এক কোটি আফগানকে হত্যা করেও যে কারণে জয় পাওয়া গেল না
এক কোটি আফগানকে হত্যা করেও যে কারণে জয় পাওয়া গেল না - ছবি : সংগ্রহ
‘আমরা পুলিশ সদস্যের মতো। আমরা কোনো যুদ্ধ করছি না। আমরা যদি আফগানিস্তানে কোনো যুদ্ধ করতে চাই এবং তাতে জয়ী হতে চাই, তবে আমরা ওই যুদ্ধ এক সপ্তাহে জয়ী হতে পারি। কিন্তু আমি এক কোটি লোককে হত্যা করতে চাই না। পৃথিবীর বুক থেকে আফগানিস্তান নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। আমি সেই পথে যেতে চাই না।’
এইমাত্র যা পাঠ করা হলো, তা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত কথাগুলো জোরালোভাবে ঘোষণা করছেন: ১. আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে না যুক্তরাষ্ট্র; ২. যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধ করতে চায়, তবে প্রেসিডেন্ট তা এক সপ্তাহের মধ্যে জয় করতে পারবেন; ৩. তিনি এক কোটি লোককে হত্যা করতে পারেন, যদিও তা করতে চান না; ৪. কোনো অর্থপূর্ণ উদ্দেশ্যে ছাড়াই সার্বিকভাবে আফগানিস্তানকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা যায়।
ট্রাম্প এসব কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাশে বসে। আর চতুর পদক্ষেপে ইমরান হোয়াইট হাউসকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন যদিও তিনি সতর্কভাবে রাশিয়া, চীন ও ইরানের সাথে পাকিস্তানকে ইউরেশিয়ায় দিকে এগিয়ে নিতে চান।
ট্রাম্প আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করছে না বলার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অবশ্য টিম ট্রাম্প এ দিয়ে সিআইএ বসকে লক্ষ্য করে কিছু বললেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।
ট্রাম্প তার ঘৃণিত পূর্বসূরী বারাক ওবামাকেও কিছু বললেন কিনা তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে। ওমাবা হয়তো এক কোটি লোককে হত্যা করেননি, তবে তার কমান্ডে থাকা বাহিনী অসংখ্য বেসামরিক লোকসহ বিপুলসংখ্যক আফগানকে হত্যা করেছে। কিন্তু তবুও ওবামা এক সপ্তাহ তো নয়ই, কখনেই জয়ী হতে পারেননি।
বারাক ওবামা আফগানিস্তান যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ধারণা পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আফগান যুদ্ধ একটি মহান ক্রুসেড এবং তিনি ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা কাজের সময় সবসময় এটি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ বলে উল্লেখ করতেন।
ওবামা মানবিক সাম্রাজ্যবাদের যুক্তিতে আফগানিস্তানে মার্কিন শক্তি বৃদ্ধিকে সমর্থন করতেন। তিনি বলতেন, আফগান জনগণের জন্য তালেবান শাসনের প্রত্যাবর্তন হবে তাদের দেশকে নৃশংস শাসনে ফেলে দেয়া, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দেয়া, অর্থনীতিকে স্থবির করে দেয়া, আফগান লোকজন বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের জন্য মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করা। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানায়।
কিন্তু কাবুলে আমরা একটি সমস্যার দেখা পাই। চেনির আমলে বোমা আর হামলা চালানো সত্ত্বেও আফগানিস্তানে কখনোই ‘সঠিক’ বা ‘ন্যায়সঙ্গত’ যুদ্ধ ছিল না। ৯/১১-এর সাথে তালেবানের কোনো ধরনের বাস্তব যোগসূত্র ছিল না। ৯/১১-এর ষড়যন্ত্রে ও অর্থায়নে জড়িত ছিল সৌদিরা, আর জার্মান, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন মহল। আমেরিকায় মোল্লা ওমর কখনো কোনো সন্ত্রাসীকে পাঠাননি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কান্দাহারে তালেবান নেতৃত্ব মস্কোর মধ্যস্ততায় ওসামা বিন লাদেনকে (৯/১১-এর ঘোষিত অপরাধী, টুইন টাওয়ারের পতনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছিল) এমনকি কোনো তদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছিল। চেনি জান্তা তালেবান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি এরপর তালেবান পক্ষ কোনো মুসলিম দেশে ওসামার বিচার করার প্রস্তাবও চেনিরা প্রত্যাখ্যান করে। চেনিরা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই তার প্রত্যাবর্তন চেয়েছিল।
এগিয়ে আসে এসসিও
পুতুল হামিদ কারজাই কাবুলে সবেমাত্র দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। আর নিউকনরা ইরাকের আসল টার্গেটের দিকে নজর দিকে আফগানিস্তানের দখলদারিত্ব ন্যাটোর হাতে হস্তান্তর করে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ৯/১১ ঘটারও আগে, জুলাই মাসে জেনোয়ায় অনুষ্ঠিত জি৮-এ। ওই সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায় যে অক্টোবর নাগাদ আফগানিস্তানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে ওয়াশিংটন। রাশিয়া ও চীনাদের ওপর নজরদারি চালানোর জন্য মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে একটি জায়গার খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল চেনিদের। তাছাড়া মধ্য এশিয়ার বিপুল গ্যাস সম্পদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্যও আফগানিস্তান তাদের জরুরি প্রয়োজন ছিল।
হিন্দুকুশের জঘন্যভাবে বদলানোর ইতিহাস কাজ করে অন্যভাবে। তালেবান ২০১০-এর দশক থেকে তাদের শক্তি বাড়াতে বাড়াতে বর্তমানে দেশের অর্ধেকের মতো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
এমনকি জেনারেল ভেডিড পেট্রাউস পর্যন্ত জানতেন যে আফগান যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। আর অপদস্থ জেনারেল স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টাল অন্তত স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন যে আমরা আশ্চর্যজনকভাবে অনেক লোককে হত্যা করেছি এবং আমার জানা মতে, তারা সত্যিকারের হুমকি ছিল না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অত্যাধুনিক মার্কিন সামরিক যুদ্ধসম্ভার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে, বিয়ের অনুষ্ঠানে পর্যন্ত হামলা চালাচ্ছে।
মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস যারা জানেন, তারা বুঝতে পারেন যে আফগানিস্তান থেকে কখনো প্রত্যাহার করা হবে না মার্কিনিদের। বাগরাম বিমান ঘাঁটিটি রাশিয়া-চীন কৌশলগত অংশীদারিত্বের ওপর নজরদারির জন্য অমূল্য একটি সম্পদ। ট্রাম্প হয়তো অনেক কথাই বলতে পারেন, সেগুলো শেষ পর্যন্ত কথার কথাই থেকে যাবে।
আফগানিস্তানের একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) মাধ্যমে কিছু একটা করা। এই সংস্থার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে রাশিয়া ও চীন। আর ভারত ও পাকিস্তান এর পূর্ণ সদস্য, ইরান ও আফগানিস্তান এর পর্যবেক্ষক। তা করা হলে আফগানিস্তান পুরোপুরি একীভূত হয়ে যাবে নতুন সিল্ক রোড বা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হবে, সেইসাথে ইরানি বন্দর চাবাহার থেকে শুরু হওয়া আফগানিস্তান থেকে মধ্য এশিয়াগামী ভারতীয় মিনি-সিল্ক রোডের অংশে পরিণত হবে।
এটিই চায় বেশির ভাগ ইউরেশিয়ার প্র্রধান শক্তি। আর এভাবেই আপনি যুদ্ধে ‘জয়ী’ হতে পারেন। আর এভাবেই আপনাকে এক কোটি লোককে হত্যা করার দরকার হবে না।