ভুলে যাওয়া রোগ : অ্যালঝেইমারস ডিজিস
ভুলে যাওয়া রোগ : অ্যালঝেইমারস ডিজিস - ছবি : সংগ্রহ
বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে স্মৃতিভ্রংশের প্রকোপ। ডিমেনশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে, অ্যালঝেইমার ডিজিজ; যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ঝুঁকি। অ্যালঝেইমারস একটি মারাত্মক ও ক্রনিক রোগ, যা মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে কর্মদক্ষহীন করে ফেলে। এটি একটি অধিকতর খারাপের দিকে অগ্রসর হওয়া রোগ, যার প্রক্রিয়া পাঁচ থেকে ২০ বছর ধরে চলতে থাকে এবং এমন একটি সময় আসে যখন এই রোগীরা তাদের প্রাত্যহিক সব কাজ যেমন খাওয়া, গোসল করা ও বাথরুম ব্যবহার করার জন্য অন্যের ওপর সার্বক্ষণিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। লিখেছেন ডা: মো: ইসমাইল হোসেন
প্রকৃতির নিয়মে বয়স বাড়ার সাথে মস্তিষ্কে অনেক পরিবর্তন হয়। মস্তিষ্কের আয়তন কমতে থাকে, খাঁজ গভীর হয়, নার্ভসেলের সংখ্যাও কমে যায়। তবে অ্যালঝেইমারস ডিজিজে এই পরিবর্তন অনেক দ্রুত গতিতে হয়। কারণ মস্তিষ্কের অ্যামাইলয়েড প্রোটিন আমাদের প্রতিটি নার্ভসেলের কোষপর্দায় অ্যামাইলয়েড প্রিকারসর প্রোটিন থাকে। এরাই অ্যামাইলয়েড প্রোটিন তৈরি করে। আর এই তৈরিতে সাহায্য করে আলফা সিক্রেটেজ নামে প্রটিয়েজ ক্যাটালিস্ট কিন্তু যাদের অ্যালঝেইমারস হয় তাদের ক্ষেত্রে আলফার জায়গায় হাজির হয় বিটা বা গামা সিক্রেটেজ যা অ্যামাইলয়েড প্রিফারস প্রোটিনকে ভুল জায়গায় ভেঙে দেয়। ফলে তৈরি হয় বিটা অ্যামাইলয়েড প্রোটিন। আর এ বিটা অ্যামাইলয়েড প্রোটিনই যত নষ্টের গোড়া। অ্যালঝেইমার রোগীদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন ধরনের ¯œায়ু প্রেরকের ঘাটতি দেখা যায়। যার মধ্যে রয়েছে অ্যাসিটাইল কোলিন এবং কোলিন অ্যাসিটাইল ট্রান্সফারেজ। এ ছাড়া গ্লুটামেট সোমাটো স্ট্যাটিন সাবস্ট্যান্স পিসহ নানা স্লায়ু প্রেরকও কমে যায় এই রোগে। কেন কমে যায় তা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও অজানা।
বংশগত কারণ যেমন বাবা-মা অথবা ভাইবোন কারো অ্যালঝেইমারস থাকলে রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়।
রক্তে কোলেস্টেরল এবং হোমোসিস্টিনের পরিমাণ বাড়লে বিটা অ্যামাইলয়েডের উৎপাদন বাড়ে। তাই অতিরিক্ত ওজন হবে, হাইপার থাইরয়েডিজম, উচ্চ রক্তচাপের অসুখেও অ্যালঝেইমারসের সম্ভাবনা বাড়ে।
ডায়াবেটিস মেলিটাস অ্যালঝেইমারস এবং ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া উভয়ের সম্ভাবনাই বাড়ায়।
দীর্ঘস্থায়ী চাপ, মানসিক অবসাদে অ্যালঝেইমারস বাড়ে।
ভিটামিন বি-১ ফোলেট, নিয়সিন, থায়ামিনের ঘাটতিতে হতে পারে ডিমেনশিয়া।
ওষুধ : অ্যান্টিকোলিনার্জিক, অ্যান্টিকনভালসেন্ট, কিছু মানসিক রোগের ওষুধ, বিশেষত ঘুমের ওষুধ ডিমেনশিয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। কেমোথেরাপি ও ব্রেনে রেডিও থেরাপি পর ও এই সম্ভাবনা বাড়ে।
ব্রেন টিউমার, মেনিনজিয়োমা, পিটুইটারি এডিনোমা ইত্যাদি।
রোগের লক্ষণ : অ্যালঝেইমারসের লক্ষণ অনেক রকমের হয়। তবে কারণ যাই হোক না কেন, মোটামুটিভাবে যেকোনো ও স্মৃতিভ্রংশ রোগ কতগুলো ছোটখাটো বিষয় খেয়াল করা যায়। খেয়াল রাখলে শুরু থেকেই রোগটা বোঝা যায়। প্রথমে ছোটখাটো ভুল তারপর বড় ভুল যেমন সদ্য শোনা বা শেখা কথা বা কাজ ভুলে যাওয়া, এ ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া কিন্তু উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়া। একই কাজের জন্য বারবার জিজ্ঞাসা করা।
কথাবার্তার খেই হারিয়ে ফেলা, সঠিক শব্দের উচ্চারণ বা নাম খুঁজে না পাওয়া।
চেনা মুখ, চেনা জিনিস দেখেও নাম মনে করতে না পারা। ফুচকাপ্রিয় মানুষ, যিনি তার চোখের সামনে একজনকে ফুচকা খেতে দেখেও সেই নামটি কিছুতেই মনে করতে না পারা।
কোনো ঘটনার মধ্যে উপস্থিত থাকলেও, ঠিক কোথায়, কখন, কী হলো তা ঠিকমতো বলতে না পারা।
দৈনন্দিন কাজের জায়গায় ঘন ঘন ভুল, গ্যাস জ্বালিয়ে রেখে ভুলে যাওয়া, আলো-পাখার সুইচ অফ না করেই চলে যাওয়া, দাঁত মাজার কথা ভুলে যাওয়া, খেয়ে মুখ না ধোওয়া, চশমা, চাবি, মোবাইল কোনো স্থানে রেখে ভুলে যাওয়া।
সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা, কাজ এড়িয়ে যাওয়া, হঠাৎ রাস্তা, বিরক্তি, লোককে যা বলা উচিত নয় তেমন কিছু বলে বসা, আবার কখনো কখনো চূড়ান্ত উত্তাপহীন।
লোকজনের সাথে কম মিশতে চাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া বা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলা।
সন্দেহবাতিকতা : আমার জিনিস চুরি যাচ্ছে, কেউ লুকিয়ে রাখছে, এমনকি নিজের স্ত্রী বা স্বামীকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, নিজের বাড়িতে বসেই কেউ বা বলেন বাড়ি যাবো অথবা আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। যে মানুষ আর নেই, মারা গেছেন বহুকাল, তিনিও বেঁচে আছেন। সেই মানুষকেই খুঁজে চলেন অনেকে।
উদ্দেশ্যহীনভাবে কোনো কাজ বারবার করা। জিনিস ভুল জায়গায় রাখা, যেমন ময়লা ফেলার জায়গায় জামাকাপড় রেখে দেয়া, ফ্রিজের উপর কাপ ডিশ সাজিয়ে রাখা।
চিকিৎসা : সত্য কথা বলতে, চিকিৎসায় অ্যালঝেইমারস সারে না। তবে সময়মতো সর্তক হলে, যথাযথ চিকিৎসা করালে তার মধ্যে ভালো থাকতে সাহায্য করে। শুধু রোগীর জন্য নয়, তার বাড়ির লোকজনের ওপর থেকেও স্ট্রেস কমতে পারে চিকিৎসা। ওষুধ দিয়ে স্মৃতি, চিন্তা মনোযোগের অবনতি কিছুটা হলেও ঠেকানো যায়। কোলিন এস্টাবেজ ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ এ ক্ষেত্রে কার্যকর। কোলিনএস্টাবেজ ইনহিবিটরের মধ্যে রয়েছে ডোনেপেজিল, রিভাসটিগমিন, গ্যালাকটামিন। আর এক বিশ্বস্ত ওষুধ মেমানটিন। কখনো কখনো মুড স্টেবিলাইজার এবং ঘুমের জন্য বেনজোডায়াজিপিনস এবং নন-বেনজোডায়াজিপিনসের ব্যবহার করা জরুরি। তবে ওষুধের ওপর ভরসা করলেই হবে না। রোগীর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ এখানে বেশি জরুরি। বাড়ির মানুষদের তাই অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। এদের মন ভালো রাখতে নিজেদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনুন। ছোট ছোট দিকে খেয়াল রাখলেই দেখবেন এরা ভালো থাকবে। রোগীরে যতœ নেয়ার ক্ষেত্রে আমারা ছয়টি ঊ খেয়াল রাখতে পারি।
ঊফঁপধঃরড়হ ঃড় ঋধসরষু
রোগ সম্পর্কে পরিবারকে জানানো ও বোঝানো।
রোগীর ঠিক কী হয়েছে।
কতদিন এমন চলবে।
কেন এমন আচরণ করছে।
এনভায়রনমেন্ট : বাড়ির বাথরুম বা টয়লেটের দরজার সামনে নাম লিখে রাখা, ছবি আঁকানো যাতে করে রোগী বাথরুম বা টয়লেট চিনতে পারে।
রোগীর বসবাসের ঘরের দেয়ালে ক্যালেন্ডার, বড় দেয়ালঘড়ি ঝুলিয়ে দেয়া।
এমপাওয়ার
বাড়িতে কেউ এলে তার নাম, সম্পর্ক জানানো। জামাকাপড় বদলানো।
ঘুম, গোসলের প্রতি যতœবান হওয়া।
এনগেজ : বাড়ির সামনের রাস্তায় একসাথে হাঁটা, পুরনো গান শোনা, পুরনো অ্যালবামে ছবি দেখা। একসাথে খেলা।
এনারজাইজ : রোগীকে সাথে করে নিয়ে বাজার, দোকান, বিয়েবাড়ি, বন্ধুর বাড়ি, সিনেমা দেখতে যাওয়া।
ঊহফ চড়রহঃ
নার্সিং হোমে ভর্তি করে দেয়া।
লেখক : ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী।