বাংলাদেশে বন্যা
বাংলাদেশে বন্যা - ছবি : সংগ্রহ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। বিশেষ করে বন্যা আর বাংলাদেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলা পিডিয়ার তথ্য মতে, প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ গড়ে ছয়টি করে বন্যার কবলে পড়েছে, ব্যাপকতায় যা ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার মতো। বাংলাদেশের এ মওসুমি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মহাভারত, রামায়ণসহ অনেক বইয়ে পাওয়া যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (৩২১-২৯৬ খ্রি.পূ) শাসনামলে তার অর্থমন্ত্রী কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের নানা স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান উল্লেখ রয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয়, বৃষ্টিপাতের হিসাব সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল। জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির (৫০৭-৫৮৭ খ্রি.পূ) বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে পারতেন। জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তও বর্ষা মওসুম নিয়ে গবেষণা করেছেন। বিখ্যাত সংস্কৃত কবি কালিদাস বিরচিত বর্ষার বিরহ অভিসার মেঘদূত ও ঋতুসংহার কাব্য বিশ্ববিশ্রুত ধ্রপদী-মহাকাব্য। তবে প্রাচীনকালে খনা নামে এক বিদুষী নারী আবহাওয়া ও কৃষিবার্তা সম্পর্কে বেশির ভাগ পূর্বাভাস দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের কৃষক সমাজ আজো তার সহজ সরল ভাষায় রচিত ছড়াগুলো স্মরণ করে।
গত ৫০ বছরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতটি বড় বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা প্রলয়ঙ্করী হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা একসাথে সক্রিয় হওয়ায় বড় বন্যা হয়। ১৯৮৭ সালে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি আর ১৯৮৮ সালে ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের বন্যায়। ১৯৮৮ সালে দেশের বাইরে ও ভেতরে ভারী বৃষ্টিপাত, হিমালয় পর্বতে তুষার গলা ও হিমবাহের স্থানান্তর, প্রধান নদীগুলোয় একসাথে পানি বৃদ্ধি পাওয়া, জোয়ার-ভাটাসহ নদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহে ধীরগতি এবং হঠাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ওই বছর বন্যা হওয়ার প্রধান কারণ। সাধারণত বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের অতিবৃষ্টি বন্যার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণেই এখন বেশি বন্যা হচ্ছে।
তদানীন্তন বাংলা অঞ্চলে ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বন্যার ওপর অধ্যাপক প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ সর্বপ্রথম বিস্তারিত এক প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছিলেন। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ অঞ্চলে মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ছয়-সাত বছরে বয়ে গেছে। ১৭৮৭ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত বারবার বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের পুরনো গতিপথ বদলে যায়। ১৯২২ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর একটি ‘বন্যা কমিটি’ গঠন করা হয়। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গে ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সঙ্ঘটিত অনেক বন্যার ওপরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের উপাত্ত বিশ্লেষণে মত প্রকাশ করা হয়, বড় ধরনের বন্যা প্রতি সাত বছরে একবার এবং মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা প্রতি ৩৩-৫০ বছরে একবার এই জনপদে দেখা দেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়।
জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২১০০ সাল নাগাদ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ হেক্টর জমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তীব্র বন্যার কবলে পড়বে নিম্নাঞ্চল। সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকেরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় চীন ও বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়বে বলে নাসা সতর্ক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপরিভাগের তাপমাত্রা যদি ক্রমবর্ধমান থাকে; তাহলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের গড় উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বাড়বে। এতে দেশের প্রায় ১৪ শতাংশ স্থলভূমি নিমজ্জিত হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিমাত্রায় তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টিপাত এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। অল্প বৃষ্টিতেই দেশের প্রধান প্রধান শহর পানিতে ডুবে যায়, যা রূপ নিয়েছে জলাবদ্ধতায়। এটি চলতে থাকলে বাংলাদেশে বন্যা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিতে পারে। তা দেশের প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ড গ্রাস করবে।
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক থেকে এ অঞ্চলে বড় ধরনের মওসুমি বন্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। ১৭৮১ সালে বড় ধরনের বন্যা বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটের পশ্চিমাঞ্চলে বয়ে যায়। ১৭৮৬ সালে মেঘনার বানে তীরবর্তী গ্রামের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বরিশাল বা বাকেরগঞ্জে বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। ১৮২২ সালে বাকেরগঞ্জ বিভাগ ও পটুয়াখালীতে বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ১৮২৫ সালে বাকেরগঞ্জ ও এর আশপাশে বিধ্বংসী বন্যা হয়। ১৮৩৮ সালে ভারী বর্ষণে রাজশাহী ও আরো কিছু জেলা প্লাবিত হয়। পানি নেমে যাওয়ার পর মহামারী আকারে কলেরার বিস্তার ঘটে। ১৮৫৩ সালে ভারী বর্ষণ ও মেঘনা নদীর তীর ছাপানোয় বৃহত্তর সিলেটের পশ্চিম অংশে প্লাবন দেখা দেয়। ১৮৬৪ সালে গঙ্গার পানিতে রাজশাহী শহরের বৃহত্তর অংশ তলিয়ে গিয়েছিল। ১৮৬৫ সালে প্লাবনেও রাজশাহী শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে এ শহর বিপর্যস্ত হয়। ১৮৬৭ সালে বন্যা বাকেরগঞ্জে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ১৮৬৯ সালেও বন্যা দেখা দেয়। ১৮৭১ সালে রাজশাহী ও আরো কিছু জেলায় বড় আকারের বন্যা হয়। ১৮৭৬ সালে বরিশাল ও পটুয়াখালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় বন্যায় ।
মেঘনা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ দশমিক ৭১ মিটার স্ফীত হলে পটুয়াখালীর গলাচিপা ও বাউফলের ক্ষতি হয়। ১৮৭৯ সালে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন শুরুর সাথে সাথে তিস্তায় বান দেখা দেয়। ১৮৮৫ সালে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের ভাগীরথী নদীর পানিতে বন্যা হয়েছিল সাতক্ষীরায়। ১৮৯০ সালে সাতক্ষীরায় ফের বন্যা হয়। ১৯০০ সালে ভাগীরথীর পানিতে আবারো সাতক্ষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯০২ সালে সিলেটে নদীপৃষ্ঠ স্ফীত হয়ে সৃষ্টি হয় প্রলয়ঙ্করী বন্যা। ১৯০৪ সালে অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ারে কক্সবাজার ও কুতুবদিয়া দ্বীপের কিছু অংশে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯১৫ সালে ময়মনসিংহে তীব্র বন্যা সংঘটিত হয়। ১৮৫৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ বদলে গিয়ে তিস্তা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়। ১৯৫২ সালের আগস্টে ঢাকা শহর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে তদানীন্তন ঢাকা জেলার ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ১৯৬২ সালে দুইবার বন্যাকবলিত হয় ‘ভাটি বাংলা’। ১৯৬৬ সালে ভয়াবহভাবে বন্যাকবলিত হয় ঢাকা জেলা। এ বছর সিলেট অঞ্চলেও বড় ধরনের বন্যা হয়। ১৯৬৮ সালে সিলেট আবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। ১৯৬৯ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বন্যা হয়। ১৯৭৪ সালে ময়মনসিংহে ১০ হাজার ৩৬০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়। ১৯৮৭ সালের জুলাই-আগস্টে বন্যায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের ৪০ শতাংশ জায়গা ডুবে যায়। এ ধরনের বন্যা ৩০-৭০ বছরে একবার ঘটে। ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমাঞ্চল, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র একীভূত হওয়ায় নি¤œাঞ্চল, খুলনার উত্তরাংশ এবং মেঘালয় পাহাড়সংলগ্ন অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে স্মরণকালের ভয়ঙ্কর বন্যা দেখা দেয়। ৮২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। দেশের ৬০ শতাংশ পানিতে নিমজ্জিত হয়। এমন বন্যা ৫০-১০০ বছরে একবার দেখা দেয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বৃষ্টিপাতের সাথে একই সময়ে; বিশেষ করে তিন দিনের মধ্যে দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি একই সময় হওয়ায় বন্যার ব্যাপ্তি তীব্র হয়ে ওঠে। ঢাকা মহানগরও প্লাবিত হয়। বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ১৫-২০ দিন। ১৯৮৭ সালেও দেশে বড় বন্যা হয়েছে। ১৯৮৯ সালে সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বন্যায় ছয় লাখ লোক পানিবন্দী হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে সারা দেশে ভারী বৃষ্টিপাত হলে হাজার হাজার হেক্টর জমির শস্য বিনষ্ট হয় এবং ২৮ জেলা বন্যাকবলিত হয়।
২০০০ সালে ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় পাঁচ জেলায় বন্যা দেখা দেয়।
২০১৬ সালেও দেশ মাঝারি আকারের বন্যাকবলিত হয়। তবে ২০১৭ সালে লক্ষণীয় ছিল বাংলাদেশের বন্যা। ২০১৭-১৮ সাল ছিল একটি ‘লা নিনা’ বছর। যত রকম দুর্যোগ হয়েছে এ সময়ে, তা অনেকটা ‘লা নিনা’র কারণে। ‘এল নিনো’ প্রতি তিন থেকে সাত বছরে একবার দেখা যায়। তা বিরাজমান থাকে প্রায় ১২-১৮ মাস পর্যন্ত। এ সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় বিস্তর পার্থক্য হয় (প্রায় +০.৫ থেকে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। তখন এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা এবং মাঝে মধ্যে পুরো পৃথিবীর আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে। অন্য দিকে, লা নিনা হলো এল নিনোর সম্পূর্ণ বিপরীত এবং এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য হয় (প্রায় -০.৫ থেকে -৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া এল নিনো ও লা নিনার প্রতি সংবেদনশীল। এই এল নিনোর ফলে পৃথিবীর কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম হয়, বৃষ্টি হয় কম, কখনো কখনো খরা হয়, ঝড়ের উৎপাত বেড়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকে। আবার পৃথিবীর কোথাও কোথাও এর উল্টোটাও হয়। অন্য দিকে, লা নিনা হলে ঠিক এল নিনোর উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় পৃথিবীজুড়ে। অর্থাৎ, গরমের বদলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা, স্বল্প বৃষ্টির বদলে অতিবৃষ্টি ইত্যাদি দেখা দেয়। গত ৫০ বছরে এল নিনো হয়েছিল ১৭ বার এবং লা নিনা হয়েছিল ১২ বার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এ ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে বলে জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন।
বাংলাদেশে এলাকাভেদে ২০১৭ সালের বন্যা ‘ভয়াবহ’ এবং ‘অতি ভয়াবহ’ পর্যায়ের ছিল। তবে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের তুলনায় ভয়াবহ বলা যাবে না। কারণ, গঙ্গার পানি নামতে নামতে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের পানি মধ্যাঞ্চল পার করে নিচের দিকে ঠেলে দেয়। এ কারণে ১৯৮৮ বা ১৯৯৮-এর মতো বিস্তৃত দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয়নি। তবে পানিপ্রবাহ ও ক্ষতি বিবেচনায় বন্যাকে এলাকাভিত্তিক হিসেবে ভয়াবহ থেকে অতি ভয়াবহ বলা যায়। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে।
২০১৭ সালের বন্যার জন্য অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক কারণগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, যেমন গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র -মেঘনা অববাহিকাজুড়ে অতিবৃষ্টি। তবে মোহনায় দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৭-১৮ সালের লা নিনা অনেকাংশে দায়ী। একইভাবে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যাও ছিল লা নিনা দ্বারা প্রভাবিত। সাধারণত প্রতি লা নিনা বছরেই বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে অতিবৃষ্টি ও বন্যা হয়। ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের তুলনায় একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল লা নিনার প্রভাব ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে লক্ষ করা যাচ্ছিল, যেটা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রকটভাবে দেখা দেয়। দুর্বল লা নিনা সত্ত্বেও এটি প্রচণ্ড আঘাত হানে বাংলাদেশে এবং ২০১৭ সালের লা নিনা ছিল এ বন্যার একটি অন্যতম কারণ।
চলতি বছরের বন্যা
চলতি বছেরের জুলাইয়ে শুরুতেই দেশের ২৮টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। জানা যায়, বন্যায় ২৮ জেলার ১৬৩ উপজেলা, ৪৯ পৌরসভা, ৯৬১ ইউনিয়ন এবং ছয় হাজার ৫৩টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার ৭৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যায় পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭৮ ঘরবাড়ি, এক লাখ ৫৩ হাজার ৭৩৩ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪৫টি গবাদি পশু, ২২ হাজার ৩৩৯টি হাঁস-মুরগি মারা গেছে। এ ছাড়া চার হাজার ৯৩৯টি শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাত হাজার ২৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৯৭টি ব্রিজ বা কালভার্ট, ৪৫৯ কিলোমিটার বাঁধ, ৬০ হাজার ২৮৯টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশে বন্যাজনিত কারণে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ৭২ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক। ১০ বছরের কম বয়সী শিশু ৩৩ জন। ২৩ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, বন্যার কারণে ১২ দিনেই বিভিন্ন জেলায় মারা এরা মারা গিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগসংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদন বলছে, গত ২৯ জুলাই পর্যন্ত ১২টি জেলায় শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে চার হাজার ৩৩১টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে চেয়ার, বেঞ্চসহ আসবাব ও শিক্ষা উপকরণের ক্ষতি হয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এবারে বন্যাদুর্গতদের জন্য সরকার কী করছে? সব যেন রুটিন ওয়ার্কের মতো। অনেকের অভিযোগ, এবার বিপর্যয়ের মাত্রা যত বেশি, সরকারি-বেসরকারি সাড়া তত কম। চলতি বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলা। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, বাসস্থান নেই, চিকিৎসা নেই, শিশুদের শিক্ষা পর্যন্ত বন্ধ। তাহলে মানুষের মৌলিক অধিকারের আর কী অবশিষ্ট আছে?
বন্যা মোকাবেলা
প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যাকবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে দেশের ৫৫ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড প্লাবিত হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে তিনটি প্রধান নদীপথে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর্দ্র মওসুমে আট লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়। বাৎসরিক মোট প্রবাহের এটি ৯৫ শতাংশ। একই সময় দেশের অভ্যন্তরে এক লাখ ৮৭ হাজার মিলিয়ন কিউবিক মিটার নদীপ্রবাহ সৃষ্টি হয় বৃষ্টিজনিত কারণে।
বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : ক. মওসুমি বন্যা। এই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে ওঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ক্ষতি করে; খ. আকস্মিক বন্যা। এটি পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয়; এবং গ. জোয়ারসৃষ্ট বন্যা। সংক্ষিপ্ত স্থিতিকালবিশিষ্ট এ বন্যার উচ্চতা ৩-৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি ভূভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর বাৎসরিক সম্মিলিত বন্যার প্রবাহ একটিই নির্গম পথ অর্থাৎ লোয়ার মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এ কারণে লোয়ার মেঘনার ঢাল ও নিষ্ক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। নদীর জলের স্তরের এ উচ্চতার প্রতিকূল প্রভাব সারা দেশেই পড়ে। কারণ, বন্যার পানি নিষ্ক্রমণের অবস্থা ও ক্ষমতা দুটোই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে ছোট ছোট নদীর প্রবাহ কমে যায়। একই সাথে ভূপৃষ্ঠের পানির আভিকর্ষিক নিষ্ক্রমণ শুধু বন্যার ওপরে জেগে থাকা ভূমিতে সীমাবদ্ধ। নিষ্ক্রমণ প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট বন্যা দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের উঁচু ভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ডান দিকের প্লাবনভূমি রক্ষা করছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্লাবনভূমিকে তিনটি সুস্পষ্ট অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়, যথা : ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার বাম প্লাবনভূমি; মধুপুর গড় দ্বারা ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে বিচ্ছিন্ন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী উপত্যকা ও মেঘনা নদী অববাহিকা। মেঘনা অববাহিকা মহা-সিলেট-অবনমন দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত; যেখানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী মিলিত হয়ে মেঘনা নাম পরিগ্রহ করেছে। মেঘনা নদীর পানির উচ্চমাত্রা বন্যার মওসুমে ভাটিতে পদ্মা নদীর পানির মাত্রা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্ষাকালের প্রারম্ভে মেঘনা নদী দ্রুত বন্যার পানিতে ভরে ওঠে। বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা পূর্ণাবস্থায় বিরাজ করে। এ অববাহিকায় নিষ্ক্রমণের হার কম। উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পার্বত্য পরিবাহ নিষ্ক্রমণ আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে। এ বন্যা স্বল্পকালীন হলেও এর সংঘটনের হার বা তীব্রতা সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানা যায় না। একই মওসুমে এ ধরনের বন্যা বেশ কয়বার দেখা দিতে পারে।
দক্ষিণ-মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ স্থানে বন্যা জোয়ারভাটা, ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস ও অপর্যাপ্ত নিষ্ক্রমণ দিয়ে প্রভাবিত। দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের উত্তরাঞ্চলীয় অর্ধপদ্মা ও লোয়ার মেঘনার মুখ্য প্লাবনভূমি আর দক্ষিণাঞ্চলীয় অর্ধ হচ্ছে জালসদৃশ মোহনাস্থ খাঁড়ি, যেগুলোর মাধ্যমে লোয়ার মেঘনার প্রবাহের প্রায় ৪০ শতাংশ সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিষ্ক্রমণ ব্যবস্থা গঙ্গার পলি আবৃত সাবেক শাখা নদীগুলোর মাধ্যমে প্রধানত চালু আছে। প্রায় মজে যাওয়া একটি বদ্বীপের মাধ্যমে এ শাখা নদীগুলো সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত। ফলে অগভীর বন্যার প্রাদুর্ভাব এ অঞ্চলে খুব বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বন্যা হওয়ার কারণগুলো হলো : সাধারণভাবে নি¤œ উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান, যার ওপর দিয়ে প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে। দেশের বাইরে নদনদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টিপাত; হিমালয় পর্বতে তুষার গলা এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন; পলি জমে নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, নদীর পার্শ্বদেশ দখল হয়ে যাওয়া, ভূমিধস; প্রধান প্রধান নদীতে একসাথে পানি বাড়তে থাকা এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব; প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ; জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার ফলে নদনদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহ ধীরগতিপ্রাপ্ত হওয়া; সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া; ভূমিকম্প, নদীর প্রবাহ ও ভূরূপতত্ত্বে পরিবর্তন; গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি।
১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যা ব্যাপক ধ্বংস, দুর্ভোগ আর প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পর পর দুই বছর বন্যার দরুণ সরকার বারবার বন্যা সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে পেতে পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্রতী হয়। এ লক্ষ্যে বেশ কিছু জরিপ চালানো হয়। ফলে ১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণীত হয়। বন্যার ক্ষতি কমিয়ে আনতে কয়েকটি প্রস্তাব করা হয়। অবশ্য, এসব প্রস্তাবের বেশির ভাগই গঙ্গাকেন্দ্রিক, যদিও বন্যা মওসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের নির্গমনের মাত্রা গঙ্গার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ বন্যার হাত থেকে জনবসতি ও ফসলি জমি রক্ষায় প্রতি বছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর হারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করা হচ্ছে। মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে এর উপকারিতা ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব এখনো যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। বন্যার ক্ষতি ও প্রতিকূল প্রভাব কমাতে এবং অতিরিক্ত পানি সেচকাজে ব্যবহারের উদ্দেশে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ জি-কে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) প্রজেক্ট, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রজেক্ট, কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প, উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, উত্তরবঙ্গের নলকূপ প্রকল্প, ব্রহ্মপুত্র বাঁধ, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা প্রকল্প, মনু নদী প্রকল্প, খোয়াই নদী প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প, গোমতী প্রকল্প, মুহুরী বাঁধ প্রকল্প, তিস্তা বাঁধ প্রকল্প (পর্যায়-১), ঢাকা সমন্বিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, প্রণালী পুনর্বাসন প্রকল্প, জরুরি বাস্তবায়ন প্রকল্প।
কাঠামোগত পদক্ষেপ ছাড়াও বন্যা প্রশমন প্রক্রিয়া ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে একটি বিকল্প কৌশল হিসেবে অকাঠামোগত পদক্ষেপের কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অকাঠামোগত পদক্ষেপ বলতে বন্যা মোকাবেলায় সামাজিক অভিযোজন বোঝানো হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-১. লোকজন যাতে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারেন, সে লক্ষ্যে বন্যার পানির উচ্চতা বাড়তে থাকার বেশ আগে থেকেই জনগণের কাছে বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করা; ২. নদনদীর উপচে পড়া পানি কমাতে ভূমি ব্যবস্থাপনা। এ উদ্দেশে বনায়ন এবং পুনর্বনায়নের সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ এবং এর যথাযথ সংরক্ষণ; যাতে পরিশোষণ প্রক্রিয়া বাড়ানোর মাধ্যমে বন্যার পানির উচ্চতা কমতে পারে; ৩. ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগ, শস্য উৎপাদন বহুমুখীকরণ তথা বন্যা প্রতিরোধী বা বন্যা সহনক্ষম শস্য চিহ্নিতকরণ ও রোপণ করা এবং শস্য রোপণ মওসুমের অভিযোজন; ৪. প্লাবনভূমি বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা। উন্নয়নকাজ নিয়ন্ত্রণ করতে ভূমি ব্যবহার এলাকা তৈরি করা। অকাঠামোগত পদক্ষেপগুলো স্বল্পব্যয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যা ব্যবস্থাপনা সার্বিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আঞ্চলিক সহযোগিতা পানি প্রতিবেশব্যবস্থার স্থায়ী সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে অতিপ্রয়োজনীয় যৌথ কলাকৌশলের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করবে।
বন্যা তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোনো নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়। তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত করলে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্লাবনভূমি যেহেতু মানুষের কাক্সিক্ষত ও কৃষিকাজের সহায়ক, তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা ও এর ক্ষতি যাতে সীমা ছাড়িয়ে যেতে না পারে তা লক্ষ করা প্রয়োজন।
ভাটি অঞ্চল হওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়া স্বাভাবিক। সুতরাং এ সমস্যার সমাধানের রূপরেখা স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারগুলোর কাছ থেকে আসা উচিত ছিল। ছাত্রদের ১১ দফাভিত্তিক উত্তাল ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান হয়। তার অষ্টম দফায় দাবি তোলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তারপর স্বাধীনতা এসেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলল, কিন্তু বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান আজো করতে পারিনি আমরা।