অল্প কিছু দিন আগে। এর মধ্যে ‘কুল্লিয়াত-ঈ-জামিল মাযহারী’ তার জীবনের প্রাচীন গ্রিক বা ভারত, ইরানের রচিত মহৎ মহাকাব্য সদৃশ বিশালাকৃতির এক মহৎ রচনা। প্রথম প্রকাশনায় রয়েছে ২০০-রও অধিক নাযমস। এডুকেশনাল পাবলিকেশন হাউজ এই বিশালাকৃতির মহৎ বইটি প্রকাশ করে।
তার প্রজন্মে একজন অগ্রণী কবি হিসেবে, আল্লামা জামিল মাযহারী সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু কখনো তিনি নিজের নাম বা পরিচিতির দিকে তাকাননি বা লালায়িত ছিলেন না। অবশ্য এর একটি কারণও ছিল। তিনি সমালোচকদের দিয়ে সব সময়ই অবহেলিত ছিলেন। তিনি তার এক রচনায় লিখেছেন-
‘হাম’ঈন দ্য আপনে লিয়ে আপ এক হিজাব
জামিল হাম উ’থ গায়ি তু জামানে নি হামকো পাহচানা।’
জাহাঙ্গীর রাজা কাযমী, হাসান সাকতী মাযারী, হুসেইন খুরশেদ মাযহারী, এবং আফযাল হাসান জাফরী, উর্দু সাহিত্যের এই তিন প্রখ্যাত কবি মিলে তাঁর এই বিশালাকৃতির বইটির রচনাগুলো সংগ্রহ করেন। পরে একত্র করে তা পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। তাঁর একটি বিখ্যাত রচনার কিছু অংশ এখানে তুলে দেয়া হলো। এই অংশটুকু পাঠ করলেই বোঝা যাবে যে, তিনি কত বড় মাপের কবি ছিলেন।
‘বাকাদার পেইমা আনা- ঈ- তাখাই উল সুর উর হার দিল ম্যাই’ঈন খুদি কা
গার না হো ঈ ফারেব-ঈ-পেইহাম তু দাম নিকাল যাইয়ে আদমী কা।’
একটি মজার ঘটনা এখানে না বললেই নয়, কেননা ভারতবর্ষের রাজনীতির জগতে পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু যেমন ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য নেতা, তেমনি জামিল মাযহারীও ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য একজন শক্তিমান কবি। তো এই কিংবদন্তির প্রবাদ পুরুষদ্বয়ের একবার সাক্ষাৎ ঘটে পণ্ডিতজীর লাক্ষেèৗর বাড়িতে। তাও আবার পণ্ডিতজীর ইচ্ছাতেই। বিহার থেকে লক্ষেèৗ, এক লম্বা পথ। এই লম্বা পথে ভ্রমণ করে কবি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি যখন পণ্ডিতজীর বাড়িতে পৌঁছানোর পর বসার ঘরের চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এই সময়ে তার সহযোগী হিসেবে দিনকার এবং সুহাইল আযিমাবাদী নামে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুই অনুসারী ছিলেন তার সাথে। পণ্ডিতজী ঘরে প্রবেশ করে এই দৃশ্য দেখে কিছুই মনে করেননি, বরং তাঁর যেন ঘুমের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, তার ব্যবস্থা করতে আদেশ দিয়ে গেলেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মহেশ ভাট উর্দু ভাষাভাষী লেখক, পাঠক; বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গীতিকারদের দিয়ে তিনি অত্যন্ত সমাদৃত। তিনি ধীরে ধীরে উর্দু ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়েন, গীত রচনা, চলচ্চিত্রের সংলাপ; এমনকি উর্দু ভাষাতে তিনি গজল এবং সায়েরও রচনা করতে শুরু করেন। বেশ খ্যাতিও অর্জন করেন। এর কারণ হচ্ছে, তাঁর মা শিরিন ছিলেন একজন গোঁড়া সিয়া মুসলিম পরিবারের মেয়ে। যিনি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন একদম একজন গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণের সাথে। যার মাতৃভাষা ছিল উর্দু, সেই সুবাদে মহেশ ভাট উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের সাথে হাত মেলান অত্যন্ত সহজে। উল্লেখ্য, মহেশ ভাটের পরিবারে কিন্তু গোঁড়া মুসলমান এবং হিন্দুর মিলন হলেও কোনো ধর্মীয় জটিলতা বা দ্বন্দ্ব-সংঘাত সেখানে ছিল না। এসব বিষয় নিয়ে মহেশ একটি সুন্দর প্রবন্ধ লেখেন। যেখানে তিনি পেশ করেছেন তার বলিউড চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের এক মর্মস্পর্শী কাহিনীর।
তিনি তার পিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, কিভাবে তিনি বলিউড চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেছেন। যখন তিনি অল ইন্ডিয়া বেতারের উর্দু অনুষ্ঠান শুনতেন, তখন উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে তার পিতার যে কি পরিমাণ ক্ষোভ ও ঘৃণা ছিল, তার একটি পূর্ণ বিবিরণ।
মহেশের পিতা, উর্দু ভাষার রেডিও অনুষ্ঠান শোনা মানে বলনে, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। এমনকি মাঝে মধ্যে তিনি রেডিও শোনা বন্ধও করে দিতেন। কিন্তু তার মা ছিলেন উর্দু অনুষ্ঠানের প্রথম শ্রেণীর শ্রোতা। তার মা উর্দু ভাষী ছিলেন বলে, মাঝে মধ্যেই তিনি নানা ধরনের মজলিসে যেতেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, মহেশ ভাট তার হিন্দু ধর্মের দেবদেবী এবং পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান এবং বেদ-গীতা-পুরাণ সম্পর্কে যা কিছু জেনে ছিলেন, সবই তার মায়ের কাছে থেকেই, অন্য কারোর কাছে যেতে হয়নি তাকে।
যখন তিনি বেড়ে উঠলেন, তখন তার আচার-আচরণ, বিশ্বাস, অনুসরণ সব কিছুতেই মুসলিম রীতিনীতির সবকিছু প্রকাশ পেত। মহেশ ভাট তার কর্মজীবনের এক সময়ে এসে বেশ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, ভারতবর্ষে উর্দু ভাষা চর্চার সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা বা উদ্যোগ নেই। এটি হওয়া উচিত।
শুধু তাই নয়, তিনি আরো লিখেছেন, ভারতের সংবিধান যখন রচনা করা হয়, তখনই এই বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখা উচিত ছিল। যদি সরকার তখনই প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি লেভেলে উর্দু ভাষা শেখা এবং সাহিত্যচর্চার প্রতি বাধ্যতামূলক করত, তাহলে এই ভাষাভাষীর সাহিত্যিকেরা প্রাণ ফিরে পেতেন। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হতো।
তিনি আরো বলেন, উর্দু ভাষাভাষী সব জনগণের উচিত, উর্দু ভাষাকে একটি উন্নত ভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। তিনি আরো বলেছেন যে, ‘এটি হচ্ছে ভারতে বসবাসরত সব উর্দু ভাষাভাষী জনগণের একটি জন্মগত অধিকার। উর্দু ভাষাভাষী সব শিশু-কিশোর তাদের মাতৃভাষা উর্দুতে লেখাপড়া করবে, হিন্দি, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় নয়। কেননা সেটা তাদের মাতৃভাষা।’
সম্প্রতি দু’জন প্রখ্যাত উর্দু কবি, যথাক্রমে রাফাত সারোস এবং ফিযা ঈবন ফাইজি ইন্তেকাল করেছেন। সারোস জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ৮ এপ্রিল নাগিনা শহরে। এটি উত্তরপ্রদেশের বিজনোর জেলার একটি প্রসিদ্ধ শহর। এখানে উর্দু ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও শ্রোতাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত। কেননা তিনি দীর্ঘ সময় ধরে এই রেডিও কেন্দ্রে, নানা বিভাগে কাজ করেছেন। কাব্য চর্চা করেছেন। রেডিওতে তিনি প্রায়শ কবিতা পাঠ করেছেন। ফলে তার কাব্য রচনার বেশির ভাগ সময়ই এখানে কেটে যায়।
সারোসের বয়স যখন প্রায় ৮৪ বছর, তখন তিনি তার নিজ জীবনী লিখতে শুরু করেন। পরে যা তার লেখা সমগ্রের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই বইটি বিখ্যাত হওয়ার কারণ হচ্ছে, ওই সময়ের উর্দু কাব্যচর্চার একটা প্রজন্মের ইতিহাসের দিক আমাদের কাছে উন্মোচন করে। তিনি ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। বলা যায় যার মৃত্যু সাথে সাথে উর্দু সাহিত্যের একটি থাম ধসে পড়ে যায়।
উর্দু কাব্য সাহিত্যের আরেকজন প্রসিদ্ধ কবি, ফিযা ঈবন ফাইজি। তিনি ইন্তেকাল করেন ২০০৯ সালে। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। একই তারিখ ৩০ নভেম্বরে। তিনি ছিলেন উত্তর প্রদেশের মোনাথ ভঞ্জন জেলার একেবারে স্থানীয় বাসিন্দা।
পরবর্তীকালে তিনি উর্দু কাব্যসাহিত্যের ‘ক্বাদির-উল-কালাম’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। অসংখ্য সম্মাননা আর পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত ফাইজির প্রায় ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
গত দশকে ইন্তেকাল করেছেন হাফিয বানারসি (১৯৩৩-২০০৮), আহমাদ ফারায (১৯৩৩-২০০৮) এবং সাগর নিযামী। তারাও অসাধারণ সব কাব্য রচনা করে আলোকিত করে গেছেন উর্দু কাব্যসাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডারকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ইতিহাসে এদের সম্পর্কে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।
উর্দু কাব্য জগতের কথা বলতে গেলে মোহসিন ভূপালী নামে আরেক প্রখ্যাত কবিকে স্মরণ না করলেই নয়। অপূর্ণ থেকে যাবে এই আলোচনা। তবে তার সম্পর্কে অত কিছু না বলে শুধু একটি কাব্যের উদাহরণ দিয়েই আলোচনার সমাপ্তি ঘটাব। তার একটি বিখ্যাত কাব্যের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
মুনহাসির আহল-ই-সিতাম পার হিঈ নাহি’ন হাই মোহসিন
লোগ আপনো’ন কি’ঈ ইনায়াৎ সি ভি মার জাতি হাঈ’ন
জুররাত-ই-ফু ঘা’ন ক্যাইসী, আপসী শিকাইয়াত ক্যায়া
শাঁস লি রাহি হেঁই হাম, আপকি নাভাজিস হাই
উনকি ভা’আডে তাকাল্লুাফান হি’ঈ সাহি’ঈহ
ফির ভি’ঈ হাম এতবার কারতে হেঈ’ন
- মোহসিন ভূপালী
এবার উর্দু কাব্যসাহিত্যের কিছু বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ এবং কবিদের কথা বলি-
যেমন- শাকিলুর রাহমানের প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘আহমাদ নাদিন কাশমী আউর গালিব’। আমবার বাহারাইচির “কালিদাশ কি বা’আদ সাংস্কৃত ইসকিয়া সা’ঈরি”। এ ছাড়া রাফাত সারোস এবং জাহির গাজীপুরির কাব্য সমগ্র এবং খুরশেদ তালিবের ২০টি কাব্যের সঙ্কলন সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া জাফর গোরাখপুরি, কৃষাণ কুমার তুর, আলকামা শিবলি, আবদুল আহাদ সায, হানীফ তারীন, জাফার শাহনী, তারিক মাতীন, খুরশেদ আকবারসহ রয়েছে আরো অনেক প্রসিদ্ধ কবি ও সায়েরি লেখক।
তারপর কিছু প্রথিতযশা কবিদের সায়েরের উদ্ধৃত করব-
ইহাঁ মাজবুত সি মাজবুত লোহা টুট জা তা হ্যায়
কাই ঝুটি ইকাটি থা হোঁ তু সাচ্চা তু টুট জা তা হ্যায়।
(হাসীব সোয)
তামাঘার কী ফিযা কো বাদালতা রাহতা হ্যায়
বো এক খিলাউনা জো আনগাঁও মে চালতা রাহতা হ্যায়।
(আযহার ইনায়েতী)
গুলজার, আবরুর-ই-জাবান আব হামী’ন সে হাই
দিল্লী মেই আপনে বা’আদ ই-এহ লুতফ-ই-সুখ’এঁঈ কাহাঁ
(আনান্দ মোহান যুতসী গুলযার দেহলবী)
না খাউফ-ই-বারক্ব, না খাউফ-ই-সারার লাগে হেই মুঝে
খুদ আপনে বাগ কে ফুলোঁ সে ডার লাগে হ্যায় মুঝে
(মালিকযাদা মনজুর আহমাদ)
তুম আশমান কি বুলান্দি জালদি আউ ত আনা
হামনে জামীনকে মাসাইল বাত কারনি হ্যায়
(সায়ে’র জামেলী)
দীল ম্যাই উতরেগি তু পুছেগি জুন্নুন কিতনা হ্যায় নুক-ই-খানজার হি
বাতাইয়েগি কি খুন কিতনায়ে হি।
(শাহরিয়ার)
পারসি ভাষার বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিত ভারতের ওয়ালী-উল-হক আনসারী এবং ওয়ারিশ কিরমানী। মূলত তারা হচ্ছেন ভারতীয় উর্দু সাহিত্যের একেকজন দিকপাল। তারা জন্মগতভাবে ভারতীয় এবং উর্দু সাহিত্যের পাশাপাশি পারসি ভাষা ও সাহিত্যকেও করেছেন উজ্জ্বল। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাদের অসাধারণ অবদানের জন্য তারা সম্মানিতও হয়েছেন তাদের সরকার কর্তৃক।
একটি কথা এখানে না বললেই নয়, আজকের ইরানের ইসলামিক আন্দোলনের সময়ে উর্দু কাব্যসাহিত্যের তিন বিশেষ কবি- কাশিনাথ পণ্ডিত, সৈয়দ ইউনুস জাফরী এবং সোয়েব আযমীর ছিল অসাধারণ অবদান। তারা ছিলেন অত্যন্ত বিদ্রোহী কবির দলের সদস্য। এই আন্দোলনের সময় তারা কাব্য রচনা করে, আন্দোলনকারীদের জুগিয়েছিলেন প্রেরণা আর সাহস। যার কারণে, ইরানের ইসলামিক আন্দোলনের ২৮তম বার্ষিকী পালনের সময় ইরানের সরকার কর্তৃক তারা সম্মানিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন বেশ।
আগেই বলেছি, ওয়ালী-উল-হক ছিলেন উর্দু ও পারসি কাব্যসাহিত্যের একজন ভারতীয় প্রথিতযশা কবি। সম্ভবত পারসি ভাষাতে তার সমান বড় মাপের পারসিয়ান কবি দ্বিতীয়টি আর নেই। পারসি ভাষায় রচিত তার তিন তিনটি বিখ্যাত কবিতার সব সমালোচকের দ্বারা অত্যন্ত সমাদৃত হয়। স্বীকৃতি পায় পারসি ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে।
ওয়ারিশ কিরমানী আরেকজন উর্দু সাহিত্যের দিকপাল লেখক। তার সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ঘুমতী নাদী’তে তার প্রমাণ মেলে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে, তিনি বর্তমানে বাস করছেন তার আদি নিবাসে।
কিরমানী, যিনি ‘কুররাতুল আইন হায়দার’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যার কারণে তিনি প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কাব্যের সাথে তিনি রচনা করেন বিশ্বসাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। দেখিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের পাশে দাঁড় করালে উর্দু সাহিত্যের স্থান কোথায়। তার সেসব রচনা পাঠ করে পণ্ডিত ও বি˜গ্ধ জনেরা বলেছেন, কিরমানীর এই আলোচনা-সমালোচনা যথার্থই সঠিক।
ফি-বছর ভারতে হয় উর্দু কবিতা পাঠের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যাকে মুসায়রা বলে অভিহিত করা হয়। অত্যন্ত মর্যাদা আর মূল্যবান এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন সারা বিশ্বের প্রথিতযশা উর্দু কবি সাহিত্যিকেরা। লাল-কিলা-মুসারিয়া, এমনই এক অনুষ্ঠানের নাম।
ড. নারিশ, মাখমুর সাঈদী এবং ওয়াসিম বেয়ারলভী- এই তিন প্রখ্যাত উর্দু কবি অংশ নিয়েছিলেন গত বছরের মুসারিয়াতে। লাল-কিলা-মুসারিয়া সব সময় উর্দু কবিতা পরিবেশনের জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বলে বিবেচিত হয়। এখানেই উর্দু কাব্যের মান নির্ধারিত হয়। ইদানীং গুলজার দেহলবীর রচনা মনে হয় যেন কোনো এক মহাগ্রন্থের স্তবক।
তাই বলা যায়, এখনও কিছু কবি আছেন যাদের দিয়ে উর্দু কাব্য সমৃদ্ধ হচ্ছে হরহামেশাই। এমন কিছু প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাধর কবি আসছেন যাদের হাতে উর্দু কাব্য-সাহিত্য সমৃদ্ধি লাভ করবে বহু গুণ। বিশ্বসাহিত্যের দরবার থেকে হয়তোবা কোনো মহামূল্যবান পুরস্কার ছিনিয়েও আনতে পারেন, সে আর বেশি দূরের কথা নয়।