ভূকৌশলগত দিক থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে নেপাল
ভূকৌশলগত দিক থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে নেপাল - ছবি : সংগ্রহ
ভারত ও চীনের মতো দু’টি বিশাল দেশের মাঝে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে থাকা নেপাল যে ক্রমেই ভূকৌশলগত দিক থেকে ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা নতুন করে প্রমাণিত হলো মার্কিন পদক্ষেপে। সম্প্রতি নেপালি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গিওয়ালিকে ওয়াশিংটনে দাওয়াত করে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তার সাথে ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক’ (এফওআইপি) কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর এই বৈঠক সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ অঞ্চলে দেশটির ভূরাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা স্বীকার করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নেপালকে ‘মূল ভূমিকা’ পালনের আহ্বান জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
অর্থাৎ নেপালের গুরুত্বকে স্বীকার করে নিলো যুক্তরাষ্ট্র। আবার নিজের গুরুত্ব বুঝতে পেরে নেপালও সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, এখন ছোট্ট দেশটিও বেশ শক্তি রাখে। নেপালি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা আবার জানিয়ে বিনীতভাবে মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘নেপাল কোনো ধরনের কৌশলগত জোটে বিশ্বাস করে না।’ ভারতের নাগপাশ ছিঁড়ে চীনের দিকে যখন নেপাল ক্রমাগত ঝুঁকছিল তখনই মনে হচ্ছিল, কাঠমান্ডু এ ধরনের সিদ্ধান্তই নেবে।
ভারত ও চীনের মধ্যে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়া দারিদ্র্যপীড়িত নেপাল বড় রকমের মার্কিন সহায়তা লাভ করে আসছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেপালই একমাত্র দেশ, যাদের জন্য মার্কিন কংগ্রেসের একক দেশ বাণিজ্য অগ্রাধিকার রয়েছে।
অনেক বছর ধরেই নেপাল আমেরিকান বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পেয়ে আসছে। এর মধ্যে সম্প্রতি মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন গ্র্যান্ডবাবদ পেয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির প্রতি নেপালের অনীহার কারণে হোয়াইট হাউজ তার সমর্থন অব্যাহত রাখা নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে। কারণ, বর্তমান মার্কিন প্রশাসন কেবল ওইসব উন্নয়নশীল দেশকে সহায়তা করছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে সহায়তা করছে। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে ‘অভিবাসী কাফেলা’ ইস্যুতে মধ্য আমেরিকান দেশগুলোতে মার্কিন সহায়তা হ্রাসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
কিন্তু নেপাল কি মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে? কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কি উচিত হবে নেপালকে অগ্রাহ্য করতে বাধ্য করা?
তবে নেপালকে দূরে ঠেলে দেয়ার বদলে মার্কিন সরকারের উচিত হবে এটা বোঝা যে, নেপাল কেন জোট নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মার্কিন প্রশাসনকে আরো উপলব্ধি করতে হবে, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সাথে জোট না গড়েও নেপাল কিভাবে মার্কিন স্বার্থ নিশ্চিত করতে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।
স্নায়ুযুদ্ধ পূর্ণগতিতে থাকার সময় ১৯৬১ সালে নেপাল হয়েছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য। তিনটি যুক্তিতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল নেপাল। প্রথমত, তার ভূকৌশলগত অবস্থান; দ্বিতীয়ত, টিকে থাকার ঐতিহাসিক কৌশল এবং তৃতীয়ত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ও শান্তিবাদের প্রতি জোরালো গণসমর্থন।
ভূবেষ্টিত নেপাল বুঝতে পেরেছে, তিন দিক দিয়ে ভারত ও এক দিক দিয়ে চীনের দ্বারা ঘেরাও সে। ফলে শান্তিপূর্ণ অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই সমতাভিত্তিক সম্পর্ক রাখা নেপালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটোর সদস্য না হওয়ার ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার যুক্তিও ছিল একই। তারাও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছাকাছি থাকায় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছিল। নেপাল আরো বুঝতে পারছে যে, তার শান্তিপূর্ণ অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বেইজিং ও নয়াদিল্লি উভয়কেই তার আশ্বস্ত করা প্রয়োজন এবং তাদের মাটি থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি হবে না।
জোট নিরপেক্ষ কৌশল আক্রমণ ও দখল এড়াতে নেপালের জন্য ঐতিহাসিকভাবে সফল হয়েছে। একইভাবে সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের জোট নিরপেক্ষ নীতি তাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা থেকে রক্ষা করেছে। নেপালের জোট নিরপেক্ষতা নীতি তাদেরকে সব ধরনের প্রক্সি-যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে।
অনেক মার্কিন নীতিনির্ধারক মনে করেন, এ অঞ্চলে আমেরিকান স্বার্থ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নেপাল। ভারত ও চীনের (যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দেশ) মাঝখানে থাকা নেপালের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত ও চীন কেউ নির্ভরযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। কারণ, তারা প্রায়ই অভিন্ন স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে থাকে। দেশ দু’টি বিশ্বস্ত মিত্রও নয়, কারণ তারা অনেক এলাকায় একে অপরকে বিশ্বাস করে না। ফলে ভারত ও চীন উভয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করে নেপালকে বাফার অঞ্চল বিবেচনা করতে পারে। এতে করে বেইজিং ও নয়াদিল্লি উভয়ের সাথেই আলোচনা করার শক্তি পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে এ অঞ্চলে নেপালের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া সর্বোত্তম মার্কিন স্বার্থ। নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বহাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি পূরণ করতে পারে নেপাল।