ইরান সঙ্কট আদৌ কাটবে কি?
ট্রাম্প ও রুহানি - ছবি : সংগ্রহ
ইরানের সাথে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, তার সমর্থক-সহযোগী পশ্চিমাবিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান শক্তি হিসেবে গণ্য, যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেনের দ্বন্দ্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরস্পরের জাহাজ ও তেল ট্যাংকার আটকের পরিপ্রেক্ষিতে এর বিনিময়ের প্রস্তাব দিয়েছে তেহরান। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ বেধে না গেলেও ওয়াশিংটন-তেহরান সম্পর্কের পারদ বরাবরের মতো তলানিতেই। বিশেষ করে, ইসরাইল এবং কোনো কোনো প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্র চায়না বিশ্বের সর্বপ্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি ইরানের মাঝে উত্তেজনা কমে যাক। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইসরাইল যদ্দিন থাকবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য মার্কিন খায়েশের যে পর্যন্ত না অবসান ঘটে, তত দিন ইরানকে নিয়ে কারণ-অকারণে অব্যাহত উত্তেজনার মাঝে সামরিক সঙ্ঘাতের বিরাট শঙ্কা থেকেই যাবে। এর থেকে আরব-ইরানের কোনো কল্যাণ হোক বা না হোক, দু’তরফের বৃহৎশক্তিরা ফায়দা তোলার সর্ববিধ প্রয়াস চালাবে। এদিকে, স্বীয় ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার্থে ইরানের আপসহীনতার বিপরীতে মার্কিন হামলার হুমকি চলছে আগের মতোই।
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত উত্তেজনাকর ও দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কারণেই ‘মার্কিন দোসর’ হিসেবে সমালোচিত ব্রিটেনও এ সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। ইরান সরকার ও মার্কিন প্রশাসন-উভয়ে মতো নিজেকে শান্তিকামী ও যুদ্ধবিরোধীরূপে উপস্থাপনের জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তেহরানে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইরানি জাহাজ ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে ব্রিটিশ পতকাবাহী ট্যাংকার মুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে ‘আত্মসমর্পণের শর্তে’ আলোচনা করতে ইরান রাজি নয় বলে জানিয়ে দিলেন। কেবিনেট মেটিং-এ তিনি বলেছেন, ‘আমরা উত্তেজনা চাই না। সমস্যার সুরাহার্থে যে কোনো বৈধ ও সৎ আলোচনায় আমরা রাজি।’
সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমপ্রান্তের প্রবেশপথ, জিব্রাল্টার প্রণালীতে একটি ইরানি জাহাজ আটকের প্রতিক্রিয়ায় ২৬ জুলাই হরমুজ প্রণালীতে যুক্তরাজ্যের একটি তেলবাহী জাহাজকে ইরানের উপকূল রক্ষীরা আটক করেছে। তেহরানের ‘যুক্তি’, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে এটি আটক করা হয়েছে। আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, ইরানের ওপর সর্বোচ্চ মার্কিন চাপের প্রতি সমর্থন দিয়ে ব্রিটেন নতুন পরমাণু চুক্তি করতে বলেছে।
এদিকে, সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে চরম দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসায় ইরানের সাথে দেশটার সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠেছে। সেখানে দু’টি ইরানি জাহাজ আটকা পড়েছে। ব্রাজিলের পেট্রোবাস কোম্পানি এগুলোকে জ্বালানি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জাহাজ দু’টি ইউরিয়া সার নিয়ে ব্রাজিল গিয়েছিল। ইরান সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ‘জ্বালানি দেয়া না হলে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। ব্রাজিল থেকে ইরানে বছরে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। তা তখন আর করা হবে না।’ অপর দিকে, ব্রাজিলের মার্কিনপন্থী নতুন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো বলেছেন, ‘ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বর্ধিত করার ব্যাপারে ব্রাজিলের বিভিন্ন কোম্পানিকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।’ তিনি ওয়াশিংটনের সাথে ঘনিষ্ঠতার লক্ষ্যে কাজ করছেন বলেও জানান।
ইরান থেকে জ্বালানি তেল আমদানির একটা বড় বাজার হলো, এশিয়ার বিরাট দেশ ভারত। তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তেল আনা বন্ধ করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে পাশ্চাত্যের সাথে ইরানের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার ফলে ঘটনাক্রমে ভারতীয় নাবিকদেরকেও বিপাকে পড়তে হয়েছে। যেমন, ১৩ জুলাই উপসাগরে ইরানের উপকূল রক্ষীরা পানামার পতাকা বহনকারী জ্বালানি জাহাজ ‘রিয়াহ’কে চোরাচালানের অভিযোগে আটক করেছে। এতে ১২ জন ভারতীয় নাবিক ছিলেন যাদের ৯ জন ছাড়া পেয়েছেন। বাকি ৩ জনকেও মুক্তি দিতে নয়াদিল্লি সরকার আবেদন জানিয়েছে। এ যাবৎ কয়েক ডজন ভারতীয় নাবিক ‘গ্রেস-১’সমেত বিভিন্ন জাহাজের সাথে থাকায় ইরানের হাতে ধরা পড়েছে। উল্লেখ্য, ১৯ জুলাই বহুলালোচিত হরমুজ প্রণালীতে আটক করা ব্রিটিশ ট্যাংকারের নাবিকদের ১৮ জনই ভারতের লোক। তাদের সাথে যোগাযোগ করতে ইরানস্থ ভারতীয় দূতাবাসকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ইরানের সাথে ২০১৫ সালে ভিয়েতনামে সব বৃহৎশক্তি আর জার্মানির সম্পাদিত ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি থেকে মার্কিন প্রশাসন সম্প্রতি একতরফাভাবে বেরিয়ে এসেছে। এতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে বিতর্কের পাশাপাশি ইরানের সাথে পাশ্চাত্যের সম্পর্ক নিয়ে উত্তেজনা অনেক বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে সে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনলেও ইরান তা জোর দিয়ে অস্বীকার করেছে। পারমাণবিক চুক্তি থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান ট্রাম্প নিজ দেশকে প্রত্যাহার করার আগে প্যারিসের ঐতিহাসিক জলবায়ু চুক্তি থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনেছেন। চুক্তি প্রত্যাহারের চেয়ে ইরানের ওপর নতুন করে ব্যাপক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয় বেশি আলোচিত হচ্ছে এর সম্ভাব্য সুদূরপ্রসারী প্রভাবের দরুন।
ইরান-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের জের ধরে হরমুজ ও জিব্রালটার প্রণালীতে তেলবাহী জাহাজ আটক-পাল্টা আটকের ঘটনা সবিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কেননা, মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্ঘটিত বড় ধরনের সঙ্ঘাতের পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বালানির বিশেষ ভূমিকা দেখা গেছে। ১৯৯০-৯১ সালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে তদানীন্তন ইরাকী একনায়ক সাদ্দাম হোসেন প্রতিপক্ষের ৭০০ তেলকূপ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এখন পরস্পরের তেলবাহী জাহাজ আটকিয়ে মার্কিন বলয় ও ইরান অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত। এটা পুরো বিশ্বের জন্যই বিরাট উদ্বেগের কারণ।