জাপানি বাহিনীর ভয়ঙ্কর কাহিনী : যুদ্ধবন্দি ও ডেথ রেলওয়ে
জাপানি বাহিনীর ভয়ঙ্কর কাহিনী : যুদ্ধবন্দি ও ডেথ রেলওয়ে -
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষের সীমাহীন বর্বরতার হাজারো গল্প ছড়িয়ে রয়েছে লোকসমাজে। এদের মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর হলো থাইল্যান্ডের ‘ডেথ রেলওয়ে’র কাহিনীটি। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন থাইল্যান্ড এবং বার্মার (অধুনা মায়ানমার) মধ্যে খাদ্যপণ্য, অস্ত্র আদানপ্রদান এবং সেনা জওয়ানদের যাতায়াতের লক্ষ্যে রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় জাপানি সেনা। আর সেই কাজে লাগানো হয় মিত্রশক্তির যুদ্ধবন্দিদের। ওই প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে অনাহার, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং রোগ-ব্যাধির প্রকোপে প্রায় ১৬ হাজার যুদ্ধবন্দি এবং ১ লাখ এশীয় ক্রীতদাসের মৃত্যু হয়েছিল। তাই লোকমুখে এর নামকরণ হয়ে যায় ‘ডেথ রেলওয়ে’। ওই যুদ্ধবন্দিদের কয়েকজন অবশ্য বেঁচে ফিরেছিলেন। তাদেরই অন্যতম সিরিল ডয়। ব্রিটিশ সৈনিক সিরিল প্রায় চার বছর যুদ্ধবন্দি হিসেবে জাপানি সেনার কব্জায় ছিলেন। চোখ বন্ধ করলে সেই দিনগুলির প্রতিটি মুহূর্ত আজও তাড়া করে বেড়ায় অশীতিপর এই বৃদ্ধকে। সংবাদসংস্থা বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন সিরিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালের শুরুর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশদের শক্ত ঘাঁটি সিঙ্গাপুরের পতন ঘটে। সেই যুদ্ধে জাপান ছিল হিটলারের মিত্র-দেশ। সেই সময় যে ৬০ হাজার ব্রিটিশ সেনাকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়, সিরিল ডয় ছিলেন তাদেরই একজন। ‘সেটা ছিল এক আদিম জীবন,’ বলেছেন তিনি, ‘আমরা সভ্যতা থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছিলাম। ঢুকে পড়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে।’ জাপানিরা যখন সিরিলকে আটক করে, তখন তার বয়স মাত্র ২১। বন্দি করে সটান তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গভীর জঙ্গলে। তাঁর পরনে থাকা সামরিক পোশাক খুলিয়ে ল্যাঙ্গোট-জাতীয় কিছু একটা পরিয়ে দেয়া হয়। সঙ্গে থাকা সমস্ত জিনিসপত্রও কেড়ে নেয়া হয়। বন্দি জীবনের স্মৃতিচারণ করে সিরিল বলেন, ‘আজকাল আমরা যাকে খুব সাধারণ জিনিসপত্র বলে মনে করি, যেমন খাবার প্লেট, টুথব্রাশ, তোয়ালে কিংবা গরম পানি— এসব কিছুই আমাদের ছিল না। কাছে যা ছিল, সেগুলোও কেড়ে নেয়া হয়েছিল।’
জনবসতি থেকে বহু দূরে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে শ্রম-দাস হিসেবে আটক রাখা হয় সিরিলদের। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল একজন কমান্ড্যান্ট। ক্যাম্পগুলোর পাহারা দিত কোরিয়ান সেনারা। তবে, ক্যাম্পের চারপাশে কোনো কাঁটাতার বা বেড়া ছিল না। তাতে লাভ অবশ্য কিছু হয়নি। সিরিলের কথায়, ‘কাঁটাতার না থাকলে কী হবে, তবুও আপনি সেখান থেকে পালাতে পারবেন না। কারণ, আশেপাশে কিছুই ছিল না। আমি যে ক্যাম্পে ছিলাম সেখান থেকে তিনজন বন্দি পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনজনই পরে ধরা পড়ে যায়। খুন হওয়ার আগে তাদের নিজেদেরই নিজের কবর খুঁড়তে হয়েছিল।’
বিপদসঙ্কুল জঙ্গলের বুক চিরে, পাহাড় কেটে এই রেলপথ বসাতে কী ধরনের সমস্যা হয়েছিল, তারও একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন সিরিল। ‘এটা ছিল বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। পাহাড়-পর্বত কেটে, পাথর ভেঙে, জঙ্গল পরিষ্কার করে এই রেললাইন বসানো হয়েছিল। জাপানি সৈন্যরা কোনোভাবে ইংরেজির স্পিড (গতি) শব্দটি শিখে নিয়েছিল। তাই তারা সব সময় ‘স্পিডো, স্পিডো’ বলে আমাদের ধমকাত। তাই আমাদের লাগাতার কাজ করে যেতে হতো। সরাতে হতো টনকে টন মাটি আর পাথর। বর্ষাকালে কাজ করতে হতো কাদা আর পাঁকের মধ্যে,’ বলেছেন সিরিল। বন্দিদশায় সিরিলকে দিয়ে কোয়াই নামের এক নদীর আশেপাশে গাছ কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিয়েছিল জাপানি সেনারা। উদ্দেশ্য ছিল, নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা। পরে এই সেতুটিকে নিয়ে হলিউডে একটি জনপ্রিয় সিনেমাও তৈরি হয়। নাম ছিল— ‘ব্রিজ অন দ্যা রিভার কোয়াই’।
সিরিল বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল জঙ্গল পরিষ্কারের সঙ্গে নদীর খাড়া পারের মাটি কেটে নীচে নামানো। এটা করতে গিয়ে আমাদের হামেশাই বিষধর সাপেদের সম্মুখীন হতে হতো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হতো।’
সিরিল জানিয়েছেন, লাগাতার হাড়ভাঙা খাঁটুনির ফলে দিনের শেষে যুদ্ধবন্দিদের শরীরে আর কোনো জোর থাকত না। ক্যাম্পে পৌঁছে বেঘোরে ঘুমোতেন তারা। বিছানা ছিল বাঁশের। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কোনো জায়গা ছিল না।
সিরিল বলেন, ‘টয়লেট বলতে ছিল খাটা পায়খানা। মাটিতে একটা গর্ত খোঁড়া থাকত। তার উপরে পাতা কাঠের পাটাতনে বসেই কাজ সারতে হতো।’ তার আরো সংযোজন, ‘টয়লেটগুলোতে পোকা কিলবিল করত। ছিল না টয়লেট পেপার। জঙ্গল থেকে আনা গাছের পাতা দিয়ে পরিষ্কার করতে হতো। ক্যাম্পে যা কিছু ঘটত তার সাথে মানিয়ে চলার জন্য মনকে যতটা সম্ভব শক্ত রাখতে হতো।’
তবে, মনকে শক্ত রাখা সম্ভব হলেও শরীরকে রোগমুক্ত রাখার কাজটা ছিল খুবই কঠিন বলে জানিয়েছেন সিরিল। সারা দিনে খাবার হিসেবে মিলত আধ কাপ ভাত। ফলে চরম অপুষ্টিতে বন্দিদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। সিরিল বলেন, ‘ক্যাম্পে বেরিবেরি রোগ মহামারীর আকার নিয়েছিল। এছাড়াও ছিল কার্ডিয়াক বেরিবেরি, হার্টের সমস্যা। আমারও এই রোগ হয়েছিল।’
জাপানি সেনা যুদ্ধবন্দিদের কোনো চিকিৎসা পরিষেবা দিত না। ফলে কেউ অসুস্থ বা আহত হলে যুদ্ধবন্দি ডাক্তারদেরই চিকিৎসার ভার নিতে হতো। সিরিলের নিজেরও একবার পায়ে গুরুতর চোট লেগেছিল। সেই ক্ষত থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল। জাপানি ক্যাম্পে কীভাবে তার পায়ের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, তার বিবরণ দিয়েছেন সিরিল। ‘আমার পায়ে পুঁজ জমত। ক্ষতস্থানে একটা বড় গর্ত তৈরি হয়েছিল। রোজ নিজেই টিপে টিপে সেই পুঁজ বের করতাম। একদিন ক্যাম্পে অস্ট্রেলীয় সেনাবাহিনীর চিকিৎসক মেজর আর্থার মুন আমাকে দেখে ওই ক্ষত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।’
মেজর মুনের উদ্যোগেই তার পায়ের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানিয়েছেন সিরিল। তার কথায়, ‘ওরা আমাকে একটি কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে বাঁশের মাচার উপর শুইয়ে দেয়। তারপর কোনো অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই আমার পায়ের চামড়া কেটে ভিতর থেকে এক টুকরা মাংসপিণ্ড টেনে বের করা হয়।’ ওই অস্ত্রোপচারই যে তার জীবন বাঁচিয়েছিল, তা মেনেও নিয়েছেন সিরিল। ‘ওই অপারেশনটাই আমার জীবন রক্ষা করেছিল,’ বলেছেন সিরিল। মেজর মুনের প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল তার গলায়।
নিজে বাঁচলেও পাশের বেডে থাকা রোগীকে যন্ত্রতায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিলেন সিরিল। সেই মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে সিরিল বলেন, ‘আমার পাশের বেডে একজনকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ওর গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। সেগুলোতে পোকা-মাছি ঘুরে বেড়াত। প্রবল জ্বরে প্রলাপ বকতেন ওই রোগী। একসময় আমার চোখের সামনেই ওঁর মৃত্য হয়।’ ১৬,০০০ ব্রিটিশ, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান এবং ডাচ যুদ্ধবন্দিদের পাশাপাশি এক লাখেরও বেশি এশীয় ক্রীতদাসের প্রাণের বিনিময়ে শেষপর্যন্ত তৈরি হয়ে যায় থাই-বার্মা রেলপথ। মোট সময় লেগেছিল মোট ১৪ মাস।
সিরিল বলেন, ‘আমাদের প্রতি যারা এই ধরনের পাশবিক আচরণ করেছিল, তাদের ঘৃণা করতাম। সত্যি বলতে কি, আমাদের ক্যাম্পের কারও হাতে যদি তখন বন্দুক থাকত, তাহলে তাদের গুলি করে মারতে একটুও দ্বিধাবোধ করতাম না। জাপানি আর তাদের কোরিয়ান গার্ডগুলোকে ঘৃণা করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়েছিল।’ হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বর্ষণের পর জাপানিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়। আর তার মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। চার বছর যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক থাকার পর মুক্তি পান সিরিল ডয়।
সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় সিরিল বলছেন, ‘মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদ এমনই যে, কোনোভাবেই আপনি আপনার বিশ্বাস হারাতে চাইবেন না। সবসময় আপনার মাথায় মুক্তির কথাই ঘুরে-ফিরে আসবে।’