কাশ্মির দিয়েই শুরু হবে ভারতের ভাগ
কাশ্মির দিয়েই শুরু হবে ভারতের ভাগ - ছবি : সংগ্রহ
কাশ্মির ভারতের অংশ নয়, এটা নেহরু-গান্ধীসহ তৎকালীন কংগ্রেসের অন্য নেতারাও জানতেন ও মানতেন। কেন? এটা সেই ১৮১৫ সালের রাজা রামমোহনের রেনেসাঁ থেকে একাল পর্যন্ত ভারতের কারোই জানা হয়নি। কমবেশি সবারই বেকুবিপূর্ণ ধারণা হলো, ব্যাপারটা বোধ হয় বলপ্রয়োগ করেই করার বিষয়।
আমাদের অনেকের ধারণা, অবিভক্ত ভারত মানে একটা একক প্রশাসনিক এলাকা, যা ব্রিটিশেরা ১৯৪৭ সালে চলে যাওয়ার সময় একটা অংশ নেহরু-গান্ধীদের ভারত বানাতে দিয়ে যাওয়া হয় আর অপর অংশ মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলোকে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়েছে। এই ধারণা ভিত্তিহীন। ব্রিটিশ আমলের ইন্ডিয়া ছিল প্রধানত তিন ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা- তিন প্রেসিডেন্সি (বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ), ১৭টি প্রদেশ আর ৫৫০-এরও বেশি প্রিন্সলি স্টেট (করদরাজ্য)। আর এদের প্রত্যেকেই ছিল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির (সংক্ষেপে ‘কোম্পানি’) হেডকোয়ার্টারের অধীনে সরাসরি শাসনে; কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি, প্রদেশ আর প্রিন্সলি স্টেটগুলো সবাই একেকটা আলাদা সত্তা। প্রিন্সলি স্টেটগুলো আবার আরো জটিল এ কারণে যে, সেগুলোর অভ্যন্তরীণ দৈনন্দিন প্রশাসন কোম্পানির অধীনেও নয়, তৈরিও নয়। কেবল বৈদেশিক, পররাষ্ট্র, সামরিক ও বাইরের সাথে যোগাযোগ- এ বিষয়গুলোই কোম্পানির অধীনে। এসব ইস্যুতে কোম্পানি যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই ফাইনাল। তবে রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিচালনা, প্রশাসন ও রাজস্ব আদায় একচেটিয়া রাজাদের হাতে, যদিও রাজারা আদায়কৃত রাজস্বের একটা নির্দিষ্ট শেয়ার ব্রিটিশদেরকে দিতে বাধ্য। এ বিষয়ে প্রত্যেক রাজার সাথেই কোম্পানির আলাদা আলাদা চুক্তি ছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম এক শ’ বছর, অর্থাৎ ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত আমরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে ছিলাম। আর সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর থেকে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি কোম্পানির সব কর্তৃত্ব নিজে অধিগ্রহণ করেছিল, শাসন করেছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত।
তাই দেশ ভাগের সময় প্রেসিডেন্সি, প্রদেশগুলো স্বাধীন ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকে গেলেও প্রিন্সলি স্টেটগুলোর ভাগ্য নিয়ে স্পষ্ট কিছু না বলেই ব্রিটিশ সরকার বিদায় নিয়েছিল। তা করা হয়, এই ভুয়া যুক্তিতে যে, কোম্পানি বা ব্রিটিশদের সাথে প্রিন্সলি স্টেটগুলোর চুক্তিতে এমন কিছু লেখা নেই। প্রিন্সলি স্টেট মানে কোম্পানির ভারতে জেঁকে বসার আগে থেকেই অসংখ্য ছোট-বড় রাজার রাজ্য ছিল। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে অনেকগুলোকে কোম্পানি পরাস্ত করে নিজ প্রশাসনিক দখলে নেয়নি, কিন্তু কোম্পানির অধীনে করদরাজ্য করে রেখে দিয়েছিল। প্রশাসন রাজার হাতেই ছিল।
ভারতের ভাগে পড়া প্রিন্সলি স্টেটগুলোর ভাগ্য নির্ধারণে নেহরু নিজের জন্য যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন তা হলো, সব প্রিন্সলি স্টেটকে নবজাত ভারতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হবে। রাজাদের স্বেচ্ছায় হলে বলপ্রয়োগ করে নিয়ে নেয়া হবে। এবং বিনা ক্ষতিপূরণে। অর্থাৎ রাজপরিবারকে কোনো খোরপোশ বা ভাতাও দেয়া হবে না। তবে বসতভিটা বা হাভেলির নামে যা নিতে পারে, নেবে কাজটি তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুজরাটি বল্লভ ভাই প্যাটেলকে দিয়ে। পাকিস্তান প্রিন্সলি স্টেট নিয়ে এত সিরিয়াস ছিল না। এ কারণেই আমাদের পাহাড়ি রাজারা পাকিস্তান মুসলমানদের সাথেই যুক্ত হতে সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে সম্প্রতি একটা পিএইচডি গবেষণা হয়েছে, যাতে এই কারণটাই উঠে এসেছে। তা বিবিসি বাংলাতে প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই ইসলামবিদ্বেষী হয়ে বাংলাদেশের যারা কথিত প্রগতিশীলতা বা ভিকটিমহুডের ইমেজ তৈরি করে কাশ্মিরের সাথে পাহাড়ি ইস্যু মিলিয়ে তুলনা করছেন, সেটা ভিত্তিহীন। আসলে পাহাড়ি রাজারা, রাজা হিসেবে যোগ দিলেও মডার্ন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভেতরে ‘রাজাগিরি’ অকেজো, এই বাস্তবতাতেই তা শুকিয়ে গেছে। কেবল পাহাড়িদের পুরানা ‘১৯০০ সালের ম্যানুয়াল’ বলে অকেজো কিছু একটা আছে। আর জমির অনেক অংশই এখন বাঙালিদের দ্বারা বেদখল হয়ে আছে। এঘটনাগুলো কেবল ১৯৭৫ সালের পরের নতুন ঘটনা। ভারতের প্ররোচনায় পাহাড়িরা আগে-পিছে চিন্তা না করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে তাতে ফেল করার ভুল রাজনীতির পরিণতিতে এটি হয়েছে। পাহাড়িদের, যারা যে জমিতে আগে ছিল তাকে সেখানেই পুনর্বাসন করা সম্ভব, যদি তারা ইতিবাচক পথে ফিরে, সঠিক বন্ধু বাঙালি রাজনীতিকদের খুঁজে বের করে নেয়ার যোগ্য হয়।
যা হোক, নেহরু নিজ নীতি ভেঙে ‘ব্যতিক্রম’ করেছিলেন কাশ্মিরের বেলায়। কাশ্মিরের দুর্ভাগ্য যে, এটি প্রিন্সলি স্টেট। এটা না হয়ে যদি কাশ্মির সরাসরি কোম্পানির অধীনস্থ কোনো প্রদেশ থাকত? এর সোজা মানে হতো মুসলিমপ্রধান অঞ্চল বলে- কাশ্মির পাকিস্তানের অংশ হয়ে যেত। কারণ, ১৯৪৭ সালের ডেমোগ্রাফিতে দেখা যায়, পুরো জম্মু-কাশ্মিরের কাশ্মির বা উপত্যকা অংশে হিন্দু জনগোষ্ঠী নেই বললেই চলে। আর জম্মু অংশেও ৩০ শতাংশের বেশি হিন্দু জনগোষ্ঠী নেই। এটা বাদে সারা কাশ্মিরে ৯৫-৯৯ শতাংশ মুসলমান- এটাই হতো এর সপক্ষে প্রধান যুক্তি।
কিন্তু এ কাশ্মিরের পাঞ্জাবি (হিন্দু) রাজা হরি সিং ভারতের সামরিক সহায়তা চান এবং ভারতে যোগ দিতে চাওয়ার খায়েশ প্রকাশ করাতে নেহরু প্রলুব্ধ হয়ে উল্টো পথে হাঁটেন। নেহরু প্রিন্সলি স্টেট হায়দরাবাদের নিজাম (রাজা) [যিনি একমাত্র মুসলমান রাজা যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাজারে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে এর পণ্য বেচা রাজা], তাকেও নেহরু আর্মি পাঠিয়ে উৎখাত করেছিলেন। সেই নেহরু হরি সিংয়ের কথায় প্রলুব্ধ হলেন। কাশ্মিরের আর এক বৈশিষ্ট্য হলো, একটি মূল ভারতের ভেতরের কোনো প্রিন্সলি স্টেট নয়। অবস্থান ভারতের উত্তর পাশে তো বটেই, এর বড় এক অংশ পাকিস্তানেরও উত্তর সীমান্তে।
প্রিন্সলি স্টেটগুলো ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার যে প্রচলিত চুক্তির রূপ, একে বলা হয় ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’ বা ‘সংযুক্ত হওয়ার (আইনি) উপায়’। হরি সিংয়ের সাথে নেহরু যে অ্যাকসেশন চুক্তি করেন তা শর্তযুক্ত। তা ব্রিটিশের সাথে প্রিন্সলি স্টেটগুলোর চুক্তিরই অনুরূপ। এটা মূলত বৈদেশিক, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও বাইরের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয় ভারতের হাতে দিয়ে দেয়া সাপেক্ষে বাকি ইস্যুতে নিজে করদরাজা থাকা। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, নেহরু সংখ্যালঘুর সমর্থনপুষ্ট রাজা হরি সিংয়ের সাথেই শর্তযুক্ত অ্যাকসেশন চুক্তি করেছিলেন। কেন? খুবসম্ভবত, মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মির তো নেহরুর ভারতে যুক্ত হওয়ার কথাই নয়। কাজেই ‘পড়ে পাওয়া চারআনা’, এই কারণে।
কিন্তু নেহরু এমন চুক্তির বাস্তবায়ন করেননি। অর্থাৎ চুক্তি করলেও কাশ্মির নেহরুর ভারতের নয়া প্রিন্সলি স্টেট হয়ে দাঁড়ায়নি। নেহরুর হাতে এ কাজে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন কাশ্মিরের ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা শেখ আবদুল্লাহ। কাশ্মির ছিল প্রিন্সলি স্টেট মানে, রাজার রাজ্য ছিল বলে সেখানে ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনৈতিক দল জমেনি। রাজনীতি থাকলেই তা প্রজাতন্ত্র হওয়ার দিকে রওনা দেবে, যা রাজতন্ত্রের জন্য যম বা মরণকাঠি। তাই রাজার দেশে রাজা- পাল্টা ক্ষমতার চিন্তাভাবনা হিসেবে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, জমায়েত এগুলো থাকতে দেয় না। তাই শেখ আব্দুল্লাহর পিঠে হাত রেখে নেহরু তার ন্যাশনাল কংগ্রেসকে কাশ্মিরে তার কংগ্রেসের বিকল্প দল হিসেবে উঠে আসতে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। তাই চুক্তি করলেও কাশ্মির নয়া দিল্লির নয়া প্রিন্সলি স্টেট হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ, রাজার বিকল্প হিসেবে নেহরু শেখ আব্দুল্লাহকেই কাশ্মিরের প্রতিনিধি হিসেবে হাজির করে ফেলেন। তবে এটা প্রথম পর্যায়। আর রাজা মনের দুঃখে বনবাসে যাওয়ার অবস্থায়। কালক্রমে রাজা কাশ্মির থেকে দূরে পুরনো বোম্বাইয়ে বসবাস করতে থাকেন, সেখানেই ১৯৫১ সালে মারা যান। কিন্তু নেহরুর আসল দুঃখ তাতে ঘোচেনি।
সারা ভারতের যে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করেন, কাশ্মির ভারতের অংশ হলো কী করে? সবাই একবাক্যে বলবেন হরি সিং লিখে দিয়েছেন। এটা শতভাগ মিথ্যা কথা। অ্যাকসেশন চুক্তি অনুযায়ী হরি সিং নেহরুর কিন্তু ভারতকে কেবল মূলত বৈদেশিক, পররাষ্ট্র, সামরিক ও বাইরের সাথে যোগাযোগের মতো বিষয়গুলো হস্তান্তর করেছেন। এর অর্থ কাশ্মির ভারত রাষ্ট্রের ভূখণ্ড নয় বা ভারতের আইন ও কনস্টিটিউশনের অধীন নয়। এ কথাগুলোই লিখে ভারতের কনস্টিটিউশনে যে অনুচ্ছেদে আনা হয়, সেটাই ৩৭০ ধারা।
কিন্তু এরও আগে নেহরু পরিষ্কার জানতেন, কাশ্মির ভারতের অংশ নয়। কিন্তু এই দুর্বলতা কাটাতে গিয়ে তিনি আরেক ভুল করে বসেন। তিনি প্রথমে নিজেই কাশ্মির ইস্যুকে জাতিসঙ্ঘে তোলেন। এমনিতেও জাতিসঙ্ঘ এই বিবাদের ভেতরে ঢুকেই ছিল।
কাশ্মিরে এক দিকে ভারত অন্য দিকে পাকিস্তান আর্মি আর মাঝখানে জাতিসঙ্ঘের (সম্ভবত প্রথম) অবজারভার মিশন। সেকালের জাতিসঙ্ঘ মধ্যস্থতা করার জন্যই একপায়ে খাড়া থাকত।
হরি সিং শর্তযুক্ত অ্যাকসেশন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭। আর নেহরু কাশ্মির ইস্যু জাতিসঙ্ঘে তোলেন ১ জানুয়ারি ১৯৪৮। প্রথমত, নেহরুর জাতিসঙ্ঘে যাওয়াটাই প্রমাণ করে যে, কাশ্মির ভারতের নয়। এ ছাড়া হরি সিংয়ের সাথে চুক্তিটা দুর্বল, নেহরুর তা বোঝার কথা নয়। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন জাতিসঙ্ঘ তাকে ফেভার করতে পারে। কিন্তু তার অনুমান ভুল। কাশ্মির ভারতের, এমন রায় নেহরু জাতিসঙ্ঘ থেকে আনতে পারেননি। এক কথায় তিনি ব্যর্থ। কেন?
নেহরু কত দূর রিপাবলিক রাষ্ট্রচিন্তার অধিকারী ছিলেন? তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব এনজয় করতেন কী চোখে? নীতি করণীয় ঠিক করতেন কোন মানদণ্ডে? এসব বিচারে এক কথায় ছিলেন, একজন কলোনাইজার। তিনি নিজেকে একজন কলোনি শাসকের বেশি ভাবেননি। রাষ্ট্র বলতে তার ইমাজিনেশন বা বুঝ হলো এক কলোনি শাসক তিনি। তিনি মডার্ন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধারণা যাই বুঝে থাকুন না কেন, সেটা তার ব্যবহারিক রাষ্ট্রে ও প্রধানমন্ত্রিত্বে প্রতিফলিত করতে পারেননি। এটা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছিল জাতিসঙ্ঘের কাছে তার আশা-আকাক্সক্ষার মধ্যে। তিনি সম্ভবত খেয়ালই করেননি কোন বয়ানের ভিত্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিচালনাকারী ও বিজয়ীরা তা শেষ করেছিল। যুদ্ধ শেষে দুনিয়া নতুন করে সাজানো হচ্ছিল কোন মৌলিক ভাবনার ভিত্তিতে।
‘কোন রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীকে কে শাসন করবে, কিভাবে তা শাসিত হবে, তা নির্ধারণের এখতিয়ার কেবল ওই জনগোষ্ঠীর।’ রুজভেল্টের এই প্রস্তাব রাশিয়াসহ সারা ইউরোপ ভিত্তি হিসেবে মানতে রাজি হওয়াতেই রুজভেল্ট হিটলার ঠেকাতে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়েছিলেন। সবাইকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে যুদ্ধে জিতিয়েছিলেন। আর যুদ্ধ শেষের দুনিয়াটা জাতিসঙ্ঘসহ সাজানো হয়েছে একই নীতির ভিত্তিতে। যে নীতিটা বলে দিয়েছিল, কলোনি শাসন অবৈধ।
রাষ্ট্রের ক্ষমতা কে নেবে, তা নির্ধারিত করবে কেবল নিজ নিজ জনগোষ্ঠী। এই নীতিতে যদি কাশ্মির ইস্যুর ওপর প্রয়োগ করা হয়, তাহলে দেখি, হরি সিং কাশ্মিরের কেউ নন। কাশ্মিরের জনগণই ঠিক করবে কাশ্মিরের ভাগ্য কী হবে। হরি সিং কোথায় কী সই করেছেন তা মূল্যহীন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই মূল মর্ম নেহরু যদি বুঝতেন তিনি কখনই কলোনি শাসকের নকল করতেন না। তখন তিনি হরি সিং অ্যাকসেশন চুক্তিকে বাইবেল জ্ঞান করতেন না। তিনি জাতিসঙ্ঘেও যেতেন না। কারণ জাতিসঙ্ঘের জন্মই হয়েছে রুজভেল্টের ওই নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর শাসননীতিতে। তাই জাতিসঙ্ঘে গেলে, সে হরি সিংয়ের চুক্তিকে ন্যাকড়া মনে করে ফেলে দেয়ারই কথা। কাশ্মিরি জনগোষ্ঠীর গণভোটের সিদ্ধান্তেই সব কিছু নির্ধারণের ভিত্তিকে মানতে বলবে। এটা নেহরুর জানা থাকা উচিত ছিল।
নেহরু তাই জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব অমান্য করে এরপর তা নিজেই পূরণ করতে গিয়ে শেখ আবদুল্লাহকে আরো বেশি করে হরি সিংয়ের ওপরে তুললেন। আর এখান থেকে জন্ম নিল, আর্টিকেল ৩৭০। এর সারকথা হলো, অ্যাকসেশন চুক্তি যেন ভারতের কনস্টিটিউশনের বিরোধী না হয়ে যায়। আমাদের দেশী ভাষায় বললে, হালাল করে নেয়া। কিন্তু অ্যাকসেশন চুক্তি আসলেই তো ভারতীয় কনস্টিটিউশন-বিরোধী। কারণ, কাশ্মিরের মুখ্য প্রতিনিধি বলতে কাশ্মিরের জনগণকে নয়, কোথাকার এক ‘রাজা’কে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে স্বীকার করা ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোনো রিপাবলিকের চোখে কোনো রাজা এমন গুরুত্ব পেতেই পারেন না। কোনো রাজা বা রাজতন্ত্রের চিন্তাকে প্রজাতন্ত্র স্বীকার করতেই পারে না। তবু নেহরু অ্যাকসেশন চুক্তিকে হালাল করে নিতে কনস্টিটিউশনে আর্টিকেল ৩৭০ ধারা যোগ করে। ভারতের কনস্টিটিউশন যারা ড্রাফট করেছেন, এর মূল ভূমিকায় ছিলেন প্রথম আইনমন্ত্রী ড. অম্বেদকার। নেহরু তাকে অনুরোধ করেন, ৩৭০ ধারা ড্রাফট করতে। অম্বেদকার তা করতে অস্বীকার করেন।
ব্রিটিশ আমলে শাসক হিসেবে হরি সিং কাশ্মিরে এক বড় রাজত্বই চালাতেন। ফলে তার আমলারা যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। পাশে ব্রিটিশরা থাকাতে এরা ট্রেনিং পেতেন সেখান থেকে। এমনকি স্বয়ং হরি সিং স্বল্প বয়সে বাবার পরে কাকাও মারা যাওয়াতে রাজা হন। তার তাবৎ একাডেমিক শিক্ষা ও সামরিক ট্রেনিং ব্রিটিশদের হাতে হয়েছিল। রাজার মুখ্য আমলা যাকে প্রধানমন্ত্রী বলা হতো, তিনি হলেন ব্রিটিশ ট্রেইনড গোপালস্বামী আয়াঙ্গার, এক মাদ্রাজি বা তামিল ব্যক্তি। এই আয়াঙ্গার আর শেখ আবদুল্লাহ মিলে ৩৭০ ধারা ড্রাফট করেছিলেন।
এই ৩৭০ ধারা কী? আপনার লাখ টাকা আমি নিয়ে নিলাম। এরপর এই টাকা ফেরত দেয়ার সময় একটা দলিল করলাম। দলিলে লিখলাম, ১. আমি আপনাকে লাখ টাকা দিলাম। ২. আপনি এই টাকা এখন আমার ইচ্ছা আর আপনার ইচ্ছা দু’টিই মিলে গেলে, সে মোতাবেক খরচ করবেন। ৩. আপনার বাসায় কাউকে বসবাস করতে দেবেন না; আমার বাসা থেকে কেউ গেলেও না। তবে কাকে দেবেন না দেবেন, সেটি আপনাকে ঠিক করার অনুমতিটা আমিই আপনাকে দিয়ে দিলাম।
এ তিনটি ধারার প্রথম দু’টি মিলে হলো ৩৭০ ধারা, পাস হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। আর তৃতীয় ধারাটি হলো ৩৫এ, যা প্রেসিডেন্টের আদেশ হিসেবে ১৯৫৪ সালে চালু করা হয়েছিল।
তাহলে বার মোদি-অমিত কী করলেন? তারা বললেন এখন আর আপনার টাকাই আপনাকে দেয়ার দলিল না। দলিল থাকবে বাদ। খোদ আপনি পুরাটাই এখন থেকে আমার।
এটাই ‘দ্যা কনস্টিটিউশন (অ্যাপ্লিকেশন টু জম্মু ও কাশ্মির) অর্ডার ২০১৯’ এই নামে গত ৫ আগস্ট এক প্রেসিডেন্ট আদেশরূপে জারি করা হয়। এতে বলা হলো, এটাই ‘আগের ৩৫এ কে সুপারসিড’ করল। মানে আগে যা-ই থাক, এখন থেকে এটাই ওর জায়গা নিলো।
তাহলে আগে দলিলে যে লেখা ছিল ‘আমার ইচ্ছা আর আপনার ইচ্ছা দুটাই মিলে গেলে’ সেটির কী হলো? এ ছাড়া, ৩৭০ ধারা বাতিলের আগে কাশ্মিরিদের মত নেয়া হলো কিভাবে?
এর জবাবে অমিত শাহ বলছেন, কাশ্মিরি মানে তো স্থানীয় প্রাদেশিক পার্লামেন্ট। ঘটনা হলো এখন পার্লামেন্ট নেই, প্রেসিডেন্ট শাসনে আছে রাজ্যটি। প্রেসিডেন্টের ইচ্ছামতো মানেই তো কাশ্মিরিদের মতামত। তাই ওই প্রেসিডেন্টের আদেশে শুরুর বাক্যটা হলো এভাবে- আমি আমার সাথে একমত হয়ে... এই আদেশ জারি করলাম।
সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম সবাই আশা করছে কাশ্মির ইস্যুর সমাধান হলো, বন্ধু দেশ গ্রুপ ব্যক্তির সামরিকভাবে পাশে দাঁড়ানো। এই অনুমান ভিত্তিহীন। এ ছাড়া যুদ্ধে যেতে চাইলেও অন্তত ভারত-পাকিস্তান কারোই যুদ্ধে যাওয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই।
ইস্যুটি মূলত লিগাল। সেটিই মুখ্য হয়ে উঠবে। ভারতের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ ভেটো সদস্যের একজনকে যদি পেতে হয়, সেটি হতে পারে আমেরিকা। কিন্তু সেটা ইতোমধ্যে বড় ধাক্কা খেয়েছে পাকিস্তানের গলা চড়ানো পদক্ষেপে। আমেরিকা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ভারতের হাত সে যতটুকু আড়ালে ধরেছিল, সেটি ছেড়ে। ফলে পাকিস্তানের কূটনীতির একটা বিরাট ভূমিকা আছে। যতটুকু করেছে, তাতেই ভারত ইতোমধ্যে ব্যাকফুটে। ভারতের বিবৃতিগুলোতে তা পরিষ্কার।
ওই দিকে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এর বিরুদ্ধে চলে যাবে ধীরে ধীরে, যেটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। ওআইসি ধরনের আন্তর্জাতিক বডিগুলোতে ব্যাপক লবি লাগবে, কারণ আমির ও বাদশাহরা ‘পিছলে যেতে পারেন’।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জনমত শক্ত হয়ে না উঠলে মামলাটাই নেবে না, পিছলাবে। তবে ২০১৮ সালের অক্টোবরে এক মামলায়, আদালতের রায় হলোÑ ৩৭০ ধারা বাতিল করা যাবে না। ওদিকে রাজ্যগুলোও ভয় পেয়েছে। কারণ ভারত রাষ্ট্র মানে কথিত ভুতুড়ে ক্ষমতার কেন্দ্র। কে তাকে কী ক্ষমতা দিয়েছে, এই ক্ষমতার উৎস কী, কেউ জানে না। কিন্তু এই ক্ষমতা চাইলেম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কাল থেকে বিধানসভা বলে কোনো প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলি নেই- এমন ঘোষণা দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গকে একটা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করে দিতে পারে। এটাই কাশ্মির ইস্যুতে রাজ্যগুলো দেখল। এ ব্যাপারে সবচেয়ে আগে শঙ্কিত হয়েছে নাগাল্যান্ড ধরনের ট্রাইবাল ছোট রাজ্যগুলো।
নেতিবাচক দিক থেকে দেখলে, ব্যাপারটা ভুতুড়ে ক্ষমতার ভারত রাষ্ট্রের ভেঙে টুকরা হয়ে যাওয়া। আর ইতিবাচকভাবে দেখলে, এর মুরোদ থাকলে এই ভাঙাটাই পুনরায় আমেরিকার মতো এক ফেডারেল ভারতের পুনর্গঠন হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বলাই বাহুল্য, সবার আগে হিন্দুত্ব চিরতরে ত্যাগ করতে হবে এবং ফেডারেল রাষ্ট্রবিষয়ক পাঠ সম্পন্ন করতে হবে। কাশ্মির তাই আসলে বিরাট ধবংস ও পতনের ওপবনবৎম, দেখতে পাওয়া ওপরের মাথাটা কেবল! হ
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com