সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক ঔদাসীন্য
সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক ঔদাসীন্য - ছবি : সংগ্রহ
তাহলে কী গুজবই কেড়ে নিচ্ছে জীবন? ডেঙ্গুর যে প্রাদুর্ভাব সারাদেশে ছড়িয়ে পরেছে, তাকে ঢাকার এক মেয়র ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। এই গুজবেই মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশত পেরেয়ি গেছে। নাগরিক সমাজ এই রোগকে ইতোমধ্যে মাহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তাদের উষ্মা কিংবা ক্ষুব্ধতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা। সরকার পক্ষ ডেঙ্গু মোকাবেলায় পদে পদে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তা নিয়ে এখন কারো মনে শঙ্কা নেই। মশা মারার ওষুধ নিয়ে নয়ছয় মুখে মুখে। এই বিপদে দায়িত্বশীলদের দেশ ছেড়ে প্রমোদ ভ্রমণে যাওয়ার বিষয়টিও আর ধামাচাপা নেই।
আসলে হঠাৎ করেই সামাজিক অস্থিরতা চরমে উঠেছে। চারদিকে বিরাজ করছে এক অসহিক্ষ্মু পরিবেশ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। ছেলেধরা সন্দেহে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে গণপিটুনি। বুঝে না বুঝেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। বেড়েছে ধর্ষণের মাত্রা। থেমে নেই শিশু নির্যাতন। খুনের ঘটনাগুলোতে ফুটে উঠছে চরম নৃশংসতা। এসবের পাশাপাশি দেশের পাঁচটি বিভাগে বন্যা, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, শেয়ারবাজারে অস্থিরতা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে অনেকটা বিষিয়ে তুলেছে।
‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’- এমন একটি নিছক গুজবের ওপর ভর করে মাস দেড়েক ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন নিরীহ নারী-পুরুষ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৬ জন এবং গত এক সপ্তাহে অন্তত সাত জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত জুলাই মাসের এক সকালে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাসলিমা বেগম রেনু নামে এক মাকে একদল উন্মত্ত লোকের পিটিয়ে মারার দৃশ্য সবাইকে নাড়া দিয়েছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পরার আগে রেনুর রক্তমাখা অসহায় মুখখানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বর্বরতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিয়েছে। নৃশংসতার কোনো প্রতিবাদ না করে উৎসুক জনতার ভিডিও ধারণের ঘটনাও মনুষ্যত্ববোধের বড় অবক্ষয় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।
রেনুর ভাই আয়মান সুমন বোনের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফেইসবুকে আবেগতাড়িত একটি পোস্ট দিয়ে বলেছেন- ‘দুটি হাত চারটি হাত লাঠি হাতে ক্রমাগত পিটিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিলো--শুধু রেনুর জীবনটা নয়, তার সব স্বপ্ন, তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আমার বোন রেনুর হত্যার ভিডিওটি যারা করেছেন, যারা দেখেছেন, তাদের সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনারা সবাই অনেক গোছানো মানুষ। পরিপাটি ফিটফাট, নিরাপদ। রেনু, বোনটা আমার যদি এর ছিটেফোঁটাও স্মার্ট হতো।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে গণপিটুনির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হলেও তা যথাযথভাবে কাজে আসছে না। পত্রিকার খবর অনুযায়ী- ছেলেধরা সন্দেহে বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত গণপিটুনির শিকার হয়েছেন প্রায় শ’খানেক।
ছেলেধরা গুজবের ফলে সৃষ্ট এসব ঘটনাগুলো পারিবারিক স্বাভাবিক জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মা-বাবারা সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে দারুন উদ্বেগে রয়েছেন। স্কুলে সন্তানদের পাঠাতেও অনেকে ভয় পাচ্ছেন। সন্তানদের চোখের আড়াল হতে দিচ্ছেন না কেউই।
সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে গেছে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৩০টি। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৮ বছর বার তার চেয়ে নিচে। আর ধর্ষণ ও ধর্ষণ প্রচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা। আসকের হিসাবে, ২৫৮টি শিশু গত ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অথচ ২০১৮ সালে এই ঘটনা ছিল ২৭১টি।
বাংলাদেশ শিশু অধিকবার ফোরামের হিসাবে, গত ছয় মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আরো বেশি। মাসে গড়ে প্রায় ৮৩টি।
ধর্ষণ, গণপিটুনির মতোই হত্যাকাণ্ডও লেগেই আছে। তুচ্ছ, সাধারণ ঘটনায়ও মানুষের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এগুলোকে সামাজিক অবক্ষয় হিসেবে অভিহিত করছেন।
এসবের পাশপাশি বন্যায় প্লাবিত এখন দেশের ২৫ জেলা। পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী-বন্যায় প্রায় ২ লাখ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আড়াইলাখ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বন্যার কারণে তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে খাদ্যসঙ্কট ও পানিবাহিত নানা রোগ। বানভাসি মানুষরা পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বলে প্রতিদিন অভিযোগ আসছে।
বন্যার অজুহাতে বেড়ে গেছে দ্রব্যমূল্য। বাজারে পর্যাপ্ত সবজির জোগান থাকলেও দাম নাগালের বাইরে। মাছের বাজারে আগুন। গরিবের মাছ পাঙ্গাশ, তেলাপিয়ার কেজিও তিন শ’র ঘরে। অন্যসব মাছের দাম শুনেই চোখ ছানাবড়া করে ঘরে ফিরছে সাধারণ মানুষ।
এরকম অস্থিরতার মধ্যেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। হাসপাতালগুলো রোগীর ভিড়ে সয়লাব। ৫০ জনের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবেলায় সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগ নেই বলে নানামুখী সমালোচনা চলছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঢাকায় উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশা নিধন অভিযান প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
শেয়ারবাজারেও চলছে অস্থিরতা। সূচক অব্যাহতভাবে নি¤œমুখী। গত ১৫ দিনে ২৭ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এতে করে ২০১০ সালের পর ফের বড় ধরনের লোকসানের মুখোমুখি বিনিয়োগকারীরা। অনেকে ইতোমধ্যেই পথে বসে গেছেন।
এরকম চতুর্মুখী ত্রাহি অবস্থায় পরে ভুক্তভুগীদের দিনকাটছে চরম অনিশ্চতায়। তারা এ অবস্থা থেকে মুক্তির প্রহর গুনছেন।
সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্প্রতি একটি দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- ‘ভালো মন্দ মিলিয়ে চলছে দেশ। তবে মন্দের কর্তৃত্বই বেশি। বাংলাদেশ পরিণত হচ্ছে ধর্ষণের দেশে। মাদকাসক্তি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে, বাড়ছে। বিনাবিচারে সন্দেহভাজনদের হত্যা বেড়ে চলেছে। সরকারি দলের অনেক লোকের ও পুলিশের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থাই দারুণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রগঠনের ও জাতি গঠনের পরিপন্থী। রাজনীতি দারুণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত।’
সমাজবিজ্ঞানী আবুল কাশেম ফজলুল হকের এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। যদি ডেঙ্গু ইস্যুটিই ধরা হয়, তাহলে নাগরিকদের সাধারণ মশার আক্রমণ থেকেও রক্ষা করতে পারেনি রাজনীতি। সরকারি দলের বিপরীতে যে রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি রয়েছে, তারাও ম্রিয়মাণ। শক্তি হারিয়ে তারা যেন পথে বসে গেছে। গেল নির্বাচন বিরোধী শক্তিকে আরেক দফা অকার্যকর করে দিয়েছে। সরকারের দোর্দণ্ড প্রতাপে তারা কোনো কিছুই করতে পারছে না। দেশে কার্যত বিরোধী দল বলতে কিছুই নেই বা সরকার এ ধরনের কোনো শক্তিকে বাড়তে দিতে চাচ্ছে না। ডেঙ্গু সচেতনতার মতো র্যালিতেও তারা বাধ সাধছে।
বিরোধীশক্তি দমিয়ে রাখার পরেও যদি সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকত কিংবা নাগরিকেরা স্বস্তিতে জীবনধারণ করতে পারত, তাহলে হয়তো সান্ত্বনা পাওয়া যেত। কিন্তু সবাই যেন আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অসহায়।