মুরসির মৃত্যু বৈশ্বিক সমীকরণ

আমীর হামযা চৌধুরী | Jul 17, 2019 01:57 pm
মুরসির মৃত্যু বৈশ্বিক সমীকরণ

মুরসির মৃত্যু বৈশ্বিক সমীকরণ -

 

মিসরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ছিলেন ইসলামপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা। দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিস, কিডনি ও লিভার সমস্যায় ভুগছিলেন। তার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি রাষ্ট্র। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তিনি। ২০১৮ সালে ক্রিসপিন ব্লান্টের নেতৃত্বে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন সদস্যের একটি প্যানেল জানিয়েছিল, মুরসিকে দিনের ২৩ ঘণ্টা নির্জন কক্ষে রাখা হয়। দিনের মাত্র এক ঘণ্টা তাকে ব্যায়ামের সুযোগ দেয়া হয়। ব্লান্ট জানিয়েছিলেন, মুরসির এ নির্জন কারাবাসকে কঠোর নির্যাতন বলা যায়। এ অবস্থায় তার দ্রুত মৃত্যু হতে পারে। সেই শঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছে। নির্জন কারাবাসে তাকে অমানবিকভাবে মানসিক নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়েছে। স্বজনদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত আদালতে বিচার চলাকালে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন মুরসি। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ কারণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান শহীদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মুরসিকে। 

২০১০ সালে তিউনিসিয়া থেকে আরব বসন্ত শুরু হলে সেই ঢেউ মিসরেও এসে লাগে। ফলাফল গণঅভ্যুত্থানে মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১২ সালে দেশটিতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড জয়ী হয়। দলটির পক্ষে ড. মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারাগারের নির্জন কক্ষে বন্দী রাখা হয় তাকে।

কাতারের কাছে কথিত গোপন নথি ফাঁস, প্রাসাদের বাইরে বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও হামাসের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির ভিত্তিহীন অভিযোগে তার বিচার শুরু হয়। এসব অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় সামরিক জান্তা। এমন অভিযোগের সত্যতা মিসরে অল্প লোকই বিশ্বাস করতেন। তার সাজা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
প্রথমে মুরসিকে আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে এবং পরে কুখ্যাত তোরা কারাগারে রাখা হয়। তোরা কারাগারের সাবেক একজন কারারক্ষী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এ কারাগারের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যে কেউ একবার সেখানে গেলে মারা যাওয়া ছাড়া বের হতে পারেন না। অন্য দিকে ক্ষমতাচ্যুত মোবারকের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে সেটি বহির্বিশ্বে অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। মুরসির মতো এমন অমানবিক আচরণের শিকার হননি মোবারক। কোনো কুখ্যাত কারাগারে রাখা হয়নি তাকে। একটি সামরিক হাসপাতালে আরামদায়ক পরিবেশে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে আদালতে আনা নেয়া করা হতো। মিসরের বর্তমান সামরিক শাসকেরা কখনো ভোলেননি, মোবারক সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান ছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন। ২০১৭ সালের মার্চে তাকে সামরিক হাসপাতাল থেকে নিজ বাড়িতে আনা হয়। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর তীব্র আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে ১১ দিনে ৯০০ জনের মতো মানুষ হত্যার শিকার হন। এ জন্য কখনো তাকে দায়ী করা হয়নি।

মৃত্যুর পরও মুরসির সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার ধুয়া তুলে তাকে নিজের প্রদেশ শরিকিয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার বদলে কায়রোর একটি গোরস্থানে দাফন করতে তার পরিবারকে বাধ্য করা হয়। মিসরের রাষ্ট্রমালিকানাধীন কয়েকটি গণমাধ্যমে মুরসির মৃত্যুর খবরে এটিও বলা হয়নি, তিনি দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুরসির মৃত্যুর ঘটনাটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বিশ্বের যেকোনো বিবেকবান মানুষ এতে বিষণœ হয়ে উঠবেন। যারা সংবেদনশীল, তারা এ মৃত্যুতে বিপন্ন বোধ করছেন। আদালতে তাকে কাচের খাঁচায় রাখা হতো। তার মৃত্যু মিসরের আদালত ও শাসনব্যবস্থার জন্য কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধিবিধান অনুযায়ীও মুরসির মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, বরং সরকারি হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ হত্যাকাণ্ডকে বলেছে ‘ভয়াবহ’, কিন্তু ‘একদম এটিই যে ঘটবে তা আগেই বোঝা গিয়েছিল’। সংস্থাটির দাবিÑ মিসরের কর্তৃপক্ষকেই মুরসির মৃত্যুর দায় নিতে হবে।
জেলখানায় মুরসির মৃত্যুর ঘটনা পাশ্চাত্যকে নাড়া দেয়নি। দেয়ার কথাও নয়, বরং মুরসির আমলের সাতকাহন লেখার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম। যারা ‘মুসলিম’ নাম ধারণ করে গণতান্ত্রিক দুনিয়ার রাজনৈতিক ময়দানে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় ভাগ নিতে চান, তাদের এক নিখাদ বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টায় আপাতত পাশ্চাত্য সফল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও কাতারের আমির শেখ তামিম ছাড়া মুরসির সাফল্য কামনার মতো কেউ ছিলেন না আরব বিশ্বে। এ মতভিন্নতা শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিকও। এ মতভিন্নতাই মার্কিন-ইসরাইলি বৃত্তকে সাহায্য দিয়েছে মুরসির উৎখাতে। যার পরিণতিতে ফের মিসরে অন্ততপক্ষে কয়েক দশকের সেনাশাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা। আরব বিশ্বে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের প্রতি পাশ্চাত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন গণতন্ত্রমনাদের শুধু হতাশাই বাড়ায়নি, পর্যুদস্ত করেছে মানসিকভাবেও।

মুরসির উৎখাতের বার্তায় আরব বিশ্বের নেতাদের নীরবতাই ছিল গদি রক্ষার উপায়। তবে সেক্যুলারদের একটি অংশের নীরবতা সবাইকে অবাক করেছে। তারাই বহুকাল ধরে সেনাশাসনের বিরোধিতা করে এসেছেন। যারা রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী, তারাও মুরসির শাসন আমলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তাকে স্বৈরাচারী প্রমাণের কাজে ক্ষান্ত দেননি। তবে এর বাইরে দাঁড়িয়ে মিসরের রাজনৈতিক পরিক্রমাকে উল্টো দিক থেকে পড়ার আগ্রহও আরব বিশ্বে কম নেই। এ আগ্রহ নানা কারণেই, হোক তা অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক।

রাজনৈতিক মাঠে মুরসির আবির্ভাব ছিল দীর্ঘদিনের অনাচারের অবসানের প্রতীক হওয়া ‘আরব বসন্তের’ ফল। এ ‘আরব বসন্তকে’ বসন্ত বলে আখ্যায়িত করতে নারাজদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। আরব বসন্তকে অনেক বিশ্লেষক তেল উৎপাদনের কঠিন সমীকরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতে কেন আরব বসন্তের ঢেউ উথালপাথাল করেনি, সে প্রশ্নও তুলেছিলেন তারা।

ক্ষমতায় আসীন হয়ে মুরসিকে লড়তে হয়েছে ষাট বছরের সুসংগঠিত ও চক্রবদ্ধ রাষ্ট্রযন্ত্রের কোর্ট-কাচারির সাথে। আদালত নির্বাচিত সংসদকে বাতিল করে মুরসিকে হরণের যাত্রায় ছিল আরো বেশি সুসংগঠিত। আদালতের অখ্যাতিপূর্ণ এ আচরণের ইতি টানার পদক্ষেপে স্বৈরতন্ত্রের গন্ধ পান অনেকে। সৌদি-ইসরাইল-মার্কিনদের নতুন সহযোগী হয়ে ওঠেন কোনো কোনো সেক্যুলার, মধ্যমপন্থী আর নারীবাদীরা। বিভিন্ন কারণে বিরাগভাজন হয়ে মুরসির পতনের আন্দোলনে শামিল হন তারা। ফলাফল, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মুরসির মৃত্যু এবং মিসরে ফের অশেষ সেনাশাসনের শুরু। কফিনে শুধু মুরসি একাই যাননি, নিয়ে গেছেন গণতন্ত্রকামীদের আগামীকেও।

মুরসির অমানবিক মৃত্যু আরবসহ দুনিয়ার কোথাও তেমন সাড়া জাগায়নি। তবে এ মৃত্যুতে টনক নড়েছে তুরস্কের সব শ্রেণীর মানুষের। রাজনৈতিক ও মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে যারা মুরসির রাজনৈতিক মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করেন, সেই সেক্যুলারদেরও। বিশ্বাসীরা রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে মুরসিকে স্মরণ করেছেন সব মসজিদে। এমনকি এরদোগান নিজে ইস্তাম্বুলে হাজির থেকে আনুষ্ঠানিকতাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে গণতন্ত্র পুনরুত্থানের স্বপ্নে।

কিন্তু যারা এরদোগানকে শর্ত সাপেক্ষে বা নিঃশর্তে গণতন্ত্রী মানেন, পাশ্চাত্য কোনোভাবেই তাদের গণতন্ত্রী হতে দিতে চায় না। আর সেক্যুলারদের কট্টর অংশ মুরসির মৃত্যুর মধ্যে এরদোগান পতনের চিহ্ন দেখছেন। তারা ভাবছেন, মুরসির মৃত্যু রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণের পরিণতি। তাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক ইসলামের ভবিষ্যৎ নেই।
এরদোগান মুরসির পতন রোধে সোচ্চার ছিলেন শুরু থেকেই। মুরসিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগে এরদোগানের দুইবারের মিসর যাত্রা ছিল মুরসি-সমর্থকদের টিকে থাকার শক্তি। আর বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধানকে বারবার পাঠিয়ে ছিলেন মুরসিকে সতর্ক করার জন্য, সেনা অভ্যুত্থান রুখে দিতে। কোনো কিছুই নিয়তিকে বদলায়নি। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ঠিক একই সময়ে ইস্তাম্বুলে এরদোগানবিরোধী গেজি পার্ক বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে তুরস্কে এরদোগানবিরোধী নতুন স্রোতের শুরু করেছিল। এরদোগানপন্থীরা এ বিক্ষোভকে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। গেজি পার্ক বিক্ষোভকে এরদোগান শক্ত হাতে দমন করেছিলেন। এটির জন্য ইউরোপ তার প্রতি রুষ্ট হয়।

পাশ্চাত্যের প্রকাশ্য সমর্থনে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে সিসির পরাজয়ের কোনো লক্ষণ ছিল না। নির্বাচনে ৯৭ শতাংশ ভোটে জয়ের পর সিসি ইউরোপ ও আমেরিকার রাজধানীগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, এমনকি জাতিসঙ্ঘে ভাষণও দিয়েছেন শান্তি আর গণতন্ত্রের পক্ষে! কেউ কেউ মিসরের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে আওয়াজ তুললেও তা ইউরোপের সীমানার বাইরে যায়নি, বরং সিসির শাসনকে বৈধতা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষ্যে, ৬০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী সিসির অন্ধকার কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

মুরসির ক্ষণিকের শাসনের বিশ্লেষণে ডান, বাম, উদার ও কট্টর, সব দিক থেকে অনেকে একাট্টা হয়েছে মুরসিকে স্বৈরাচারীর তালিকাভুক্ত করার আয়োজনে। সাথে পেয়েছে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম ও একাডেমিক দুনিয়াকে। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন শর্তে মুরসি নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ইতি ঘটবে তার আমলের; এটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ তা হতে দেয়নি। সৌদি-মার্কিনদের প্রধান লক্ষ্য, ইসরাইলের নিরাপত্তা নির্ধারণ করা। সে নিরাপত্তা নির্ধারণে কেউ হন গণতন্ত্রকামী ও সংস্কারকামী। কেউ জেলখানায় জীবনের ইতি টানেন স্বৈরাচারের অভিযোগের তকমা লাগিয়ে।

মোহাম্মদ মুরসির মিসরের প্রথম বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা ছিল না। তার প্রেসিডেন্সির মেয়াদকাল, যা মাত্র এক বছর টিকেছিল। মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে প্রার্থী মনোনীত করেছিল। কিন্তু তাকে অযোগ্য ঘোষণার পর শেষ মুহূর্তে মুরসিকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। অল্প ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হয়েছিলেন। যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন অনেকগুলো শক্তি তার বিরোধিতা করেছিল। মোবারকের নিযুক্ত বিচারকদের নিয়ে গঠিত মিসরের সর্বোচ্চ আদালত দেশটির সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে তাকে দুর্বল করে দেয়া।
মুরসির মৃত্যু অনেক অর্থ বহন করে। কেউ চাইলে সাদামাঠাভাবে দেখতে পারেন। মুরসি অসুস্থ ছিলেন। মারা গেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর অন্য অর্থও বহন করে। খ্যাতনামা সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বরার্ট ফিস্ক বলেছেন, মুরসির মৃত্যুর সাথে সাথে মিসরীয় গণতন্ত্রেরও মৃত্যু হয়েছে। কেউ বলছেন, গোটা আরবের গণতন্ত্রেরই মৃত্যু হয়েছে। মুরসি অনেকের জন্যই শিক্ষা। কেউ যদি মিসরে গণতন্ত্রের কথা বলেন, ইসরাইলি স্বার্থের বিরুদ্ধে যান, তবে মুরসির মতোই পরিণতি নিশ্চিত। আরবের অন্যান্য দেশের জন্যও এটি প্রযোজ্য। ইসরাইলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই মুরসির মতো ভাগ্যবরণ।

আরব বসন্তের ঢেউয়ে রাজনীতির ময়দানে সামনে চলে এসেছিলেন মুরসি। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাকে সারা বিশ্ব তেমন চিনত না। হতে পারে ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্কিত নেতাকর্মীরা তাকে জানতেন। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার পরই মুরসি আলোচনায় আসেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথেই বিরুদ্ধপক্ষের সমালোচনার শিকার হতে থাকেন। মুরসি মিসরকে ইরানের ধাঁচে ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত করবেন। শরিয়াহ আইন চালু করবেন। নারীর অধিকার থাকবে না। গণমাধ্যমের অধিকার থাকবে না। মুরসি বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। ইত্যাকার অভিযোগ তুলে মুরসির বিরুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারণা শুরু হয়। সাথে যোগ দেন মিসরের ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা। মোদ্দাকথা, পশ্চিমা নিক্তিতে মুরসি উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
এটা ঠিক, মুরসি মিসরকে ভালোভাবে চালাতে পারেননি। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল। একের পর এক কপটিক ক্রিশ্চিয়ানদের গির্জায় হামলা হয়েছে। অবশ্য অনেকে বলে থাকেন, মুরসির বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে সৌদির অর্থ ও ইসরাইলের তত্ত্বাবধানে এসব হামলা হয়েছে। এতে মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থার একাংশও জড়িত ছিল। মুরসির ব্যর্থতা হচ্ছে, গির্জায় হামলা বন্ধ করতে পারেননি। অভিযোগ রয়েছে, মুরসি বিচার বিভাগে ব্রাদারহুডের লোকজন ঢুকিয়ে করায়ত্তের চেষ্টা করছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও ব্রাদারহুডের লোকজনকে নিয়োগ দিচ্ছিলেন।

তবে মিসরের অনেকেই মনে করেন, মুরসির আমলে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে অনেক ভালো ছিল। উগ্র ধর্মনিরেপক্ষতাবাদীরা অভিযোগ করেছিলেন, মুরসি ইরানের খোমেনির মতোই বিপ্লব ছিনতাই করেছেন। কিন্তু প্রগতিশীলেরা চিন্তা করেন না, কেন তারা ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারছেন না। ভোটের মাঠে পারলাম না, আমরা ক্ষমতায় যেতে না পারলে ব্রাদারহুডকে গদিতে থাকতে দেব না, এমন মনোভাব নিয়ে ধর্মনিপেক্ষবাদীরা মাঠে নামেন। অভিযোগ রয়েছে, ইসরাইল-মার্কিন-সৌদি সহায়তায় বিক্ষোভের আয়োজন করেন মিসরের কথিত প্রগতিশীলেরা।

মুরসি তো মরেই গেছেন। ব্রাদারহুডও আর মিসরের ক্ষমতায় নেই। কিন্তু মিসরের সেই সব প্রগতিশীল এখন কী করছেন? যারা তাহরির স্কয়ারে সমবেত হয়ে মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানকে উসকে দিয়েছিলেন। জেনারেল সিসির আমলে এখন বিরুদ্ধমতের সবাইকেই জেলে পোরা হচ্ছে। গুম সেখানে নিত্য ঘটনা। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে গণমাধ্যম। সিসির বিরুদ্ধে সাধারণ সমালোচনারও সুযোগ নেই। ব্রাদারহুডকে ঠেকাতে গিয়ে মিসরের প্রগতিশীলেরা এখন ইসরাইলের কাছে বশীভূত।

মুরসির শাসনকাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মৃত্যু যেন অনিবার্য ছিল তার। তিনি ফিলিস্তিন বিশেষ করে গাজাবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। হামাসের সাথে ছিল সখ্য, মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি জোটের কাছে যা অমার্জনীয় অপরাধ। হামাসের সাথে আঁতাত করে মিসরে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত করার অভিযোগে বিচার চলাকালেই মুরসি আদালতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল কেউ মিসরের ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। কারণ, মিসরের ভৌগোলিক অবস্থান ইসরাইলের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিসরকে বাগে রাখতে পারলে গাজা পুরোটাই ইসরাইল দখল করতে পারে। অন্তত হামাসকে দুর্বল করে দেয়া যাবে, গাজার ওপর অবরোধ অব্যাহত রাখা যাবে। কেননা মিসর সীমান্ত বন্ধ না করলে ইসরাইলের গাজা অবরোধ ব্যর্থ হয়।

অথচ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই মুরসি মিসরের সাথে গাজার রাফাহ সীমান্ত খুলে দেন। এ ছাড়া মিসরে ইসরাইলী দূতাবাসে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে। এটি ইসরাইল কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি। এসব ঘটনা মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি ও মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৭৯ সালে মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি অনুসারে মিসর গাজার রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ওই চুক্তিতে মিসর ও ইসরাইলের সম্পর্কে শান্তি স্থাপিত হলেও গাজাবাসীর জীবনে নেমে আসে চরম অশান্তি। রাফাহ সীমান্ত উন্মুক্ত হলে গাজাবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মিসর থেকে সহজেই আমদানি করতে পারে। অন্যথায় গাজা-ইসরাইল সীমান্তের কেরেম সাহলম সীমান্ত দিয়ে আমদানি করতে হয়। কার্যত এ সীমান্ত ইসরাইল বন্ধই রাখে। ইসরাইলের লক্ষ্য, অবরোধ আরোপ করে গাজাবাসীকে নিঃশেষ করে দেয়া। রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দিলে ইসরাইলের খায়েসের ষোলকলা পূর্ণ হয়। কয়েক দশক ধরে ইসরাইলের সাথে হাত মিলিয়ে মিসরের শাসকেরা কাজটি করছিলেন। কিন্তু মুরসি ক্ষমতায় এসে রাফাহ সীমান্ত বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নেন। মার্কিন-ইসরাইলের পক্ষ থেকে ১৯৭৯ সালের চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও মুরসি তা আমলে নেননি।

১৯৭২ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন-ইসরাইলের পুতুল সরকারই মিসরের শাসন ক্ষমতায় ছিল। বিপরীত স্রোত থেকে মুরসি আসায় তাকে হটাতে মার্কিন-ইসরাইল জোট সক্রিয় হয়। এদের সাথে যোগ দেয় সৌদি আরব। সৌদি মূলত দু’টি কারণে মুরসির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। প্রথমত, কাতার, ইরান ও তুরস্কের সমন্বয়ে মুরসি নতুন এক আঞ্চলিক রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আশঙ্কা ছিল ইরান, তুরস্ক ও মিসর মিলে সৌদি আরবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন উসকে দিতে পারে। মূলত মুরসির বিরুদ্ধে মার্কিন, ইসরাইল, সৌদি আরব, প্রগতিশীল, নারীবাদী সব পক্ষ নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে এক স্রোতে মিলে যায়। সবাই মিলে মুরসিকে হটিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে তারা আরব থেকে গণতন্ত্রকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম কাজ হচ্ছে আরবে গণতন্ত্র স্তব্ধ করে দেয়া। এটি নিশ্চিত, আরবের বেশিরভাগ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে ইসরাইলের টিকে থাকা মুশকিল। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সহজে জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটবে। একই সাথে অস্ত্র বিক্রির বাজারে নেমে আসবে মন্দাভাব। তাই মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক ঠিলে বহু পাখি শিকার করা হলো। কখনোই গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা যাবে না। ইসরাইলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে না। যদি কেউ যান, তার মৃত্যু নিশ্চিত। মিসরের মতো দেশ হলে তা অনিবার্য। বিশেষ করে যখন কোনো দেশে গণমাধ্যম, পশ্চিমা ধাঁচের প্রগতিশীল সমাজ, শিক্ষিত শ্রেণী জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজেদের মতাদর্শ ও স্বার্থকে বড় করে দেখে। মুরসি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। ছিলেন জনপ্রিয়। এরপরও রাজনৈতিক ‘হত্যার’ শিকার হলেন।
তার মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় চিলির নির্বাচিত সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দে হত্যাকে। তুলনাটা গুণে নয়, লক্ষণে। একজন ছিলেন সমাজতন্ত্রী, অন্যজন ইসলামপন্থী। কিন্তু দু’জনই ছিলেন গণতন্ত্রী। দু’জনেই ক্ষমতা হারিয়েছেন সেনা অভ্যুত্থানে, দু’টি মৃত্যুই যার যার দেশে স্বৈরতন্ত্রের জয়ের প্রতীক। ১৯৭৩ সালে আয়েন্দে জেনারেল পিনোশের সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।

নব্বইয়ের পরেও তৃতীয় বিশ্বে সেনা অভ্যুত্থান হয়, গণতন্ত্র বন্দী হয়, তবে আগের মতো রক্তপাত ঘটতে দেন না সেসব জেনারেলদের বিশ্ব মুরব্বিরা। সে জন্যই মুরসি বন্দিত্বের পরে আরো ছয় বছর বাঁচতে পারলেন। তিনি ঘাতকের বিষে বা আঘাতে মারা না গেলেও নির্দয়তার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ফিল্ড মার্শাল সিসির জল্লাদের খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, মিসরের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসি বাঁচেননি। বেঁচে আছেন স্বৈরশাসক মোবারক। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট ফিস্কের ভাষায়, ‘স্বৈরশাসকের কারাগারে যদি আপনি মারা যান। এমনকি যদি আপনি মিসরের একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট না-ও হন, তাহলেও এক অর্থে আপনি খুন হয়েছেন।’

বিপ্লবের পরও পুরনো শাসনব্যবস্থা সহজে মরে না। সেনাশাসকদের নিয়োজিত প্রধান বিচারপতি প্রথমে মিসরের নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দেন। পরে তারা খেয়ে হজম করে ফেলেন খোদ প্রেসিডেন্টকে। এ ঘটনা থেকে দু’টি জিনিস শেখার আছে। ইসলামী বা সমাজতন্ত্রী যে আদর্শবাদীরাই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় বসুন, দলের নয়, আদর্শের নয়, জনতার ক্ষমতায়ন দিয়ে নিজেদের সুরক্ষা তৈরি করতে হবে। তা না করে মুরসি ক্ষমতায় বসেই মুসলিম ব্রাদারহুডের আধিপত্য নিশ্চিত করায় কাজ করেছেন। এটিই তাকে ব্রাদারহুডের বাইরের নাগরিকের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আবার গণতন্ত্রকামী জনতারও আত্মসমালোচনা থাকা উচিত। মুরসির পদত্যাগের আন্দোলন করে যে তারা আগের চাইতে কঠোর সেনাশাসনের হাতে বন্দী হলেন, সেই দায় কার?

এখন প্রশ্ন হলো মুরসির মৃত্যুর প্রতিবাদ করা কি গণতান্ত্রিক, মানবিক, কথিত গ্রগতিশীল মানুষের শোভা পায়? অনেকেই নীরব থেকে বুঝিয়ে দেন ‘না’ ‘না’! তাহলে কি খুশি হওয়া যায়? সে রকম খুশিমন কি গণতন্ত্রের দাবিদার হতে পারেন? এহেন বিপক্ষীয় নীরবতা অথবা অস্বস্তিকর শান্তি কি আসলে নিরীহ? পদাসীন থাকার প্রায় এক বছরে মুরসি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের হতাশ করেছেন। তারা ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা এবং সেক্যুলারিজমের নিক্তিতে মুরসিকে মান উত্তীর্ণ পাননি। নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী ধরণের কিছু না করলেও সংবিধানকে নিজ দলীয় মতাদর্শে রচনা করতে গিয়েছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি এবং হামাসের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে মিসরের ডিপ স্টেট সেনাতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাটতে চেয়েছেন। ইসরাইল-সৌদি আরব আর পশ্চিমা জোটের চোখের বালি থেকে গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছেন।

সুতরাং প্রগতিশীল ও নারীবাদী চোখেও তিনি সমস্যা, ইসরাইল-সৌদি-মার্কিন শাসকদেরও তিনি চটিয়েছেন। বলা ভালো জানি দুশমন বিবেচিত হয়েছেন। তার মৃত্যুতে খুশি হওয়া মুক্তচিন্তাবাদী আর তার শত্রু সৌদি-ইসরাইল আদর্শিকভাবে আলাদা হলেও মুরসিবিরোধিতায় তারা এক। তাতে যদি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ধ্বংস হয় হোক। মতবাদের একচক্ষু হরিণেরা তাই সহজেই বাঘের শিকার হয়, যেমন মুরসিও হয়েছেন, তেমনি তার বিরোধী মিসরীয় সেক্যুলাররাও হচ্ছেন। অপর আদর্শের লোকের প্রতি হিংসাও কি একধরনের সাম্প্রদায়িকতা নয়? এই হিংসাই কি শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারকেই টিকে থাকতে সাহায্য করে না? ভুলে যাওয়া বোকামি হবে, মুরসিদের সাথে লড়া সম্ভব, কিন্তু জায়নবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদের সাথে লড়া ভয়ঙ্কর রক্তপাতের ব্যাপার।
কারো আদর্শ ইসলাম, কারো কমিউনিজম, কারো জাতীয়তাবাদ হলেও কর্মসূচির দিক থেকে চিলির আয়েন্দে, ভেনিজুয়েলার শ্যাভেজ এবং মিসরের মুরসিরা খুব দূরত্বে নেই। তারা কিছুটা জাতীয়তাবাদী, বিপক্ষের প্রতি কড়া এবং নিম্নবিত্তের প্রতি কিছুটা দরদি। সাম্রাজ্যবাদের সাঁড়াশি আর অবাধ পুঁজিবাদী লুণ্ঠনের কামড় তারা কিছুটা আলগা করতে গিয়েছিলেন। অভ্যন্তরীণভাবে মাঝারি মাত্রার অসহিষ্ণুতা তাদের রাজনীতির অঙ্গ হলেও প্রতিপক্ষের তুলনায় তারা একটি বিকল্প ছিলেন। নইলে কী হয় তা সিসির শাসনেই স্পষ্ট।
মুরসির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রচলিত ইসলামী রাজনীতির সঙ্কট কী তা-ও উন্মোচিত হয়। জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার চাইতে তারা সমাজের নারী-পুরুষকে নিজেদের মতবাদের আলোকে চালাতে গিয়েছেন। এ সুযোগই তাদের স্বদেশী শত্রু এবং পশ্চিমারা নিয়েছে। ধর্ম-জাত-সম্প্রদায় না দেখে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে শক্তিশালী হওয়া এবং মধ্যপন্থা নিয়ে টেকসই হওয়ার বদলে জনতাকে নিজেদের তৈরি মূল্যবোধের চাদরে ঢেকে দিতে গিয়ে তারা নিজের পায়ে কুড়াল মারেন।
সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করতে গিয়ে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে পরাজিত হন। রাষ্ট্র কোনো মতবাদিক প্রতিষ্ঠান নয় যে, তাকে আপন মতবাদ বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে হবে। তবে মুরসির মৃত্যু যে গণতন্ত্রের জন্যই, তা অস্বীকার করা যাবে না। গণতন্ত্র মানে কোনো মতবাদ নয়, শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ-জাত-লিঙ্গনির্বিশেষে সব নাগরিকের ক্ষমতায়ন। বিশ্বের আধুনিক ফারাওরা কখনোই সেই ক্ষমতা বাঁচতে দিতে চায় না।

মিসরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। বিশেষত ইসলামপন্থী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা বুঝতে মোহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বাধীন ব্রাদারহুডের রাজনীতির পর্যালোচনা আমাদের খুবই জরুরি। মিসরের অভিজ্ঞতা থেকে এ সংশয় আরো প্রবল হবে যে ইসলামপন্থী রাজনীতি এখনো পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক ফল ও রাষ্ট্র গঠনের মর্ম ও কাঠামোর অসম্পূর্ণতা ও স্ববিরোধিতার কোনো সমাধান দিতে এখনো সাবালক হয়ে ওঠেনি। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও রূপের ঐতিহাসিক তাৎপর্য অস্বীকার করে তা সম্ভব নয়। বরং তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সঙ্কল্পের মধ্যেই একালের ইসলামপন্থী রাজনীতিসহ যে কোনো ইতিহাস-সচেতন রাজনীতির সম্ভাব্য বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভূমিকা নিহিত রয়েছে। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি অন্য সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে শুধু মুসলমানদের জন্য বড়জোর শরিয়া আইনভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এ কালে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অসম্পূর্ণ ও স্ববিরোধী রাষ্ট্রের ধরনে ও মর্মে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এ রাজনীতি এখনো অর্জন করেনি। এ ক্ষেত্রে আদৌ কোনো সমাধান দিতে পারে কি না তার ওপর নির্ভর করবে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যৎ। যেমন- পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পর্যালোচনা ও তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পথ অনুসন্ধানের জন্য ইসলামের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণার বিকাশ, ব্যবহার ও প্রয়োগ।

সে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদেই এ ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটবে। ঠিক এ ধারণার বিকাশ ঘটাতে যেমন, ঠিক তেমনি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই আরো তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্যই ‘গণতন্ত্র’ দরকার। তবে মিসরে দেখা গেছে, ব্রাদারহুড দেশটির নাগরিকদের জন্য যে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান উপহার দিয়েছিল ইখওয়ান সমর্থক ছাড়া দেশটির বাদবাকি মানুষ তা গ্রহণ করেননি। অথচ তাদের ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার এটিই ছিল সর্বোচ্চ রূপ। মুরসির মৃত্যুতে মিসরে একটি পর্বের অবসান হলো। কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনীতি এ তিক্ত ও করুণ অভিজ্ঞতা থেকে আদৌ কিছু শিখবে কি না তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us