রিফাত হত্যা : মিন্নিকে নিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি
রিফাত হত্যা - ছবি : সংগৃহীত
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি বনে যাওয়া নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন আবেদন আবারো নামঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো: আসাদুজ্জামান জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। মিন্নির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গত ২২ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রথমবার মিন্নির জামিনের আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মো: মাহবুবুল বারী আসলাম। পরে ওই দিনই শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
এরপর গত ২৩ জুলাই মিস কেস দাখিল করে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো: আসাদুজ্জামানের আদালতে ফের জামিনের আবেদন করেন মিন্নির আইনজীবী। পরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নথি তলব করে গতকাল এ জামিন শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত। বেলা ১১টার দিকে মিন্নির জামিনের শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে তার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট মো: মাহবুবুল বারী আসলামসহ ২০ আইনজীবী।
এক মাসে এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১৫ জন আসামির সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এর মধ্যে এজাহারনামীয় সাতজন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার হওয়া আটজন রয়েছেন। এখনো পলাতক আছে মুসা, মোহাইমানুল ইসলাম সিফাত, আবু আব্দুল্লাহ রায়হান ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার নামে এজাহারের চার আসামি।
রিফাত হত্যা মামলা সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পিবিআই অথবা সিআইডিতে হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। অন্যদিকে তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে মিন্নির বাবা এ দাবি করেছেন বলে জানান, হত্যা মামলার বাদি এবং নিহতের বাবা দুলাল শরীফ। পুলিশের তদন্তেই অগাধ আস্থা দেখিয়ে তিনি অন্য কোনো সংস্থাকে মামলার তদন্তভার না দেয়ার দাবি জানান।
এদিকে মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন বরগুনা জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তবে এ তদন্তে এখনো অনেক রহস্যের জবাব মেলেনি, বরং তদন্ত নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। মামলায় সাক্ষী করা হয়নি হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী দুইজনকে। যাদের সাক্ষী করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রিফাতের স্ত্রী মিন্নি ছাড়া কেউ ঘটনাস্থলে ছিলই না। ঘটনার আগে দুই আসামির সাথে ষড়যন্ত্র করে মিন্নি দ্বিতীয় দফায় ফোনে রিফাতকে কলেজে ডেকে এনেছেন বলে পুলিশ যে দাবি করেছে, তার প্রমাণ পাননি বাদী। মিন্নির সাথে নয়নের কয়েকটি মোবাইল ফোনে কথা হতো বলে পুলিশ দাবি করলেও একটি মোবাইল ফোনও মিন্নির নয় বলে জানা যায়। কখন, কোথায় এই ফোনালাপ হলো সে ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছে মিন্নির পরিবার। এসব ফোন নম্বর নয়ন ও তার মায়ের নামে নিবন্ধন করা বলে জানা যায়।
অপর দিকে প্রথম যে ভিডিও ফুটেজটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, সেটি কার মোবাইল ফোন থেকে ধারণ করা এবং কে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। মামলায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এসব প্রশ্নের জবাব না খুঁজে তড়িঘড়ি করে অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে পুলিশ এমন অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মোবাইল ফোনে নয়নের সাথে মিন্নির কথিত যোগাযোগের প্রমাণসহ ২০ ধরনের আলামত হাজির করে হত্যাকাণ্ডে মিন্নির সম্পৃক্ততা প্রমাণে পুলিশ ব্যস্ত বলে জানিয়েছে মিন্নির পরিবার। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া মুসাসহ এজাহারনামীয় চার আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন।
রিফাত হত্যা মামলার এজাহারে ১০ সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মিন্নি ছাড়াও রিফাতের দুই চাচা ও মঞ্জুরুল আলম জনসহ আরো ৯ জনের নাম আছে, যারা কেউ ঘটনাস্থলে ছিল না। তাদের বেশির ভাগের বাড়ি লবণগোলা গ্রামে। রিফাতের বাড়িও ওই গ্রামে। দ্বিতীয় দফায় রিফাত মোটরসাইকেলে করে যখন ঘটনাস্থলে আসেন, তখন তার পেছনে বসা ছিলেন এক যুবক। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ওই যুবক নেমে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রিফাতের ওপর হামলা হয়।
এ বিষয়ে রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, রিফাতের মোটরসাইকেলের পেছনে যে ব্যক্তি বসা ছিলেন তার নাম মনির। বরগুনা সদর বাজারের পৌর মার্কেটে মুদি-মনিহারি পণ্যের দোকান আছে তার। তিনি কলেজ রোডে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য রিফাতের মোটরসাইকেলে করে আসেন। রিফাত কলেজের সামনে তাকে নামিয়ে দেয়ার পর রিকশায় করে চলে যাচ্ছিলেন মনির। ওই সময়ই তিনি রিফাতের ওপর হামলার ঘটনা দেখেন।
অন্যদিকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, মিন্নির সাথে এক তরুণ পাশ থেকে হামলাকারীদের থামানোর চেষ্টা করেন। নুরুল ইসলাম রনি নামের এ তরুণ বরগুনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ও জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। রনি বলেন, আমি বাসা থেকে বাজারে যাচ্ছিলাম। আমার সামনেই ওরা রিফাতকে ধরে নিয়ে মারতে থাকে। মিন্নি পেছন পেছন ছুটে গিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমি দেখলাম ছেলেটাকে কুপিয়ে মেরে ফেলতেছে। আমি তখন ভয় না পেয়ে কাছে গিয়ে থামানোর চেষ্টা করি। আমি বাড়ি থেকে কলেজে আসার পথে রিফাতের ওপর হামলা হতে দেখে তাদের থামাতে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। হয়তো আমার সাথে দুই-একজন থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে রনি বলেন, পাঁচ-ছয় দিন আগে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আমার বক্তব্য শুনেছেন। তবে আদালতে বা কোথাও জবানবন্দী দিইনি।
বরগুনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভেতর নিজস্ব সিসি ক্যামেরা থাকলেও তাতে হামলা ঘটনার দৃশ্য ধরা পড়েনি। কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ঘটনার কয়েক দিন আগে সিসি ক্যামেরার মনিটর নষ্ট হয়ে গেছে। আসামিদের জবানবন্দীর পাশাপাশি মোবাইল ফোনের কললিস্ট, ধারালো অস্ত্র, মোবাইল ফোনসেট, কল রেকর্ডসহ ২০ ধরনের আলামত পরীক্ষার জন্য জব্দ করা হয়েছে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, যার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। সব আসামি আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। মামলার তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে।
মিন্নির আইনজীবী ও বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, আসামির যতই জবানবন্দী থাকুক না কেন, প্রত্যেক সাক্ষীর জবানবন্দী মামলায় গুরুত্বপূর্ণ। এটি আলোচিত মামলা, তাই এর তদন্তে সব প্রশ্নের উত্তর থাকা দরকার।