ফিলিস্তিন : স্যালভেশন অব দ্য সেঞ্চুরি
ফিলিস্তিন : স্যালভেশন অব দ্য সেঞ্চুরি - ছবি : সংগ্রহ
অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আরব সরকারগুলো শত বছর ধরে ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুর অত্যাচার-নিপীড়নের অবসানকল্পে একটি নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই পরিকল্পনার আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে, সেই অস্থিতিশীলতার অবসান ঘটানো, যা বেলফোর ঘোষণার পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। এই পরিকল্পনা ঘোষণাকারী আরব সরকারগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে সেইসব আরব দেশ, যেগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। নতুন এই পরিকল্পনা অভিহিত হচ্ছে ‘দ্য সেলভেশন অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে।
এই পরিকল্পনার প্রতি গোপন সমর্থন রয়েছে তিনটি শীর্ষ সম্মেলনের। এ তিনটি শীর্ষ সম্মেলনের নেতাদের এক বৈঠক গত ৩০ মে অনুষ্ঠিত হয় জেদ্দায়। এই বৈঠকে জিসিসি (গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল), আরব লিগ, ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন) নেতারা তাদের দেশগুলোর ভবিষ্যৎ এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শতবর্ষব্যাপী দুর্ভোগের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানেই মূলত এই পরিকল্পনার সূচনা ঘটে।
এই পরিকল্পনার দু’টি অংশ : অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (ইকোনমিক প্লান) এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনা (পলিটিক্যাল প্লান)। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিষয়গুলো এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক পরিকল্পনা এখানো বলা যায় অজানাই রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনাটি প্রকাশ করা হয় জ্যারেট কুশনারের ফিলিস্তিন সম্পর্কিত প্রবল বিতর্কিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র ব্যাপারে গত জুনের শেষ সপ্তাহে বাহরাইনে অনুষ্ঠিত তার এ ডিলবিষয়ক প্রমোশন ওয়ার্কশপের আগে।
ইকোনমিক প্লানে বলা আছে : প্রথম কিস্তি হিসেবে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের একটি তহবিল বরাদ্দ করতে হবে নি¤œরূপে :
একটি জেনারাস ফান্ড সৃষ্টি করতে হবে ১০ লাখ রুশ ইহুদি ও কৃত্রিমকল্প-ইহুদি (জিওডো-জিউস) অর্থনৈতিক প্রত্যাবাসীকে সে দেশে ফেরত পাঠিয়ে পুনর্বাসনের জন্য। এরা ২০ বছর আগে ফিলিস্তিনে এসেছিল, এদের ফেরত পাঠাতে হবে। এটি উপলব্ধি করা যায়, প্রেসিডেন্ট পুতিন এই পদক্ষেপকে স্বগত জানিয়েছেন- তবে শর্ত হচ্ছে, এর জন্য প্রণোদনা তহবিল বাড়াতে হবে।
১৭ লাখ ডলারের একটি প্রণোদনা ও কল্যাণ তহবিল সৃষ্টি করতে হবে, যাতে আরব ইহুদিরা আরব দেশগুলোতে তাদের ব্যবসায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে, যেখানে তারা আগে বসবাস করত। একই সাথে এরা যেন সেসব দেশে পুনরায় তাদের ব্যবসায়িক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে। তিউনিস ও মরক্কোর ইহুদি মন্ত্রীরা এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে। মরক্কোর কিং ষষ্ঠ মোহাম্মদ একটি ডিক্রি জারি করেছেন, দেশে ফিরে আসা মরক্কোর ইহুদিরা দেশে ফিরে এলে তাদের পাঁচ বছরের জন্য কর মওকুফের সুযোগ দেয়া হবে। ইরাকি প্রধানমন্ত্রী বাগদাদে ইহুদি কোয়ার্টারগুলো পুনর্গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছেন বর্তমানে কুর্দিস্তানে যেসব ইহুদির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো বাগদাদে স্থানান্তরের জন্য। মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি কায়রো বিমানবন্দরে একটি অভ্যর্থনা তাঁবু নির্মাণ করেছেন। এতে রয়েছে একটি ব্যান্ডবাদক দল এবং দেশে ফিরে আসা ইহুদিদের ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে একটি ব্যাংক কমিটি।
যেসব আশকেনাজি ইহুদি তিন মাসের মধ্যে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যাবে, তাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতিসঙ্ঘ ও আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা অনুসমর্থন করবে। যারা ফিলিস্তিনে থেকে যাবে, তারা থেকে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তবে তাদের মামলাগুলো বিচারের জন্য আইসিসিতে উপস্থাপিত হবে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত সব গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ এককভাবে শুরু করবে ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তহবিলগুলোর অর্থ আসবে ইসরাইলের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে, শোষণের জন্য এবং ফিলিস্তিনিদের ব্যবসায়ের সম্পদ, অবকাঠামো ও ভূমি ৭০ বছর ধরে ব্যবহারের জন্য। এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে জাতিসঙ্ঘের ৭২/৭৮ সিদ্ধান্ত প্রস্তাব অনুসারে। যত দিন এই তহবিল পাওয়া না যাবে, আরব দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের অস্ত্র কেনার বাজেট থেকে একটি অংশ এই লক্ষ্যে খরচ করবে। তা শুরু করা হবে পুরনো অচল হয়ে যাওয়া অস্ত্র বিক্রি করে অথবা সেকেলে অস্ত্র বিক্রি করে কিংবা উচ্চাকাক্সক্ষী অস্ত্রচুক্তির অর্থ দিয়ে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ইউকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যে সীমাহীন পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হয়, তা থেকে ইইউ মুক্তি পাবে। অ্যাঞ্জেলা মারকেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, গিফটেড ইসরাইলি সাবমেরিনের তহবিল ইকোনমিক প্লানে ডাইভার্ট করবে। একটি জার্মান কমিটি খতিয়ে দেখছে, ১৯৪৮ সালের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইসরাইলকে দেয়া বিপুল পরিমাণের সাহায্য কী করে পুনরুদ্ধার করা যায়।
ব্রিটেনে একটি কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ফিলিস্তিনে ২৮ বছরের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট চলাকালে ব্রিটেন ফিলিস্তিনিদের কী পরিমাণ ধ্বংস ও ক্ষতিসাধন করেছে তা নির্ধারণের জন্য। টনি ব্লেয়ার তার ইরাকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন যুক্তরাজ্যের সরকারি ট্রেজারি থেকে তহবিল বের করে আনার উপায় উদ্ভাবনে। তিনি নিজে প্রস্তাব দিয়েছেন, বিদেশ থেকে সংগৃহীত তার ফি-এর ৩০ শতাংশ তিনি দান করে দেবেন।
আরব সরকারগুলো বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, এই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য। এসব দেশ সাবেক উপনিবেশায়নের তথা কলোনাইজেশনের শিকার। একই সাথে আরব দেশগুলো সতর্ক করে দিয়েছে অন্যান্য দেশের সরকারগুলোকে, যারা এই পরিকল্পনার বিরোধিতা বা ক্ষতিসাধন করতে পারে। আরব দেশগুলোকে বলেছে, এ ধরনের দেশগুলোর ওপর আরব দেশগুলো অর্থনেতিক অবরোধ আরোপ করবে। এসব অবরোধের মধ্যে থাকতে পারে, তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া, আরব দেশগুলো এসব দেশের ফ্লাইট ও আরব দেশের মধ্যকার সমুদ্রপথ নিষিদ্ধ করা এবং তাদের ট্রেজারি বন্ড থেকে তহবিল প্রত্যাহার করা। এ ছাড়া আরো যেসব অবরোধ আরোপ করা হবে ও পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা সময়মতো ভবিষ্যতে প্রকাশ করা হবে।
সিআইএ ফিলিস্তিন সম্পর্কিত এই পরিকল্পনার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছে। তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করেন হোয়াইট হাউজের জায়োনিস্ট কন্টিনজেন্টকে (জ্যারেড কুশনার, ডেভিড ফ্রিডম্যান এবং জ্যাসন গ্রিনব্লেট) এবং তাদের অভিযুক্ত করেন ‘ইউজলেস ব্যাংকরাপ্টসি রিয়েল এস্টেট ডিলার হিসেবে। তিনি তার চিপ পলিটিক্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেন মেলেনিকে।
প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য ‘দ্য সেলভেশন অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে পরিকল্পনা হচ্ছে প্রেসিডেন্টে ট্রাম্পের তথাকথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব বিলীনকারী ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার একটি পাল্টা পকিল্পনা। ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি নামের তথাকথিত এই পরিকল্পনা অনুসারে ফিলিস্তিনকে এর ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুসালেমের দাবি পরিত্যাগ করতে হবে। ইসরাইল জেরুসালেমের পূর্ব ও উত্তরের কয়েকটি গ্রাম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবে, কিন্তু পুরনো জেরুসালেম নগরীর ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলের হাতে। প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে বেসামরিকীকরণ করতে হবে। কিন্তু ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে গড়ে তোলা অবৈধ ইহুদি ইসরাইলি বসতিগুলো যথাস্থানেই থেকে যাবে। জর্দান উপত্যকা থাকবে ইসরাইলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
ফিলিস্তিনিরা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাদের স্বদেশে ফিরে আসার দাবি পরিত্যাগ করতে হবে। তথাকথিত এই পরিকল্পনা যেকোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে এবং অস্বীকার করবে ফিলিস্তিনিদের যাবতীয় অধিকার। এর বিপরীতে টোপ হিসেবে খাড়া করা হয়েছে কিছু অর্থনৈতিক সহায়তা। মোট কথা, এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি জাতিকে ধ্বংস করার নতুন এক মহাপরিকল্পনা, যা কোনো ফিলিস্তিনি মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না সভ্যতার দাবিদার অন্য কোনো জাতিও। এই ডিল ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিত সংক্ষুব্ধ করে তুলবে।
তথাকথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র বেশ কিছু মৌলিক উপাদান সম্পর্কে বিশ্ববাসী নানা সূত্রে জানতে পেরেছে। বলা হচ্ছে, এই ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। কিন্তু এই পরিকল্পনার কুশীলব হচ্ছেন তারই জামাতা জ্যারেড কুশনার ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সমঝোতা-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি জ্যাসন গ্রিনব্লেট। জানা গেছে, এ পরিকল্পনা পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থামিয়ে দিতে যাচ্ছে পাকাপোক্তভাবে। ট্রাম্পের ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বলছে, কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র নয়, সার্বভৌমত্ব নয়, স্বায়ত্তশাসন। বিনিময়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্যাকেজ। এসব কথা নিয়েই আসছে এই তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা। আরব ও ইউরোপিয়ানরা এর বিরুদ্ধে। ইসরাইল অবশ্যই এ পরিকল্পনা নিয়ে মহাখুশি।
কিন্তু কুচক্রীদের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র বিপরীতে আরব দেশগুলো ‘দ্য সেলভেশন অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, তার উপাদানগুলো যেকোনো বিবেকবান মানুষ বিবেচনায় নিলে কোন পরিকল্পনাটি গ্রহণযোগ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের শতাব্দী প্রাচীন অশান্তি-অস্থিরতা, অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে সব মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তা সহজেই বোধগম্য হবে সবার কাছে। সহজেই বোধগম্য ‘দ্য স্যালভেশন অব দি সেঞ্চুরি’ পরিকল্পনাটি নিশ্চিত করবে, যেমন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, তেমনি নিশ্চিত করবে ফিলিস্তিনসহ আরব দেশগুলোতে ইহুদিদের মর্যাদার সাথে বসবাসের সুযোগ ও অধিকার। অপর দিকে তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি হচ্ছে ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব বিলীন করার এক মহাষড়যন্ত্র। কিন্তু এরা জানে না, ফিলিস্তিন বিক্রি করার বিষয় নয়।