হজ ও কোরবানি আল্লাহপ্রেমের অনুপম আদর্শ
হজ ও কোরবানি আল্লাহপ্রেমের অনুপম আদর্শ - ছবি : সংগ্রহ
হজ ও কোরবানির বারতা নিয়ে আগমন করে মাহে জিলহজ। আল্লাহপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের উপলক্ষে বায়তুল্লাহর হজ ও আল্লাহর রাহে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু বিলিয়ে দেয়ার বিধান কোরবানি মুমিন জীবনের অন্যতম প্রধান অধ্যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানবজাতিকে পাঠিয়েছেন এক বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে। অস্থায়ী ও সীমিত দুনিয়াবি জীবনে মানুষ এক অদ্বিতীয় স্রষ্টার অধীনতা ও বাধ্যতা স্বীকার করে তাঁর বিধান ও নির্দেশ অনুসারে সময় নির্বাহ করবে এবং পরকালীন স্থায়ী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করবে এ উদ্দেশ্যে। কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এ জন্য যে, তারা তাঁর ইবাদত করবে।
মুসলমান হওয়ার অর্থ আল্লাহর বিধানের কাছে মাথা নত করে দেয়ার অঙ্গীকার আর রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণের প্রতিজ্ঞা। কালেমা পাঠের মাধ্যমে সে আনুগত্য ও অনুসরণের শপথ গ্রহণ সম্পন্ন হয়। তারপর এক এক করে অর্পিত হতে থাকে আল্লাহর হুকুম ও নবী করিম সা:-এর সুন্নাহ পালনের দায়িত্ব। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুমিনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ পালনীয় বিধান। ইসলামের ভিত্তিমূলক বিষয়গুলোর অন্যতম নামাজ জগতস্র্রষ্টার সমীপে বান্দার সর্বসত্তা নিবেদনের যেমন উজ্জ্বলতম নিদর্শন, তেমনি সৃষ্টি জগতের প্রতি বিমুখতা ও প্রভুর প্রতি অনুরাগের বিশেষ প্রমাণ। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থিতি ও হৃদয় মস্তিষ্কের একাগ্রতা নামাজের জরুরি বিষয়গুলোর অন্তর্গত। আর থাকে পবিত্র বাণীর পাঠ ও আল্লাহর মহিমা শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা। তাসবিহ, তাকবির, দেহ ও অবয়বের নিয়ন্ত্রণ এবং আল্লাহর মহান দরবারে সমুপস্থিতির মাধ্যমে মানুষ নিজের আবদিয়াত ও ইহতিয়াজ বা দাসত্ব ও মুখাপেক্ষিতার প্রমাণ দেয়। তেমনি কালাম পাক তিলাওয়াত ও তাসবিহ তাকবির পাঠের মাধ্যমে সে অগ্রসর হয় খোদায়ি সান্নিধ্যের অভিমুখে।
তারপর একজন মুমিনের ওপর অর্পিত হয় আর্থিক ইবাদত। নিজের সামর্থ্য ও অধিকারের সব কিছু মহান প্রভুর ইচ্ছার কাছে সমর্পণের যে অঙ্গীকার ঈমানের মাধ্যমে করা হয়, দৈহিক ইবাদত নামাজের পর সম্পদ ও অর্থের ক্ষেত্রেও তার প্রমাণ দিতে হয়। তাই তার ওপর অর্পিত হয় সম্পদের জাকাত আদায়ের হুকুম। অবশ্য এ হুকুম পালনের জন্য শর্তাদি ও নিয়মাবলি এমনভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, যাতে মুমিনের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যত্যয় না ঘটে। মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ন্যূনতম পরিমাণের প্রবৃদ্ধিশীল সম্পদ যখন একটি উল্লেখযোগ্য মেয়াদে কারো অধিকারে থাকে, তখনই তাকে বাধ্য করা হয় সেই অতিরিক্ত সম্পদের ক্ষুদ্র একটি অংশ আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণে ব্যয় করতে।
মুমিনের জীবনে সর্বোচ্চ মর্যাদার ইবাদত বায়তুল্লাহর হজ। কালেমা, নামাজ, জাকাত ও সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্য ও অনুরাগের যে ক্রমোন্নতি অর্জিত হয়, তার চরম অভিব্যক্তি ঘটে হজের মাধ্যমে। দীর্ঘ সফরের কায়িক শ্রম ও বিরাট অংকের অর্থ ব্যয়ের সমন্বিত ইবাদত এটি। আর তা পালনের সুযোগ ঘটে সীমিত সংখ্যক বান্দার। তাই তা প্রতিটি মুমিনের জীবনে অন্যতম আকাক্সিক্ষত বিষয়। পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মুমিন বান্দারা সমবেত হয় আরব মরুর প্রাচীনতম নগরী মক্কা মুকাররমায়। সেখানে অবস্থিত আল্লাহর বিশেষ ঘর কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করার সময় যখন তারা লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে, তখন সৃষ্টিকূলের সবাই একযোগে রাব্বুল আলামিনের প্রতি আগ্রহ ও আত্মনিবেদনের চরম পরাকাষ্ঠার প্রমাণ দেয়।
হজ আল্লাহ প্রেমে ব্যাকুল বান্দাদের আকুল অভিব্যক্তির ইবাদত। খোদায়ি সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার মহড়া চলে সজ্জা ও শোভার সব ভূষণ ত্যাগের মাধ্যমে। নওয়াব-নফর, বাদশাহ-ফকির একই সাদাসিধে পোশাক পরে আল্লাহর ঘরের চারপাশে অস্থিরভাবে পরিভ্রমণ করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে। একই আদম-হাওয়ার সন্তান একই পরিবারের সদস্য হিসেবে তারা সাম্য ও মৈত্রীর যে নমুনা পেশ করে, তার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনো সমাবেশের সাথে হতে পারে না। এ জন্য বায়তুল্লাহর হজ একদিকে যেমন ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চ মাকাম, তেমনি মানব সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
হজের অন্যতম রুকন উকুফে আরাফায়ে মানবসাম্য ও মৈত্রীর প্রকাশ ঘটে সবচেয়ে জ¦লন্তভাবে। তপ্ত মরুর বিস্তীর্ণ ময়দানে সারা পৃথিবী থেকে আগত মানুষেরা বর্ণ গোত্র ও আঞ্চলিক সীমারেখা ঘুচিয়ে একই সুরে একই বেশে আরাধনা জানাতে থাকে পরম করুণাময়ের দরবারে। লাব্বাইক বলে বলে নিজের উপস্থিতির ঘোষণাই তারা দেয় না, বরং দুনিয়াবি জিন্দেগির প্রতি নির্মোহ মনোভাব ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ব্যাকুলতাও প্রকাশ করে। তেমনি বিশ^বাসীর সামনে প্রমাণ করে, ভৌগোলিক সীমারেখা ও ভাষা-বর্ণের ব্যবধান থাকলেও অভিন্ন বিশ্বাস ও ভাবধারায় তারা গ্রথিত। জাতীয়তাবাদের আপাত মধুর স্লোগানে মানুষে মানুষে যে বিভেদরেখা অঙ্কিত হয়েছে, তার অবসানের প্রয়োজন যদি কখনো অনুভূত হয়, তাহলে তা বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় হবে আদর্শিক অভিন্নতা। আর সে আদর্শ হতে হবে স্বার্থান্ধতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত। ইসলাম নামের আসমানি জীবনাদর্শ ছাড়া এমন কোনো সার্বজনীন দর্শন কী এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত হতে পেরেছে যা বিশ্বের সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে সহাবস্থানের ব্যবস্থাপত্র দেয়?
আরাফাতের ময়দানেই মহানবী সা:-এর পবিত্র জবানে উচ্চারিত হয়েছিল মানবাধিকারের প্রথম ঘোষণা। মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়। আধুনিক সভ্যতার উন্নততম অবস্থানে অধিষ্ঠানের দাবিদারেরা এখন থেকে মাত্র ছয় দশক আগে মানবাধিকার সনদ নামে এক অসম্পূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইসলামের নবী মরুভূমির এক খোলা ময়দানে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার ঘোষণা করে গিয়েছেন আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর আগে। মহানবী সা:-এর বিদায় হজের সময়ে জগতবাসীকে শান্তি ও কল্যাণের যে অমিয় বাণী শুনিয়ে গিয়েছিলেন, তার অনুসরণে যতদিন সবাই সচেষ্ট না হবে, ততদিন কোনো মতবাদ, দর্শন কিংবা ব্যবস্থাই ফলপ্রসূ কিংবা কার্যকর হবে না।
বায়তুল্লাহর হজের মাস জিলহজের সাথে রয়েছে আরেক ইবাদত। ৯ তারিখে উকুফে আরাফা আর ১০ তারিখে তাওয়াফে জিয়ারত হজের দুটি প্রধান স্তম্ভ বা অপরিহার্য পালনীয় কর্তব্য। ১০ তারিখে হাজীদের জন্য আরো একটি অতি জরুরি কাজ কোরবানি করা। আর যারা হজের উদ্দেশ্যে যায়নি, নিজেদের বাড়ি বা বাসস্থানে অবস্থানকারী সেসব ব্যক্তির জন্যও হাজীদের মতোই জিলহজের ১০ তারিখে কোরবানি করতে হয়। ঈদুল ফিতরের মতোই দুই রাকাত ঈদুল আজহা নামাজ আদায়ের পর পশু কোরবানির হুকুম পালন করতে হয় সামর্থ্যবান মুসলমানদের। এ সামর্থ্যরে ব্যাখ্যা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
জাকাতের মতোই কোরবানির জন্য সামর্থ্য ও সচ্ছলতা শর্ত। তবে জাকাতের সাথে কোরবানির সামর্থ্যরে পার্থক্য আছে। মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমমূল্যের প্রবৃদ্ধিশীল সম্পদ কারো অধিকারে পূর্ণ এক বছর থাকলে তার ওপর জাকাত ফরজ হয। কিন্তু কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য ওই অতিরিক্ত সম্পদ যেমন প্রবৃদ্ধিশীল হওয়া জরুরি নয়, তেমনি পূর্ণ এক বছর অধিকারে থাকাও শর্ত নয়। যে কোনো ধরনের সম্পদ শুধু জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে থাকলেই চলে। শর্ত হলো- মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া ও সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা সমমূল্যের হওয়া।
কোরবানির তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘এটি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর সুন্নত।’ প্রতিদান সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি। ভেড়ার পশমের কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি নেকি দেয়া হবে।’ রাসূল সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিনে আল্লাহ তায়ালার কাছে কোরবানির চেয়ে বেশি প্রিয় কোনো নেক কাজ নেই। কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। কিয়ামতের দিন ওই পশু তার খুর-পশম সবকিছু নিয়ে উপস্থিত হবে। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি করবে।’ বস্তুত হজরত ইবরাহিম আ:-এর অনুসরণে নিজের প্রিয় বস্তু আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার আহ্বান নিয়ে আগমন করে ঈদুল আজহা। মিল্লাতে মুসলিমার রুহানি পিতা হজরত ইবরাহিম আ: যেসব কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তার একটি ছিল প্রিয়তম সন্তান হজরত ইসমাঈল আ:কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করা। তিনি তাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ পাক চাইছিলেন হজরত ইবরাহিম আ:-এর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরীক্ষা নিতে। হজরত ইবরাহিম আ: তাতে সফল হলেন। বাস্তবিক পুত্র কোরবানি তাকে করতে হলো না। তিনি চোখ বন্ধ করে পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন। চোখ খুলে দেখলেন জবাই হয়েছে একটি দুম্বা। আর ইসমাঈল আ: অদূরে দাঁড়িয়ে হাসছেন। আসমান থেকে ঘোষণা করা হলোÑ ‘আপনি স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন।’
হজরত ইবরাহিম আ:-এর আদর্শ চিরস্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহ তায়ালা। উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পালনীয় সাব্যস্ত করা হয়েছে পশু কোরবানি। কিন্তু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা কামনা করা হয়েছে হজরত ইবরাহিম আ:-এর মতোই। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘এসবের (পশু) গোশত কিংবা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ অর্থাৎ পশু কোরবানি করা হলেও এমন মনোবৃত্তি থাকতে হবে যে, সবচেয়ে প্রিয় বস্তু এমনকি প্রিয়জনকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে প্রস্তুত থাকব। তাইলেই পশু কোরবানি স্বার্থক হবে।
কোরবানি একটি নমুনা মাত্র। এখানকার প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও পর্যায়ে নিজের প্রাপ্য, বক্তব্য, অভিমত ও প্রস্তাবের প্রাধান্য ও অগ্রগতির দাবি পরিহার করলেই হজরত ইবরাহিম আ:-এর প্রকৃত অনুসরণ হয়।
মহানবী সা: উম্মতকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন নিঁখুত পশু কোরবানি করতে। বাহ্যিকভাবে তা যেমন ত্রুটিমুক্ত হতে হয়, তেমনি অন্তরেও পোষণ করতে হয় একাগ্রতা ও আল্লাহ প্রেমের ব্যাকুলতা। পার্থিব জীবনের সহায়ক উপকরণাদির প্রতি মোহ ও আকাঙ্ক্ষা যেন বদ্ধমূল না থাকে বরং তা যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত আমানত হিসেবে বিবেচনা করে মালিকের ইচ্ছা ও আদেশ মোতাবেক প্রত্যর্পণের আগ্রহ পোষণ করা হয়, ঈদুল আজহা সে আহ্বান নিয়ে আগমন করে।