দেবর-ভাবি দ্বন্দ্বে এরশাদের দল
জিএম কাদের রওশন এরশাদ, ইনসেটে এরশাদ -
জাতীয় পার্টি আর গৃহবিবাদ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দ্বন্দ্ব-গৃহবিবাদ দলটিতে লেগেই আছে। দফায় দফায় ভাঙনের কবলে পড়া দলটির নেতৃত্বের কোন্দল লেগেই আছে। এর সর্বশেষ সংস্করণ হলো পার্টির সদ্য ঘোষিত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে অস্বীকার করে সোমবার গভীর রাতে এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের বিবৃতি। শনিবার তার গুলশানের বাসায় জিএম কাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি দেবর জি এম কাদেরকে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়াও করেন। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা না পেরুতেই সোমবার গভীর রাতে জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান নন বলে গণমাধ্যমে রওশন ওই বিবৃতিটি পাঠান।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এরশাদ তার মৃত্যুর আগে গত ৪ মে জি এম কাদেরকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন এবং তার অবর্তমানে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে একটি সাংগঠনিক নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। তখন থেকেই জাপায় রওশন এরশাদ অনুসারী বলে পরিচিত কয়েকজন সিনিয়র নেতা তা মেনে নিতে পারেননি। এরশাদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর পর কয়েক দিন এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না হলেও তার কুলখানির পর বিষয়টি অনেকের নজরে আসে।
এরশাদের মৃত্যুর পরদিন থেকেই জাপার বেশির ভাগ নেতাকর্মীরা জি এম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ জুলাই জাপার বনানী কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা হঠাৎ করে জি এম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে অসন্তুষ্ট হন রওশনপন্থী সিনিয়র নেতারা। এমন অবস্থায় শনিবার ভাবী রওশন এরশাদের মান ভাঙ্গাতে তার গুলশানের বাসভবনে যান জি এম কাদের। এ সময় দেবরকে দোয়া করে দেন রওশন এরশাদ। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা না পেরুতেই সোমবার গভীর রাতে জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান নন বলে একটি বিবৃতি পাঠান। বিবৃতির নিচে রওশন এরশাদ অন্য যেসব নেতার নাম উল্লেখ করেছেন তাদের স্বাক্ষর নেই। দেবর-ভাবীর এমন দ্বন্দ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে দলটিতে। পার্টির চেয়ারম্যান, বিরোধী দলের নেতা ও রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে থেকে দল থেকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না দলটির শীর্ষ নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্টির প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, পার্টি চলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। দলের চেয়ারম্যান জীবিত অবস্থায় তার অবর্তমানে দল পরিচালনা করার জন্য গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা মোতাবেক তার অনুজ জি এম কাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন এবং বলেছেন, তার অবর্তমানে জি এম কাদেরই হবেন পার্টির চেয়ারম্যান। একই গঠনতন্ত্রে রওশন এরশাদকে বিরোধী দলের উপনেতা বানানো হয়েছে। উনি এখন বিরোধীদলের নেতা হবেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। পার্টির সবাইকে বলব আসুন, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরশাদের দলকে শক্তিশালী করে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাই।
পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, এরশাদের ইচ্ছা ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান, রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা। তাদের যৌথ নেতৃত্বেই পার্টি পরিচালিত হবে। এর বাইরে গিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার জন্য পার্টির দুই-একজন নেতা চক্রান্ত করছেন। অথচ পার্টির তৃণমূলের কাছে তাদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতাও নেই। প্রেসিডিয়াম আরেক সদস্য প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, হঠাৎ করে এভাবে ঘোষণা না করে যদি আনুষ্ঠানিকভাবে সবাই জি এম কাদেরকে আমরা চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারতাম তাহলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টিও হতো না, আমরাও সম্মানিত হতাম।
জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, স্যার (এরশাদ) যে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন তার কোনো বিকল্প নেই। জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান এ নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই এবং বিকল্পও নেই। তবে সবাইকে একসাথে নিয়ে চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে ভালো হতো। অতি উৎসাহীদের জন্য দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জাপা যুগ্ম-মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় বলেন, যখন বিএনপি থেকে নেতাকর্মীরা জাপায় আসতে শুরু করেছে, ঠিক সে সময়ে দলে ঘাপটি মেরে থাকা বিএনপির এজেন্টরা দলে বিভেদ সৃষ্টি করে পার্টির ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। তাদের এ উদ্দেশ্য সফল হবে না।
রওশনের বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বিবৃতির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমি কোনো বিবৃতিতে স্বাক্ষর করিনি। এরশাদের নির্দেশনা অনুযায়ী জি এম কাদেরই পার্টির চেয়ারম্যান।
সার্বিক বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, রওশন এরশাদ আমার মাতৃসমতুল্য। উনি আমার অভিভাবক। তার পরামর্শেই দল পরিচালিত হবে। রওশন এরশাদের বিবৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উনি এমন বিবৃতি দিতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না। দুই দিন আগেও ভাবীর বাসায় গিয়েছি। আবার যাব। আমি আবার বলছি আমাদের মাঝে কোনো বিবোধ নেই।
রওশনের বিবৃতিতে যাদের নাম আছে : সোমবার গভীর রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে হাতে লেখা এক বিবৃতিতে রওশন এরশাদ দাবি করেছেন, যথাযথ কোনো ফোরামে আলোচনা না করেই জি এম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। বিবৃতিতে তিনি পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত জি এম কাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। রওশনের এ বিবৃতিকে সমর্থন জানিয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সাতজন সংসদ সদস্য। বিবৃতির সত্যতা নিশ্চিত করে রওশন এরশাদ বলেন, আমি এ বিবৃতি দিয়েছি। জরুরি ভিত্তিতে দেয়ার কারণে বিবৃতিটি হাতে লেখা হয়েছে।
রওশনের এ বিবৃতিতে সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে রয়েছেনÑ প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, ফখরুল ইমাম এমপি, সেলিম ওসমান এমপি, অধ্যাপিক মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী এমপি, নাসরিন জাহান রতœা এমপি ও মীর আব্দুস সবুর আসুদ। এর বাইরে আছেন লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি ও রওশন আরা মান্নান এমপি। রওশনের এই বিবৃতির মাধ্যমে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে বিভক্তির বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে।