ধর্মের হাত ধরে শিল্পের পথচলা!
উদয়গিরি গুহার একটি অংশ - ছবি : নয়া দিগন্ত
সম্প্রতি ভারতের কিছু শিল্পমণ্ডিত স্থাপনা পরিদর্শন করে এটা পরিষ্কার হলো যে, শিল্প যথার্থই যোগাযোগের মাধ্যম। আর এই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হয় শিল্প আশ্রয় করেছে ধর্মকে অথবা ধর্ম তার যোগাযোগ সুবিধা নিতে শিল্পকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। দুটোই যদি সত্য হয় তবে ক্ষতি কী?
ভারত এমন একটা দেশ, পুরোটা ভ্রমণ না করলে যার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা মেলা অসম্ভব। আমি তো বলি, সত্যিকারের ভারত ভ্রমণ হলে পৃথিবীর অর্ধেকটা ঘুরে ফেলা হয়ে যায়। ভ্রমণ বলতে তো বোঝায়, সংশ্লিষ্ট স্থানের মানুষ- তাদের বিশ্বাস, বর্ণ-গোত্র, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া। অন্য দিকে তার প্রকৃতি-পরিবেশ, ইতিহাস-ভূগোল, স্থাপত্য-প্রতœতত্ত্ব, প্রাচীনতা-আধুনিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো হবে প্রধান আকর্ষণ। দুনিয়ার সব বৈচিত্র্য যেন ধারণ করেছে একা ভারত। এক দিকে গভীর অরণ্য, আরেক দিকে তপ্ত মরুভূমি, এক দিকে সমুদ্র আরেক দিকে সুউচ্চ পর্বতমালা, এক দিকে প্রাচীন জীবনধারায় স্থিত জনগোষ্ঠী অন্য দিকে অতি আধুনিক জীবনযাত্রা, এক দিকে সুপ্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমাহার আরেক দিকে অত্যাধুনিক স্থাপত্য। অজস্র ভাষা ও লিপির বৈচিত্র্যও এর অন্যতম আকর্ষণ। সহস্র বছরের প্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ যে ভূ-খণ্ড তার অর্ধ সহস্র অংশই রচনা করেছে একটি জাতি। মুসলমানদের হাতে রচিত সেই বিপুল-বৈচিত্র্য পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণও বটে।
গত এপ্রিলজুড়ে ভারতবর্ষের বিখ্যাত কয়েকটি শিল্পমণ্ডিত স্থাপনা তথা প্রত্ননিদর্শন পরিদশর্নের সুযোগ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি, পুরীর কোনার্ক সূর্য মন্দির, জগন্নাথ মন্দির কমপ্লেক্স, পুরীর সমুদ্রসৈকত প্রভৃতি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে হলে মালদা জেলা শহরের বক্ষ ভেদ করতে হয়। সেখানকার কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করার পর মনে হলো সিকিম ছুঁয়ে গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো, এসময় সিকিম ভ্রমণ যুৎসই হবে কি না। আর এই মনে হতে হতেই অঝোরে বৃষ্টি, সাথে ঝড়ো হাওয়া এবং বজ্রনির্ঘোষ। কী আর করা, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। কলকাতা বাদ দিলে থাকে বিহারের পানে যাত্রা। গাইড হিসেবে ভালো পারফরমেন্স করছে সঙ্গী গীতিকার, সুরকার ও গল্পকার গালিব সর্দার। ওর মা সাথে আছেন বলেই হয়তো দায়িত্বটা বেশি অনুভব করছে। না হলে সে অতটা সিরিয়াস নয় কখনোই। মালদা স্টেশনে টিকিট মাস্টারকে বিহারের রাজধানী পাটনার টিকিটের কথা বলতে জানাল, দূরপাল্লার টিকিট এমন হুটহাট মেলে না। কম্পিউটার খোঁচাখুঁচি করেও কোনো সুরাহা করা গেল না। মরিয়া হয়ে গালিব জানাল, বেড়াতে এসেছি। যেখানকারই হোক টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। মাস্টার মশাই মুচকি হেসে বললেন, দেখি তাহলে। শেষে মালদা টু ভুবনেশ্বর এবং ফিরতি পথের পুরি টু কলকাতা টিকিটের সন্ধান মিলল। ‘তা-ই দেন’- নাছোড়বান্দার উত্তর।
বলতে সহজ, মালদা টু ভুবনেশ্বর। কিন্তু ট্রেন সেই আসামের ডিব্রুগড় থেকে কোন সুদূরের বেঙ্গালুরু পৌঁছাবে। আমরা হব কেবল মধ্যপথের যাত্রী। ট্রেনের নাম ‘আগরতলা-বেঙ্গালুরু ক্যান্টনমেন্ট হামসফর এক্সপ্রেস’। এটি ভারতের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অন্যতম ট্রেন। মোট দূরত্ব ৩,৫৭০ কিলোমিটার। মধ্যপথে মালদা টাউন স্টেশনে ঘণ্টাখানেকের বেশি লেটে রাত ৮টার দিকে ট্রেন পৌঁছালে আমরা তার যাত্রী হলাম। ভুবনেশ^র পৌঁছানোর কথা ৭৬৪ কিলোমিটার পথ ১২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে অতিক্রম করে পরদিন সকাল প্রায় ১০টার দিকে। ভুবনেশ^র স্টেশনের সুপরিসর প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুমে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর দেখি গালিব সর্দার তার পূর্ব পরিচিত ট্যাক্সি চালক বিজয়কে হাজির করে ফেলেছে। ওয়েটিং রুমের বাইরে তীব্র রোদের তাপে তিষ্ঠানো দায়। দ্রুত এসি কারের ভেতরে সেঁধিয়ে পড়া। গন্তব্য উড়িষ্যার বিখ্যাত উদয়গিরি-খণ্ডগিরির অত্যাশ্চর্য প্রত্ননিদর্শন দেখা।
ভারতের পূর্ব-উপকূলে, অন্ধ্র অঞ্চলের দক্ষিণাংশে ভারতের একটি রাজ্য উড়িষ্যার অবস্থান। সংস্কৃত শব্দ ওড়া বিশ্বা বা ওড়া দেশা থেকে উড়িষ্যা নামের উৎপত্তি। পালি ও সংস্কৃত উভয় সাহিত্যে ওড়ার জনগোষ্ঠীকে ‘ওড়াকা’ এবং ‘ওড়াহ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম ইতিহাসগ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরী, তবকাত-ই-আকবরী, রিয়াজ-উস-সালাতীন, তারিক-ই-ফিরুজশাহী প্রভৃতিতে ওড়া ভূখণ্ডকে ‘জাজনগর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সামস-ই-সিরাজ আফিফ তার গ্রন্থে প্রথম উড়িষ্যাকে ‘জাজনগর-উড়িষ্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উড়িষ্যার ইতিহাসে কলিঙ্গ ও উৎকল আদি জনগোষ্ঠী সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন কলিঙ্গ রাজ্য সম্পর্কে বৈদিক ঘটনাপঞ্জিতে প্রাচীন তথ্যসূত্রগুলো পাওয়া যায়। কলিঙ্গরা হিংস্র ও স্বাধীন জনগোষ্ঠী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
প্রাচীন ভারতে উড়িষ্যা ছিল মগধ রাজ্যের নন্দ রাজাদের অধীনস্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ১৫৬৮ সালে উড়িষ্যার শেষ হিন্দু রাজা মুকুন্দদেবকে বাংলার আফগান সুলতান সুলায়মান কররানীর (১৫৬৪-৭২) সেনাপতি কালাপাহাড় যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করে উড়িষ্যা জয় করেন। মুকুন্দদেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তৎকালীন ভারতের শেষ হিন্দু রাজ্যের অবসান হয় এবং উড়িষ্যা তার স্বাধীনতা হারায়। ১৫৭২ সালে সম্রাট আকবর কর্তৃক উড়িষ্যা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে বাংলা সুবাহর অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চলে পরিণত হয়। ১৬০৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে (১৬০৫-১৬২৭) উড়িষ্যা পৃথক একটি সুবাহর মর্যাদা পায়। উড়িষ্যার প্রথম মুঘল সুবাদার হাসিম খান (১৬০৭-১৬১১ সাল) এবং শেষ সুবাদার আলিবর্দী খান। ১৭৪১ সালে নাগপুরের রাজা ভোঁসলে উড়িষ্যায় ধ্বংসযজ্ঞ চালান। বাংলার নবাব আলিবর্দী খান মারাঠাদের কাছে উড়িষ্যা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং মারাঠারা ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত উড়িষ্যা শাসন করে।
উড়িষ্যার বর্তমান রাজধানী ভুবনেশ্বর অসংখ্য মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। উড়িষ্যার পূর্ববর্তী রাজধানী ছিল ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে কটকে। বঙ্গোপসাগরের তীরে এবং ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক পুরি শহরের অবস্থান। জগন্নাথ দেবতার বাসস্থান হিসেবে বিবেচিত পুরি হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র শহর। সম্বলপুরের কাছে হীরাকুদ বাঁধ উড়িষ্যার দীর্ঘতম বাঁধ হিসেবে পরিচিত। রয়েছে একাধিক পর্যটন শহর। পুরি, কোনার্ক ও ভুবনেশ্বর- এই শহর তিনটি পূর্ব-ভারতীয় ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ নামে পরিচিত। পুরির জগন্নাথ মন্দির, কোনার্কের সূর্য মন্দির, ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, খণ্ডগিরি, উদয়গিরি, ধউলিগিরি গুম্ফা প্রভৃতি আকর্ষণীয় নিদর্শন।
বিস্ময়কর উদয়গিরি-খণ্ডগিরি গুম্ফা
১৪ এপ্রিল ২০১৯ রোববার মধ্যাহ্নের কাঠফাটা রোদ। গাড়ির ভেতরে টের পাচ্ছি না বাইরের তাপদাহ। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে কার থেকে নামতেই ঝাপটা দিয়ে যেন শরীর পুড়িয়ে দিতে চায়। ভুবনেশ্বর শহর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে পূর্বঘাট পর্বতমালায় অবস্থিত উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি গুম্ফা। জানা গেল, খ্রিষ্টপূর্ব ২ শতকে গ্রানাইট পাহাড় কুঁদে তৈরি হয় এই গুহাগুলো। উদয়গিরির অর্থ উদীয়মান সূর্য। গ্রানাইট পাথরের উদয়গিরির উচ্চতা ১১৩ ফুট। পাহাড় দু’টিতে যথাক্রমে ১৮টি ও ১৫টি গুহা অর্থাৎ ৩৩টি গুহা আছে- যেগুলো কিছুটা প্রাকৃতিক এবং কিছুটা কৃত্রিমভাবে তৈরি। উদয়গিরিকে বৌদ্ধদের গুহাও বলা হয়। আবার খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রাজা খারবেলের রাজত্বকালে জৈন সন্ন্যাসীদের সাধনা, ধর্মতত্ত্ব আলোচনা এবং বসবাসের জন্য নির্মিত এই গুহাগুলো প্রত্মতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও শিল্প নিদর্শন বলে মনে করা হয়। পরবর্তীকালে এই গিরিগুহাগুলো ঘন জঙ্গলে ঢাকা পড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। ব্রিটিশ প্রতœতত্ত্ববিদ আন্ড্রু স্টারলিং খণ্ডগিরি ও উদয়গিরির হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধার করেন। এখনো উপরের বৃহদংশজুড়ে ঘন জঙ্গল রয়েছে। বানরের অবাধ বিচরণ দেখা গেল। অন্য বন্যপ্রাণীও রয়েছে। উদয়গিরি গুম্ফার পাশেই রয়েছে খণ্ডগিরি গুম্ফা। এর শীর্ষদেশে একটি মন্দির। উদয়গিরির চূড়া থেকে এটি বেশ দেখা যায়। এক উদয়গিরিতেই শরীরের তাকত ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাতে রোদের বিস্ফোরণ চলছেই। ফলে আলাদা করে খণ্ডগিরির অন্তর্দর্শন ঘটল না।
মনে পড়ল আদ-সামুদের পাহাড় কেটে গৃহ তৈরির কথা। সামুদ জাতির লোকেরা পাহাড় কেটে যেসব বিপুলায়তন ইমারত নির্মাণ করেছিল, এখনো হাজার হাজার একর এলাকাজুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে। আজকের সৌদি আরবের অন্তর্গত মদিনা ও তাবুকের মাঝখানে হিজাজ রেলওয়ের একটি স্টেশন রয়েছে, মাদায়েনে সালেহ। এটিই ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান। পবিত্র কুরআনের সুরা আরাফে এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এই জাতিকে তাদের অপকর্মের জন্য ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। উদয়গিরির এই স্থাপনা একই সভ্যতারকালে গড়ে উঠেছিল কি না, সে বিষয়ে তলিয়ে দেখার সুযোগ অবশ্য হয়নি।
উদয়গিরি-খণ্ডগিরির পাট চুকিয়ে দ্বিপ্রহরের আহার গ্রহণের তাড়া মিলল উদরের হালকা মোচড়ে। একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পাট চুকিয়ে তারপর যাত্রা শুরু বিখ্যাত পুরির উদ্দেশে।
কোনার্ক মন্দির
রাজধানী ভুবনেশ্বর সিটি থেকে পুরির দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। আবার পুরি থেকে কোনার্ক মন্দিরের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ মাঝপথে কোনার্ক দর্শন। টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয় এর বিশাল কমপ্লেক্সে। পুরি জেলায় অবস্থিত কোনার্কের এই সূর্য মন্দির। ১২৩৮-১২৬৪ সালে পূর্ব-গঙ্গা শাসনামলে অধিপতি মহারাজ নরসিংহ দেব এটি স্থাপন করেন। স্থানীয়ভাবে ‘সুরইয়া টেম্পল’ নামে পরিচিত এই মন্দিরের মূল কমপ্লেক্স একটি বিশালাকৃতির রথের মতো দেখতে, যা প্রসারিত কিছু পাথরের চাকা ও পিলারের ওপর ভর করে আছে। এই মন্দির তার অভিনব আকার, বিশালত্ব আর কারুকার্যের জন্য প্রসিদ্ধ। অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য মন্দিরটিকে ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়, ইউরোপীয় বণিকরা এই মন্দিরটিকে একসময় ‘কালো প্যাগোডা’ নাম দেয়। কারণ, জগন্নাথ মন্দিরকে তখন সাদা প্যাগোডা বলা হতো। তামিল শব্দ ‘কোণ’ আর সংস্কৃত শব্দ ‘অর্ক’ মিলে কোনার্ক শব্দটির সৃষ্টি। ‘কোণ’ মানে ‘অহমষব’ আর ‘অর্ক’ মানে সূর্য। সূর্যের বিভিন্ন কোণ বা অবস্থান সময়ের বিন্যাস ফুটে উঠেছে এই মন্দিরে। উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত মন্দিরটি ধূসর বেলে পাথরে বিশাল একটি রথের আকারে গড়া। সমুদ্র থেকে উঠে আসা সূর্যদেবের বিশাল রথ, তার সামনে রয়েছে সাত জোড়া ঘোড়া। বারো জোড়া বিশাল চাকার ওপর পুরো মন্দিরটি নির্মিত। প্রতিটি চাকা একেকটি সূর্যঘড়ি। চাকার ভেতরের দাঁড়গুলো সূর্যঘড়ির সময়ের কাঁটা। কলিঙ্গ স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী কোনার্ক মন্দিরের চারটি অংশ- ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন ও দেউল। এর শরীরজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন মুদ্রার নর-নারীর অবয়বসম্বলিত টেরাকেটা শিল্প। একটা বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করল। গাইড বিভিন্ন বয়সী মানুষের একটি গ্রুপকে মন্দিরগাত্রে চিত্রিত শিল্প-পাঠ দিচ্ছেন। এর মধ্যে বয়সীরা মুখ চেপে হাসছেন আর তরুণ-তরুণীরা কিছুটা উচ্ছ্বসিত। গাইডের কাঁধের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি তিনি মিথুন শিল্পের গল্প শোনাচ্ছেন।
১৫০৮ সালে বাংলার সুলতান সুলেমান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দিরে অভিযান চালিয়ে এর বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করেন। বলা হয়ে থাকে, সেসময় এ ধরনের মন্দিরে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি তাদের বিপুল ধনরাজি লুকিয়ে রাখতেন। ফলে অভিযানকারীদেরও লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে এসব মন্দির। বেশ সময় নিয়ে উপভোগ করা হলো এর কারুকার্য ও বিশালত্ব। ছবি তোলার বাতিক তো অনেক পুরনো। কোনার্ক ছেড়ে পুরি শহর যাত্রার মাঝপথে সড়কের দু’পাশে ঘন বন। অভয়ারণ্য। ইতিউতি হরিণের দেখা মেলে। সড়কের আরেক পাশে কাজুবাদামের বাগান। এই গাছের বৈশিষ্ট্য হলো, একেবারে গোড়া থেকেই এর ডালপালা বিস্তার লাভ করে। কিন্তু উচ্চতায় খুব দীর্ঘ হয় না। কানের দুলের মতো ফল হয়। এই ফলের ভেতর থেকে বাদাম বের করে নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন হয়। কাঁচা ফল নাকি বিষযুক্ত। তবে প্রক্রিয়ার পর তা হয় উচ্চ পুষ্টিযুক্ত। পুরির দীর্ঘ সমুদ্রপাড়ের অদূরবর্তী বালিয়াড়িতে এর আবাদ হয়। এজন্য খুব পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। যত খাটুনি ফল আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণে।
পুরির জেলা ও পৌর শহরে পৌঁছে সমুদ্র উপকূলবর্তী নবনির্মিত একটি হোটেলে রুম নেয়া হলো। ম্যানেজার জানালেন, তার আত্মীয়-পরিজন বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার কেশরহাটে থাকে। তিনি নিজেও সেখানে বাল্যকাল কাটিয়েছেন। এই পরিচয় কাজে দিলো, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবস্থায় বেশ রেয়াত এবং বোনাস হিসেবে বাড়তি যতœ মিলল।
পুরির জগন্নাথের মন্দির
উড়িষ্যার সমুদ্র শহর ও হিন্দুদের পবিত্র ধাম বলে পরিচিত পুরি। সকাল সকাল অটোরিকশাযোগে পুরির জগন্নাথের মন্দির দেখতে বের হলাম। পথের মাঝে পথজুড়ে নির্বিঘœ বিশ্রামে রত শত শত এড়ে গরু বা ষাঁড়। পথযাত্রী মানুষকেই পথ করে নিতে হয় ওদের এড়িয়ে। মন্দিরের সামনে শত শত মন্দিরমুখী মানুষের ভিড়। সড়কের দু’পাশজুড়ে বাজার-পসরার সারি। উল্লেখযোগ্য পণ্য মন্দিরের পূজার সামগ্রী। মন্দিরের প্রসাদ নিয়ে কাড়াকাড়ি করতেও দেখা গেল কিছু মানুষকে।
জগন্নাথ মন্দির খুবই প্রাচীন একটি হিন্দু মন্দির। একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দিরে সাতটি গোপন কক্ষ আছে। সেই কক্ষগুলোই হলো রত্নভাণ্ডার। এখন থেকে ৩৪ বছর আগে মাত্র তিনটি ঘরের তালা খুলতে সক্ষম হন কর্মকর্তারা। বাকি ঘরগুলোতে কী আছে, তা আজও রহস্যই রয়ে গেছে। যে কক্ষগুলো খোলা হয় সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ১৮০ রকমের মণিমুক্তা খচিত স্বর্ণ অলঙ্কার। যার মধ্যে আছে মুক্তা, প্রবালের মতো অত্যন্ত দামি পাথর, ১৪৬ রকমের রৌপ্য অলঙ্কার।
সাম্প্রতিক সময়ে জগন্নাথ মন্দিরের চাবি হারানোর ঘটনায় পুরির শঙ্করাচার্য এবং রাজ্যের বিপক্ষীয় দল বিজেপির মধ্যে বিরোধ দেখা গেছে। এর ম্যানেজমেন্ট কমিটির একজন সদস্য জানান, রতœগর্ভ ভাণ্ডারের অভ্যন্তরীণ চেম্বারের চাবি হারিয়ে গেছে। বিষয়টি উড়িষ্যা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। মন্দিরের বেসরকারি ব্যবস্থাপনা কমিটি খুবই শক্তিশালী। এর ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা ও নিয়মবিধি নিজেরাই নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ গ্রাহ্য হয় না। মন্দিরের ভেতরে মুসলিম দূরে থাক, অন্য ধর্মীয়দের প্রবেশও কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ।
জগন্নাথ মন্দির ১০৭৮ সালে তৈরি। ১১৭৪ সালে মেরামতের পর তা আজকের জগন্নাথ মন্দিরের রূপ ধারণ করে। মন্দিরের চূড়ায় যে সুদর্শন চক্রটি দেখা যায় সেটি উচ্চতায় ২০ ফুট এবং ওজন ১ টন। বলা হয়, শহরের যে কোনো জায়গা থেকেই এই চক্র দেখা যায়। সাধারণত মন্দিরে বিগ্রহ পাথর কিংবা ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়। কিন্তু পুরির মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা তিনজনের বিগ্রহই কাঠের তৈরি। প্রত্যেক ১২ বছর পর একটি গোপন রীতি মেনে এদের নতুন শরীর দেয়া হয়। উড়িষ্যার ইতিহাস বলে, ১৫০৮ সালে বাংলার সুলতান সুলেমান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দিরে অভিযান চালিয়ে এর অভ্যন্তরভাগ ধ্বংস এবং বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করেন। কালাপাহাড়ের পূর্ব নাম রাজীব লোচন ওরফে রাজু। পিতা ব্রাহ্মণ ও ভট্টাচার্য। জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার বীরজোয়ান গ্রাম। যুদ্ধে বিপুল বীরত্ব ও ক্ষিপ্রতা প্রদর্শনের জন্য ‘কালাপাহাড়’ নামে খ্যাত হন।
জগন্নাথ মন্দির লুণ্ঠন সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। কালাপাহাড় ব্যক্তিগত যোগ্যতায় সুলতান সুলাইমানের শাসনামলে গৌড়ের ফৌজদারের পদ লাভ করেন। এভাবে তিনি সুলাইমানের কাছাকাছি আসার সুযোগ পান এবং তার কন্যার প্রেমে পড়েন। তিনি সুলাইমানের কন্যার পাণিপ্রার্থী হলে সুলাইমান তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার শর্ত দেন। কারো কারো মতে, রাজীব লোচনের যুদ্ধ দক্ষতা দেখে সুলাইমান নিজেই তার কাছে নিজের কন্যার বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। উচ্চাভিলাষী রাজীব লোচন (রাজু) প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে সুলাইমানের কন্যাকে বিয়ে করেন। এর ফলে রাজু নিজ জাতিচ্যুত হন। কিছু দিন পর তিনি বাংলার ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তারা কোনো বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তিনি পুরির জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরির ধর্মগুরুরা তাকে মন্দিরে প্রবলভাবে নিগৃহীত ও অপমান করে এবং তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে জানিয়ে দেয়। এতে রাজু মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সুলাইমান এই রকম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি মুকুন্দদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাজীব লোচনকে সেনাপতি নিয়োগ করেন। এভাবে কালাপাহাড় উড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পান। তবে মন্দির লুণ্ঠন ও মূর্তি ভেঙে ফেলা ছাড়া মূল মন্দির অক্ষত থাকে।