প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন
প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন - ছবি : সংগ্রহ
আলোচনার সুবিধার জন্য গোটা প্রাণি জগৎকে প্রাণী বিজ্ঞানীরা কতগুলো পর্বে বা ফাইলাতে (Phyla ভাগ করে আলোচনা করেন। এদের মধ্যে একটি পর্ব বা ফাইলাকে বলা হয় সিলেন্টেরাটা (COELENTERATA)। যাদের বলে প্রবাল, তারা হলো এই পর্বভুক্ত প্রাণী। এদের শরীর নালিকাকৃতির। এদের নালিকাকৃতি দেহের মধ্য দিয়ে যখন সমুদ্রের পানি যায়, তখন সেই পানির মধ্যে অবস্থিত ছোট ছোট প্রাণীকে এরা আহার্য হিসাবে গ্রহণ করে। এদের শরীর থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নির্গত হয়, যা থেকে গড়ে ওঠে চুনাপাথর।
এ রকম চুনাপাথর জমে গড়ে ওঠে, যাকে বলে প্রবালদ্বীপ। আমাদের দেশে যে দ্বীপটিকে বলা হয় সেন্টমার্টিন, সেখানে প্রবাল পাথর আছে। কিন্তু দ্বীপটি যে আগাগোড়ায় প্রবাল প্রাণীদের দেহক্ষরিত চুনাপাথর দিয়ে গড়ে উঠছে, তা কিন্তু নয়। এখানে সাধারণ মাটিও আছে। এ ছাড়াও টেকনাফ অঞ্চলের মাটিতে পাওয়া যায় এ ধরনের পাথরের টুকরা। দ্বীপটিতে মিঠাপানির মাছও পাওয়া যায়। তাই ধরে নেয়া যায়, দ্বীপটি ছিল একসময় টেকনাফ অঞ্চলের সাথে যুক্ত। পরে তা কোনো বিশেষ কারণে টেকনাফ অঞ্চল থেকে বিযুক্ত হয়ে একটা ছোট দ্বীপে পরিণত হয়ে পড়েছে, যা আগে ছিল না। এখানে প্রবাল পাথর তৈরির মতো যথেষ্ট সিলেন্টেরাটা আছে। কিন্তু তাই বলে যে দ্বীপটা কেবল তাদের ক্ষরিত চুনাপাথরের দিয়ে গড়ে উঠেছে, তা নয়। অন্তত আমার কাছে তা মনে হয় না। যদিও সব পাঠ্যপুস্তকে লেখা হয়, সেন্টমার্টিন দ্বীপটি একটি প্রবালদ্বীপ। কিন্তু ঠিক প্রবালদ্বীপের সংজ্ঞায় এই দ্বীপটি পড়ে না। এই দ্বীপটির আয়তন ১২ বর্গ কিলোমিটার।
দ্বীপটিতে বর্তমানে সরকার বিজিবি মোতায়েন করেছেন। কেননা, দ্বীপটির ওপর স্বত্ব দাবি করছে মিয়ানমার। বাংলাদেশ এই দাবি অস্বীকার করলেও মিয়ানমার যে সেটি মেনে নিয়েছে, এ রকম মনে হচ্ছে না। এর আগে সমুদ্রসীমা নিরূপণের জন্য আমাদের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছিলেন। তখন নাকি মিয়ানমার যে সমুদ্রসীমা মেনে নিয়েছিল, এখন নাকি চাচ্ছে না তা আর মানতে। বিষয়টি আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে জটিল। কেননা, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মিয়ানমার যেভাবে ব্যাখ্যা করছে, আমরা সেভাবে করছি না। অর্থাৎ অন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের ব্যাখ্যা নিয়ে আবার হতে পারে মামলা। আমাদের সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিজিবি মোতায়েন না করে আমার মনে হয় সৈন্য মোতায়েন করা ছিল অনেক উত্তম কাজ। আমাদের সাথে মিয়ানমারের যুদ্ধ হওয়া অসম্ভব নয়। কেননা, চীন পক্ষ নিচ্ছে মিয়ানমারের। মিয়ানমারের পক্ষ নিচ্ছে রাশিয়া। ভারতের মনোভাবও এ ক্ষেত্রে আমাদের অনুকূল নয়।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে আমাদের আন্তÍর্জাতিক নীতিনির্ধারণ। আমরা শান্তি চাইলেই যে অন্যরা শান্তি চাইবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা বড় বেশি শান্তিবাদী হয়ে উঠছি। এই শান্তিবাদ আমাদের জাতি হিসাবে ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এত দিন ভেবেছি, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি কেবল ভারত থেকে। কিন্তু এখন মিয়ানমার থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, চীন আমাদের ওপর চাপ ফেলার কথা ভাবতে পারছে মিয়ানমারের মাধ্যমে। সে তার উনান প্রদেশ থেকে রাস্তা বানাবার কথা ভাবতে পারছে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। আর সে জন্য চীন দাবি করছে বাংলাদেশেরও কিছু জায়গা। কয়েক মাস আগে মিয়ানমারের সৈন্যরা সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভারী অস্ত্রের সাহায্যে গুলিগোলা চালিয়েছিল। বাংলাদেশ যার প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার এই প্রতিবাদের কোনো জবাব দিয়েছিল না। আমরা অবশ্য এসব কথা বলছি ওই অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে শুনে। মনে হচ্ছে আমাদের বর্তমান সরকার যেন চাচ্ছে এসব কথা চেপেই যেতে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার আগের মতো আর জনসমর্থিত নয়। মিয়ানমার বাংলাদেশ সরকারের দুর্বলতাকে উপলব্ধি করতে পারছে বলেই মনে হয়। যা হোক, সেন্টমার্টিনে বিজিবি মোতায়েনকে আমরা দেশের স্বার্থে সমর্থনীয় বলে মনে করি। প্রয়োজনে অবশ্যই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করতে হবে অস্ত্র ধারণ।
আমাদের দেশে যেসব ভূগোল বই প্রচলিত, সেগুলো যথেষ্ট অনুসন্ধানমূলক নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ সম্পর্কে দেশের ভূগোলবিদেরা কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। আমি ভূগোলের লোক নই। স্কুলজীবনে কিছু ভূগোল পড়েছিলাম। আর সেখানেই পড়েছিলাম রবার্ট চার্স ডারউইনের প্রবালদ্বীপ সম্পর্কিত তত্ত্ব। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত ২৮১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৩ কিলোমিটার হলো পানি-সীমানা। এই পানি-সীমানায় বিজিবি কিভাবে লড়াই করবে, সেটি আমরা জানি না। কেননা, তারা কেবল ডাঙ্গাতেই লড়াই করতে পারে।
একসময় ব্রিটিশ শাসনামলে মিয়ানমারের সাথে আমাদের ছিল যথেষ্ট হৃর্দিক সম্পর্ক। মিয়ানমার থেকে বর্মিরা আসতেন রংপুরের ভূতছাড়া নামক স্থানে তামাক কিনতে। যা দিয়ে তারা বানাতেন বিখ্যাত বর্মি চুরুট। বাংলাদেশ চালের জন্য নির্ভর করেছে বর্মার ওপর। ১৯৪২ সালে জাপান দখল করে বর্মা। যতগুলো কারণে ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, তার মধ্যে একটি হলো জাপান বর্মাকে দখল করার ফলে বর্মা থেকে বাংলাদেশে চাল আসতে না পারা। শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ ধানের জন্য তখনকার বাংলাদেশকে ব্রহ্মদেশের (বর্মা) মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। ব্রহ্মদেশ থেকে বাংলাদেশে ধান আসতে না পারাতে বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। তবে বর্তমানে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলছেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল, লোকের কর্মসংস্থান না থাকা।
যেহেতু তাদের হাতে ক্রয়ক্ষমতা ছিল না, তাই তারা পড়েছিলেন দুর্ভিক্ষের মুখে। বর্মা থেকে চাল আসতে না পারাটা দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল না। যা হোক, মিয়ানমারে এখনো বহু জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। কারণ, আবাদ করার মতো যথেষ্ট কৃষক নেই। তারা যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ না করে তার জমি আমাদের বরগা দিত, তবে আমরা খাদ্যে সহজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারতাম। আর মিয়ানমারও উৎপাদিত চাল বিশ্বের বাজারে বিক্রি করে যথেষ্ট লাভবান হতে পারত। তাই মিয়ানমারের সাথে আমাদের মনোমালিন্য হওয়া উচিত নয়। মিয়ানমারকে আমরা যথেষ্ট শ্রমশক্তি দিতে পারি। যারা পালন করতে পারে মিয়ানমারের আর্থিক উন্নয়নে যথেষ্ট মূল্যবান ভূমিকা। আমরা উভয় দেশের স্বার্থেই বিষয়টি নিয়ে করতে পারি চিন্তাভাবনা।
বাংলাদেশের কৃষক ধান উৎপাদনে খুবই পারঙ্গম। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করে চীন। তারপর ভারত। এরপর জাপান। এরপর বাংলাদেশ। বাংলাদেশ, চীন-ভারতের মতো বিরাট দেশ নয়। বাংলাদেশের কৃষকেরা ধান উৎপাদনে যথেষ্ট সার দিতে পারেন না। কিন্তু তথাপি বাংলাদেশের গরিব কৃষকদের ধান উৎপাদনে রয়েছে বিশেষ কৃতিত্ব। মিয়ানমার যদি ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের কৃষকের সহায়তা গ্রহণে উদ্যোগী হয়, তবে সে যথেষ্ট লাভবান হতে পারবে বলেই মনে করা যায়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট