মৃত মানুষের পাশে বসে কান্না করাই যাদের পেশা!
মৃত মানুষের পাশে বসে কান্না করাই যাদের পেশা! - Afaqs
ভারতের রাজস্থানে বিচিত্র পেশার এক সম্প্রদায় বাস করে। তারা হলেন ‘রুদালি’ সম্প্রদায়। বহুকাল ধরেই ওই সম্প্রদায়ের মহিলাদের একমাত্র পেশা হলো ভাড়াটিয়া হিসেবে মৃত ব্যক্তির জন্য চোখের জল ঝরানো! আর এই পেশাতেই জীবিকা নির্বাহ করেন রাজস্থানের ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের বেশকিছু নারী। ওই নারীরা কালো পোশাক পড়ে রাজস্থানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। কোথাও কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কাঁদার জন্য তাদের ডাক পড়ে। কোনো মানুষ মুমূর্ষু অবস্থায় থাকলেও কালো পোশাকের ওই নারীদের আগে থেকেই ভাড়া করে রাখে মুমূর্ষু ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা। মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পর তাদের দায়িত্ব বা কাঁদার কাজ শেষ।
তবে কোনো কোনো বাড়িতে তিন দিন পর্যন্ত ভাড়াটিয়া রুদালিদের দিয়ে কান্নার আয়োজন করে থাকে রাজস্থানের জমিদার শ্রেণীর মানুষ। বুক চাপড়ে, মাটি চাপড়ে, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে হৃদয়বিদারক বা করুণ সুর করে বিলাপ করে কান্নাকাটি করার সময় রুদালিদের কান্না দেখতে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। করুণ সুরে তাদের কান্না দেখে অনেক সময় কাঁদে মৃত ব্যক্তির পাড়া-প্রতিবেশীরাও।
সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি অদ্ভুত পেশা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ভারতের রাজস্থানে কয়েক শ’ বছর ধরে টিকে রয়েছে রুদালি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীরা কালো কাপড় পরিধান করে। শত শত বছর ধরে তাদের বিশ্বাস যমদূতের পছন্দের রঙ হলো কালো। তাই যমদূতকে খুশি করতেই ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীরা কালো রঙের পোশাক পরিধান করে। তাদের পেশার মতোই তাদের ব্যক্তিগত জীবনপুঞ্জিও। রাজস্থানের মানুষের কাছে ‘রুদালি’ সম্প্রদায় তথাকথিত নীচু বর্ণের। সমাজে তাদের বিয়ে করার অনুমতি নেই। কারণ তাঁরা যদি বিয়ে করে ঘর সংসারী হয় তবে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে আর কান্না করবে না। আর মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার আয়োজন না করলে মৃতের আত্মা কষ্ট পাবে। তাই রুদালিদের বিয়ে করার ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এখন জেনে নেয়া যাক মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন থাকতে কেন রুদালিদের দিয়ে মরা বাড়িতে কান্নার আয়োজন? রোর বাংলা নামক একটি মাধ্যম থেকে জানা গেছে, একজন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে বিভিন্ন বর্ণ-গোত্রের মানুষ মৃতের খবর পেলে ভিড় জমান। সমাজের উচ্চবর্ণের নারীদের অন্য বর্ণ-গোত্রের মানুষের সামনে নিজেদের আবেগ-অনুভূতি প্রদর্শনের অনুমতি নেই রাজস্থানে। উচ্চবর্ণের নারীরা বাড়ির অভ্যন্তরেই স্বাভাবিকভাবে থাকতে হবে। এ কারণে তাদের নিজেদের হৃদয়ের জমানো চরম দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এই ‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের নারীরা।
‘রুদালি’ সম্প্রদায়ের মরা বাড়িতে কান্নার এই পেশা সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু রাজস্থানের বেশকিছু জনগোষ্ঠীর কাছে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং শত শত বছর ধরে চলে আসা চরম সত্য ও ঐতিহাসিক। ‘রুদালি’ নারীদের মৃত ব্যক্তির বাড়িতে কান্নার কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে সব সময়ই লিঙ্গ, জাত, শ্রেণী, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়।
এবার নিশ্চয়ই পাঠকদের জানতে ইচ্ছা করছে নিজেদের সুখ জলাঞ্জলি দেয়া ওই ‘রুদালি’ কারা? রাজস্থানে যদি কেউ নীচু বর্ণের মানুষ হয় এবং ওই মানুষটি যদি অর্থনৈতিক টানাপড়েনে থাকে তাহলে তাদেরকে রুদালি হতে বাধ্য করে উচ্চবর্ণের পরিবারগুলো। জমিদারি শাসনামলে অনেক সময় দরিদ্র প্রজাদের রুদালি হতে বাধ্য করত জমিদাররা। এ প্রথা এখনো বিদ্যমান। সমাজের উচ্চবর্ণের বা জমিদার শ্রেণীর মানুষ নীচু বর্ণের দরিদ্রদের রুদালি হতে বাধ্য করছে। তাদের চোখের জল টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই কিনে নিতে পারে জমিদার শ্রেণীর তথাকথিত ওই মানুষগুলো।
উচ্চ বর্ণের পরিচয়হীন মানুষের মৃত্যুতে মাটিতে গড়াগড়ি, বুক চাপড়ে বা যত আবেগের সাথেই কান্নাকাটি রুদালিরা করুক না কেন, তাদের মজুরি মেলে নামমাত্র। সেই সাথে শত শত বছরের ঐতিহ্য হিসেবে রুদালিদের জন্য বরাদ্দ থাকে দুটি বাসি রুটি আর একটি কাঁচা পেঁয়াজ। তবে বর্তমানে কোনো কোনো পরিবার রুদালিদের এক বেলা ভাত খেতে দেয় এবং কালো রঙের পরনের একটি কাপড় দান করে।