হোয়াইট হাউসে কঠিন পরীক্ষা
হোয়াইট হাউসে কঠিন পরীক্ষা - ছবি : সংগৃহীত
ওয়াশিংটন ডিসি। পোটোম্যাক নদীর কোল ঘেঁষে এই শহরের জনসংখ্যা মাত্র ৬ লাখ। আর আমাদের ঢাকার লোকসংখ্যা দেড় না দুই কোটি! নিঃস্তব্ধ গোটা ওয়াশিংটন ডিসি বিশালাকার রাস্তা আর বড় বড় দালান-কোঠা দিয়ে সুসজ্জিত। তবে কোনটিই খুব উঁচু নয়। প্রতিটি ভবনের সঙ্গে মিশে রয়েছে মার্কিনিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আমেরিকার অন্য সব বড় বড় শহরে ভবনগুলো বেড়ে উঠেছে উপরের দিকে। কিন্তু এই ওয়াশিংটন ডিসির ভবনগুলো বেড়েছে প্রস্থে। অত্যন্ত রুচিশীল আর আধুনিক নির্মাণশৈলীর দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাগুলোই বলে দেয়, এই শহর বিশেষ একটা কিছু। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকার প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নামে একটি করে অ্যাভিনিউ বা বড় রাস্তা রয়েছে। পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউ তেমনই একটি। এই রাস্তার পাশে ১৬০০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ছ’তলা বাড়িটিই হোয়াইট হাউস বা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ।
ইতিহাস বলে, ১৮১২ সালে শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ড-আমেরিকা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলাকালীন ১৮১৪’র ২৪ আগস্ট ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হোয়াইট হাউস দখল করে নেয়। সেই সময় তারা গোটা ভবন আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধ থামলে নকশাকার জেমস হোবানের পরামর্শ নিয়ে আমেরিকানরা ফের সেই আগুনে পোড়া ভবনের সংস্কার কাজ শুরু করে। ভবনটির বিভিন্ন জায়গায় আগুন ও ধোঁয়ার দাগ ঢাকতে এর দেওয়ালে সাদা রং করা হয়। সেই থেকে মূলত এটি ‘হোয়াইট হাউস’ হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। যদিও এই নামের স্বীকৃতি পেতে সময় লাগে আরো ৮৫ বছর। ১৯০২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিয়েডোর রুজভেল্ট এই নামের স্বীকৃতি দেন। তখন থেকে সরকারিভাবে এর নামকরণ করা হয় ‘হোয়াইট হাউস’। অনেকেই বলেন ‘মিউজিয়াম অব আমেরিকান হিস্ট্রি’। এটি এমন একটি জায়গা, যেখান থেকে নিয়মিতই বিশ্ব ইতিহাসের নিত্য-নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। ইতিহাসকে টিকিয়ে রাখারও অদ্ভুত মানসিকতা জড়িয়ে রয়েছে গোটা ভবনকে ঘিরেই।
খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনের অন্দরের বহু কথা। এই সেই হোয়াইট হাউস, যেখানে রয়েছে মোট ১৩২টি আবাসিক কক্ষ এবং ৩৫টি বাথরুম। হোয়াইট হাউসে ১৬টি পরিবারের থাকার আয়োজন রয়েছে। রান্নাঘরেরও রয়েছে নানা ভাগ। একটি মূল রান্নাঘর, একটি ডায়েট কিচেন ও অন্যটি পারিবারিক রান্নাঘর। এ ছাড়া আছে ৪১২টি দরজা এবং ১৪৭টি জানালা। বিভিন্ন তলায় ওঠানামার জন্য আছে ৮টি সিঁড়ি এবং ৩টি লিফট। রয়েছে ২৮টি ফায়ারপ্লেস। এখানে কাজ করেন ১৭ হাজার কর্মী। সম্পূর্ণ সাদা রঙের ভবনটি নিয়মিতভাবেই রং করা হয়। প্রতিবার রং করতে প্রয়োজন হয় ৫৭০ গ্যালন পেন্ট। হোয়াইট হাউসের রান্নাঘর থেকে প্রতিদিন ১৪০ জন থেকে শুরু করে প্রয়োজনে ১ হাজার মানুষের খাবার সরবরাহ করা সম্ভব। প্রতি সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে ৩০ হাজারের বেশি দর্শনার্থী আসেন। এই ভবনের ঠিকানায় আসে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৬৫ হাজার চিঠি, প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ফোনকল, ১ লাখ ই-মেইল এবং ১ হাজার ফ্যাক্স।
এখানে সবই চলে ঘড়ির কাঁটা মেপে। হোয়াইট হাউসের ক্ষমতার পালাবদলে প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের হোয়াইট হাউস ছাড়তে নাকি সময় লাগে মাত্র ৬ ঘণ্টা। ৯৩ জন কর্মী মালপত্র গুটিয়ে নিতে সাহায্য করেন। সবই সময়ের হিসেব কষে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য এই ভবনে অপেক্ষা করে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ। ২০০০ সালে সামান্য ব্যবধানে জিতে রিপাবলিকান পার্টির জর্জ ডব্লু বুশ হোয়াইট হাউসে ঢুকেই নাকি রীতিমতো ভিরমি খেয়ে গিয়েছিলেন। পুরো হোয়াইট হাউসের ভিতরে তখন নানা ধরনের ফাঁদ পাতা রয়েছে। পা বাড়ালেই বোকার মতো ফেঁসে যেতে হবে। অভিযোগের তীর ছিল ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্টাফদের দিকেই। হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাওয়ার আগে এই কাণ্ড করে গিয়েছেন তারা। হোয়াইট হাউসে পুরুষদের বাথরুমে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, কারা যেন দেয়ালে নানা ধরনের কথা লিখে রেখে গিয়েছেন। আক্রমণাত্মক এবং অশ্লীল। অফিসের ডেস্কগুলোরও বেহাল দশা। তৈলাক্ত এবং আঠালো কিছু একটা জিনিস ঢেলে সব নষ্ট করে রেখে গেছে। বাদ যায়নি টেলিফোনের অ্যানসারিং মেশিনও। সেখানেও রেকর্ড করে রাখা হয়েছে অশ্লীল বার্তা। হয়রানির এখানেই শেষ নয়। বেশ কিছু কম্পিউটারের কিবোর্ড থেকে ডব্লু অক্ষরটা খুলে নেয়া হয়েছে। যেগুলোতে ডব্লু অক্ষরটি ছিল, ওটাকে চেপে উল্টো করে আটকে দেওয়া হয়েছে। শুধু জর্জ ডব্লু বুশই নন, একসময় হোয়াইট হাউসে প্রথম প্রথম সব প্রেসিডেন্টকেই নাকি এই ধরনের হয়রানির মধ্যে পড়তে হতো।
‘হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং এমনই একটা জায়গা যে, এর ভিতর ঢুকলে আপনার গায়ে কাঁটা দেবে। এর ইতিহাস এক অন্যরকম অনুভুতি। আপনি উপলব্ধি করবেন যে, আপনি আমেরিকার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে এমন একটা কাজ করছেন।’ এক সাক্ষাৎকারে বিবিসির সাংবাদিক রেবেকা কেসবিকে বলেছিলেন সিনেটর টেড কফম্যান। বলেছিলেন, ‘আমাদের একটা বিশাল আমলাতন্ত্র আছে। কিন্তু এর সর্বোচ্চ স্তরে ফেডারেল সরকারের যে ২ হাজার পদ আছে। একজন নতুন প্রেসিডেন্ট এসেই এতে পরিবর্তন আনেন। এটা অনেকটা একটা বিরাট কর্পোরেশনের মতো।
যেমন ধরুন, আপনি জেনারেল মোটর্সের নতুন সিইও হিসেবে যখন অফিসে ঢুকছেন, ঠিক তখনই কিন্তু কাজ ছেড়ে দিয়ে প্রায় দু’হাজার ম্যানেজার পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাই আপনাকে নতুন দু’হাজার ম্যানেজার নিয়োগও করতে হবে। আবার এর মধ্যেই আপনাকে প্রতিষ্ঠানটি চালাতে হবে। নতুন গাড়ি বানাতে হবে। বিক্রি করতে হবে। বিজ্ঞাপন দিতে হবে। সব কাজই করতে হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশের দৃঢ় অঙ্গীকার ছিল, যেন ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে হয়। যেন তিনি নিজে যখন হোয়াইট হাউসে ঢুকেছিলেন সেই সময়টার মতো না হয়।’ আসলে এই হোয়াইট হাউস সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের অফিস বলে কথা!