নির্বাচনী জোটগুলোতে টানাপড়েন

মঈন উদ্দিন খান | Jul 21, 2019 02:23 pm
নির্বাচনী জোটগুলোতে টানাপড়েন

নির্বাচনী জোটগুলোতে টানাপড়েন - ছবি : সংগ্রহ

 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ছোটবড় বেশ কয়েকটি জোট গঠিত হয়েছিল। এসব জোট গঠনের কেন্দ্রে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ দুই দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে নির্বাচনের পর জোটগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। কোনো কোনো জোটে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েন শুরু হয়েছে। চলছে সফলতা-ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ছয়টি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়। এগুলো হলো- ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ডা: এ কি এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট, মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স ও নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোট (বিএনএ)।
এর বাইরে আটটি জোট ছিল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রয়েছে। ছিল বাম মোর্চা ও সিপিবি-বাসদ জোট। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় গঠিত হয়েছে এরশাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটসহ আরো কয়েকটি জোট।

নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে এ জোট গঠন হয়। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করে দলগুলো। কিন্তু নির্বাচনে স্তম্ভিত ফলাফলের পর বিভিন্ন ইস্যুতে জোটের শরিকদের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা জোটের বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সর্বশেষ সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ ঘিরে অনেকটা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে এ জোট।

নির্বাচনের দিন রাতেই ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। জোটের নির্বাচিত কোনো সদস্য শপথগ্রহণ করবেন না বলেও জানান তারা। কিন্তু জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম শপগ্রহণ করেন গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর। এরপর জোটের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন এবং মুখপাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘যারা শপথ নেবেন তারা জাতীয় বেঈমান।’ সুলতান মুনসুরকে জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটে মোকাব্বির খানের সময়। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করেন ড. কামাল। এরপর গত ২৫ এপিল শপথগ্রহণ করেন বিএনপির সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেয়ায় তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করে দলটি। কিন্তু ২৯ এপ্রিল শপথগ্রহণের শেষ দিন বিকেলে চারজনকে শপথ নেয়ার অনুমতি দেয় বিএনপি। ওই দিন রাতে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে বিএনপির চারজন শপথ নিয়েছেন।’ পরে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘তাদের সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।’

চার সংসদ সদস্যকে শপথগ্রহণের অনুমতি দেয়ায় ঐক্যফ্রন্টের শরিকেরাও ক্ষুব্ধ হয় বিএনপির ওপর। ফলে জোটের গণজমায়েত কর্মসূচিও বাতিল করা হয়। জোটের বিভিন্ন অসঙ্গতির সমাধান করা না হলে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন কাদের সিদ্দিকী। আকস্মিকভাবে বিএনপির এ শপথগ্রহণের সিদ্ধান্ত ২০ দলীয় জোটকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। বহু দিনের শরিক বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ জোট চেড়ে চলে যান। জোটের আরো একাধিক শরিক প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

নিষ্ক্রিয় যুক্তফ্রন্ট
বিকল্পধারার চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপিকে ১৫০ আসন এবং জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিলে তাদের বাদ গঠিত হয় ঐক্যফ্রন্ট। এরপর বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে জোটটি। নির্বাচনে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব:) আবদুল মান্নান ও যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্টের দলগুলো হলো- বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বিএলডিপি (সভাপতি নাজিম উদ্দিন আল আজাদ), বাংলাদেশ ন্যাপ (সভাপতি জেবেল রহমান গানি), এনডিপি ( চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তুজা), জাতীয় জনতা পার্টির (সভাপতি শেখ আসাদুজ্জামান), বাংলাদেশে জাতীয় পার্টি (সভাপতি অধ্যক্ষ মতিন), গণসাংস্কৃতিক দল (সভাপতি সরদার শামস আল মামুন), বাংলাদেশ জনতা লীগ (সভাপতি ওসমান গণি বেলাল), বাংলাদেশ শরিয়াহ আন্দোলন (সভাপতি মাসুম বিল্লাহ) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি (একাংশ)।
যুক্তফ্রন্টের শরিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই জোট গঠন করে লাভবান হয়েছে বিকল্পধারা। কারণ জোটের মধ্যে ১০টি দল থাকলেও বিকল্পধারার নেতারা আওয়ামী লীগের সাথে আসন সমঝোতা করেছে শুধু নিজেদেরটা। এ কারণে আওয়ামী লীগ বিকল্পধারাকে দু’টি আসনে ছাড় দেয়। অন্য কোনো দলের নেতাদের ছাড় দেয়নি। এ নিয়ে জোটের শরিকেরা মনঃক্ষুণœও হন। এসব কারণে জোট শরিকরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। রাজনৈতিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে সবাই ব্যস্ত নিজেদের কাজে।

কোথাও নেই বিএনএ
বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচনের আগে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে জোটগতভাবে নির্বাচন করারও ইচ্ছাও জানান তারা। ঢাকা-১৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্রও কেনেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। বর্তমানে দলটির কোনো কার্যক্রম নেই। আওয়ামী লীগও কোনো কর্মসূচিতে তাদের ডাকে না। এ জোটের দলগুলো হলো- তৃণমূল বিএনপি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক জোট। এর আগে ২০১৫ সালে নাজমুল হুদার নেতৃত্বে ২৫ দলীয় জোট বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ) গঠিত হলেও তা কিছুদিন পরই ভেঙে যায়।

ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স জোট থেকে দলে পরিণত
একাদশ নির্বাচন সামনে রেখে ১৫টি ইসলামী দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স জোট গঠিত হয়। নির্বাচনে এ জোট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। যদিও এ জোট থেকে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হননি। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার চার মাসের মাথায় এই জোট ভেঙে একটি দলে পরিণত হচ্ছে। ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স জোটভুক্ত দলগুলো হলো- মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, নুরুল ইসলাম খানের গণতান্ত্রিক ইসলামিক মুভমেন্ট, এম এ রশিদ প্রধানের বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, হাসরত খান ভাসানীর বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ (ভাসানী গ্রুপ), রুমা আলীর বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট, মাওলানা শাহ মোস্তাকিম বিল্লাহ ছিদ্দিকীর বাংলাদেশ জমিয়তে দারুসসুন্নাহ, মাওলানা হারিছুল হকের বাংলাদেশ ইসলামী ডেমোক্র্যাটিক ফোরাম, হাকিম গোলাম মোস্তফার বাংলাদেশ গণকাফেলা, মুফতি ফখরুল ইসলামের বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলন, কাজী মাসুদ আহমদের বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, রেজাউল করিম চৌধুরীর বাংলাদেশ ইসলামী পেশাজীবী পরিষদ, মুফতি সৈয়দ মাহাদী হাসান বুলবুলের ইসলামী ইউনিয়ন বাংলাদেশ, খাজা মহিবুল্লাহ শান্তিপুরীর বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন ও আবদুল্লাহ জিয়ার ন্যাশনাল লেবার পার্টি। তবে নতুন দলে এখান থেকে আটটি দল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিভিন্ন ইস্যুতে সক্রিয় বাম গণতান্ত্রিক জোট
নির্বাচনি জোটগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমী বাম গণতান্ত্রিক জোট। এ জোট আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কারও সাথে জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করেনি। তারা নিজেদের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এখন পর্যন্ত এ জোটে ভাঙন বা টানাপড়েনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মাঠের রাজনীতিতে জোটটির সক্রিয়তা কিছুটা কমেছে।
নির্বাচনের পরে জোটটি প্রথম ‘নির্বাচনের কারচুপির ওপর গণশুনানি করে। পুনর্নির্বাচনের দাবিতে বেশ কয়েকটি আলোচনা সভাও করে। বর্তমানে তারা গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং ধানের মূল্য বৃদ্ধির কর্মসূচি পালন করছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের দলগুলো হলো- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।

এর বাইরেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মহাজোটের সঙ্গী ছিল সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। কিন্তু নির্বাচনে পরে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের জোট ছেড়ে সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে।
একাদশ সংসদে সরকারের মন্ত্রিসভায় ১৪ দলীয় জোটের কাউকে না রাখায় শরিকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। প্রকাশ্যে জোটের নেতারা এ নিয়ে বক্তব্য দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সুযোগ-সুবিধার আশায় অনেক জোট গঠন হয়। ভুঁইফোড়, কর্মী-সংগঠনবিহীন ব্যক্তিরা জোট গঠন করে বড় দলগুলোর কাছে ঘেঁষতে চায়। নির্বাচন হয়ে গেলে তরা সটকে পড়েন। ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজ নিজ কাজে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us