এরশাদ জীবিত থাকতেই কবর নিয়ে টানাপড়েন, নেপথ্য কাহিনী
এরশাদ জীবিত থাকতেই কবর নিয়ে টানাপড়েন, নেপথ্য কাহিনী -
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অসুস্থ হলেও এখনো জীবিত; কিন্তু তিনি মারা গেলে তার সমাধি কোথায় হবে এ নিয়ে চলছে টানাপড়েন। এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি দল ও পরিবার। রাজধানীতে তিন নেতার মাজার অথবা জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মাজারের পাশে পার্টির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। সরকারের পক্ষ থেকে মোহাম্মদপুর কবরস্থান অথবা রাজধানীর বনানী কবরস্থানে গ্রিন সিগনাল রয়েছে। তবে তিনি মারা গেলে নিজেই রংপুরের তার নিজস্ব বাসভবন পল্লী নিবাসেই তাকে দাফন করার অসিয়ত করেছেন। এ জন্য তিনি একটি সমাধি কমপ্লেক্স কাম মিউজিয়াম করারও পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনার ডিজাইন তার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে ফাইলিংও হয়েছিল। বিষয়টি ঘোষণার জন্য গত ২৮ জুন এরশাদ রংপুর সফর করার কথাও ছিল। কিন্তু তার দুই দিন আগেই তিনি অচেতন হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হন। রংপুর বিভাগের জাতীয় পার্টি ও জনসাধারণ এরশাদ মারা গেলে তাকে রংপুরে দাফন করার ব্যাপারে একাট্টা। বিষয়টি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েও দিয়েছেন রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
জাতীয় পার্টির বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা গেলে কোথায় তাকে দাফন করা হবে এ নিয়ে প্রেসিডিয়াম বৈঠকসহ দলীয় নীতিনির্ধারণী ও পারিবারিকভাবে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা। এরই মধ্যে আলোচনায় আসে কবরের ব্যাপারে এরশাদের অসিয়ত। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানেও পাওয়া গেছে কবরের ব্যাপারে অসিয়তের বিভিন্ন বিষয়। অনুসন্ধান সূত্র মতে, রংপুর মহানগরীর দর্শনায় নিজের কেনা জমিতে গড়ে তোলা পল্লী নিবাসেই সমাহিত হতে চান এরশাদ।
অসিয়তের সময় রাজধানীর প্রেসিডেন্ট পার্কে উপস্থিত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক এরশাদের ঘনিষ্ঠজন রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আব্দুল বারী নয়া দিগন্তকে জানান, আমার উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট পার্কে স্যার পল্লী নিবাসে তার কবর দেয়ার জন্য অসিয়ত করেছেন। আমাকে বলেছেন, আমার কবর পল্লী নিবাসেই যেন দেয়া হয়। তিনি আমাকে এও বলেছেন, রংপুরের মাটিতেই যেন আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়, আমাকে রংপুরে পল্লী নিবাসেই কবর দেয়ার ব্যবস্থা করবে। আমি সারা জীবন যেন রংপুরের মানুষের কাছে থাকতে পারি। এ সময় তার ভাতিজা প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব:) খালেদ আখতার, প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর, কর্মচারী ছাত্তার, ওয়াহাব, বাদশাসহ সবাই ছিলেন।
রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি এরশাদ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন সাবেক কাউন্সিলর আজমল হোসেন লেবু জানান, তিনি বিভিন্ন সময়ে রংপুরে আলাপচারিতায় তার সমাধি রংপুরে করার কথা বলেছিলেন। এমনকি তার মা মারা যাওয়ার পর তিনি তাকে কবর দিয়ে বলেছিলেন, মায়ের কবরের পাশে ফাঁকা জায়গা রাখিও। পরে তিনি পল্লী নিবাসেই তার কবরের জন্য অসিয়ত করে গেছেন।
রংপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব মাসুদার রহমান মিলন জানান, স্যার মারা গেলে তার সমাধি আমরা রংপুরে চাই। এটা রংপুরের প্রতিটি নেতাকর্মীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের দাবি। কারণ রংপুরে স্যারকে সমাহিত করা না হলে তার কবরের পাশে গিয়ে দোয়া করার কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
রংপুর জেলা যুব সংহতির সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান নাজিম জানান, স্যারের সাথে ছিলাম। তিনি মারা গেলে যেন প্রতিদিন তার কবর জিয়ারত করতে পারি, সে জন্য তার অসিয়তকৃত পল্লী নিবাসেই স্যারের কবর চাই। প্রতিটি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এটা চাই। আশা করি পার্টির নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি সেভাবে দেখবেন।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও রংপুর জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক জানান, স্যার মারা গেলে তার সমাধি রংপুরের পল্লী নিবাসেই দিতে হবে। এটা আমাদের রংপুর অঞ্চলের প্রতিটি সাধারণ মানুষের দাবি। তিনি অসিয়ত করে গেছেন পল্লী নিবাসে থাকবেন। সেখানেই তাকে সমাহিত করতে হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এরশাদের অন্যতম কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত এস এম ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর জানান, স্যারের অসিয়তকৃত স্থান রংপুর পল্লী নিবাসেই তাকে দাফন করতে হবে। কারণ তিনি রংপুরের মাটি ও মানুষের মনের মানুষ। রংপুরের মানুষ তার ভক্ত-অনুরক্ত। পল্লী নিবাসে তাকে দাফন করা হলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার কবর জিয়ারত করতে পারবেন। রংপুরে থেকেই তিনি যেহেতু জাতীয় নেতা। সে কারণে তাকে ঢাকাতে দাফন করা হলে তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদা পাবেনÑ এটা ভুল ধারণা। যুক্তি তুলে ধরে জাতীয় পার্টির এই নীতির্নিধারক জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তাতে কি তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদা পাচ্ছেন না। সে কারণে জাতীয় নেতা হিসেবে ঢাকায় এরশাদকে দাফন করতে হবে এই আইডিয়া ঠিক নয়। রংপুরের মানুষ স্যারকে যেভাবে ভালোবেসেছে তা ইতিহাসে বিরল। তাকে তার অসিয়তকৃত স্থানেই দাফন করা হলে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক দর্শন আরো বিকশিত হবে। পাশাপাশি তিনি পল্লীবন্ধু হিসেবে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হবেন।
এ প্রসঙ্গে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা নয়া দিগন্তকে জানান, প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মে পৃথিবী থেকে চলে গেলে আমাদের রাজনৈতিক পিতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি মহোদয়কে তার অসিয়তকৃত স্থান পল্লী নিবাসেই দাফন করতে হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা রাজধানীতে খোলা স্পেসে তাকে দাফন করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমরা এরশাদের দেয়া জাতীয় তিন নেতার মাজারের পাশে অথবা জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে আসাদ গেট এলাকায় মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কবরের পাশে জায়গার জন্য সরকারকে বলেছি। কিন্তু সে ব্যাপারে আমাদের কোনো আশ্বাস দেয়া হয়নি। মোহাম্মদপুর কবরস্থানে সেই এলাকার মেয়র মাত্র একটি কবরের জায়গা দেয়ার জন্য রাজি হয়েছেন। এরশাদকে সেখানে দাফন করার প্রশ্নই উঠে না। ক্যান্টনমেন্টে এরশাদকে দাফন করা হলে আমরা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা তার কবরও জেয়ারত করতে পারব না। সে কারণে তার কবর রংপুরের মাটিতে তার নিজের গড়া পল্লী নিবাসেই দিতে হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের নয়া দিগন্তকে জানান, ভাইয়ের অবস্থা আগের মতোই আছেন। তবে তিনি মারা গেলে রংপুরের পল্লীনিবাসে তাকে দাফন করার বিষয়ে তিনি কোন কিছু অসিয়ত করে গেছেন কি না, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। পরে এ বিষয়ে কথা বলব। এ ব্যাপারে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা জানান, এরশাদকে রংপুরে দাফন করার ব্যাপারে রংপুরের প্রতিটি মানুষ একমত। আমিও তাদের অনুভূতির সাথে একমত পোষণ করছি। আর যেহেতু পল্লী নিবাসটি তিনি এরিখ এরশাদকে দিয়ে গেছেন সেহেতু তাকে পল্লীনিবাসে দাফন করা হলে এরিখ সবচেয়ে সম্মানিত হবে। রংপুরের মানুষের অনুভূতিকে এরিখ সম্মান জানাবে।
এ ছাড়াও দর্শনার বিভিন্ন শ্রেনিপেশার মানুষ এরশাদকে রংপুরে দাফন করার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, এরশাদের পারিবারিক নিবাস রংপুর শহরের সেনপাড়ায় স্কাইভিউতে হলেও তিনি নিজে জমি ক্রয় করে রংপুর শহরের দর্শনায় মহাসড়কের পাশে দেড় একর জমির ওপর পল্লীনিবাস নামে তার নিজস্ব আবাসন তৈরি করেন। রংপুরে এলে তিনি সেখানেই রাত যাপনসহ সব রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকা পরিচালনা করেন। গত বছর অক্টোবর মাসে পল্লী নিবাসের পুরনো স্থাপনা ভেঙে একটি আধুনিক বাড়ি নির্মাণও শুরু করেন তিনি। বাড়িটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। পল্লী নিবাসের পাশেই তিনি বাবার নামে মকবুল হোসেন মেমোরিয়াল ডায়াবোটিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে স্বল্পমূল্যে অসহায় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। পরবর্তীতে জায়গাটি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার সন্তান এরিখ এরশাদের নামে বন্দোবস্ত করে দেন।