পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচার : বিকৃত রুচির পরিচয় দিলো হারুন
পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচার - পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচার
ছোট্ট শিশু সায়মা। বয়স সবে মাত্র সাত বছর। বড় একটি পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটি। ছোট্ট পায়ে ছোটাছুটি করে সারা ঘর মাথায় করে রাখত। সারাক্ষণ হাসি-খেলায় মাতিয়ে রাখত পুরো পরিবারকে। স্কুলেও যাওয়া শুরু করেছিল শিশুটি। তার খাতার পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করছে সদ্য লিখতে শেখা গোটা গোটা হাতের লেখা। তার পানি খাওয়ার মগ, ভাত খাওয়ার থালা, স্কুলের ব্যাগ, পড়ার বইগুলো সবই আছে। নেই শুধু আদরের সন্তান সায়মা। তার পোশাক, বই ও ছবি এখন বাবা-মায়ের কাছে শুধুই স্মৃতি। শিশুটিকে পাশবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। ছোট্ট শিশুটি যে কিনা এখনো জীবনকে চিনতেই শুরু করেনি, অথচ তাকে কি না মেনে নিতে হলো মৃত্যুর মতো করুণ উপসংহারকে! আর মৃত্যুর আগে সহ্য করতে হলো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অত্যাচারকে! একটা নরপশু, একটা বিকৃত রুচির পাষণ্ড শিশুটিকে বাঁচতে দিলো না। ছোট্ট সায়মার বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের যে বোঝা আমরা চাপিয়ে দিয়েছি, সেই ভার সইতে পারবে তো! হয়তো পারবে! এর আগেও তো তনু, রিশা, মিতু, বিশ্বজিৎ, নুসরাত, রিফাতদের ভার সয়ে নিয়েছে তাদের স্বজনেরা। সয়ে নিয়েছে সেই সব হতভাগ্যের লাশ যারা শুধু মৃত্যুই পেয়েছে, বিচারটুকুও পায়নি! আজ বিচার চেয়ে কাঁদছে সায়মার বাবা আব্দুস সালাম। গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, তার মেয়েকে দুইভাবে নির্যাতিত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে আসামির ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।
এর আগে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর ওয়ারীর বনগ্রামের স্কুলছাত্রী সাত বছরের শিশু সামিয়া আক্তার সায়মাকে ধর্ষণের পরে হত্যার অভিযোগে হারুন অর রশিদ নামে এক যুবককে কুমিল্লার ডাবরডাঙ্গায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। হারুন তার খালাতো ভাই পারভেজের রঙের দোকানে কাজ করত।
শিশুটিকে ছাদ ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটে নিয়ে ধর্ষণ করে এই পাষণ্ড। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধর্ষণের সময় সামিয়া নিস্তেজ হয়ে যায়। মৃত ভেবে গলায় রশি পেঁচিয়ে রান্না ঘরে রেখে হারুন পালিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন। গতকাল রোববার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
আব্দুল বাতেন বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় ৬টার দিকে সায়মা তার মাকে বলে আট তলায় যাবে। সেখানে ফ্ল্যাট মালিক পারভেজের একটি বাচ্চা আছে তার সাথে একটু খেলেই চলে আসবে। প্রায় সময়ই ওই বাসায় গিয়ে বাচ্চার সাথে সায়মা খেলত। সেখানে গেলে পারভেজের স্ত্রী জানায়, তার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। সেখান থেকে বাসায় ফেরার উদ্দেশে লিফটে ওঠে সায়মা। লিফটে সায়মার সাথে দেখা হয় পারভেজের খালাতো ভাই হারুনের। হারুন সায়মাকে লিফট থেকে ছাদ দেখানোর নাম করে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে সায়মাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সায়মা চিৎকার করলে সায়মার মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করে। ধস্তাধস্তিতে সামিয়া নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সায়মা নিস্তেজ দেখে গলায় রশি পেঁচিয়ে সামিয়াকে টেনে রান্না ঘরে সিঙ্কের নিচে রাখে। এরপর পারভেজের বাসায় না ফিরে হারুন গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার ডাবরডাঙ্গায় পালিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে হারুন।
আব্দুল বাতেন বলেন, পারভেজের খালাতো ভাই হারুন। পারভেজের বাসায় থেকে গত দুই মাস ধরে তার রঙয়ের দোকানে কাজ করে আসছিল। পারভেজ জুলাই মাস থেকে হারুনকে তার দোকানে কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কারণ সে প্রতি সপ্তাহে কাউকে না বলে বাড়িতে চলে যেত। তারপরও খালাতো ভাই হওয়ায় কয়েকদিন ওই বাসায় ছিল। এরপর ধর্ষণ করে শুক্রবার সন্ধ্যায়ই পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আরো কেউ জড়িত আছে কি না আদালত হারুনকে রিমান্ডে দিলে জানা যাবে।
পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামিয়া হত্যার ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে পেতে ওই বাসার সব নারী-পুরুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া যায় হারুনই ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। রাতেই ডিবির টিম ঢাকা থেকে কুমিল্লায় চলে যায়। পরে তাকে গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এ দিকে সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে ধর্ষণে অভিযুক্ত হারুনকে মিডিয়া সেন্টারের সামনে দিয়ে আদালতে নেয়ার জন্য গাড়িতে তুলতে হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ডিবি পুলিশের একটি দল। তখন সাধারণ জনতা হারুনকে উদ্দেশ তরে গালিগালাজ করে। বিক্ষুব্ধ কয়েকজন এই নরপিশাচকে মারতে যায়। পরে পুলিশ তাকে নিয়ে দ্রুত চলে যায়।
গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে শিশু সায়মার খোঁজ পাচ্ছিল না তার পরিবার। আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নবনির্মিত ভবনটির নয় তলার ফাঁকা ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে মৃত সায়মাকে উদ্ধার করা হয়। ওই ভবনের ছয় তলায় বাবা-মায়ের সাথে থাকত সামিয়া। বাবা আব্দুস সালাম নবাবপুরের একজন হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সায়মা। সে ওয়ারী সিলভারডেল স্কুলে নার্সারিতে পড়ত।
সংবাদ সম্মেলনে সায়মার বাবা আব্দুস সালাম বলেন, ১০ মিনিট খেলেই বাসায় এসে পড়তে বসতে চেয়েছিল মেয়ে। মেয়েটি আর ফিরে এলো না। সায়মার মৃত্যুর পর বাসার কেউ খাবার খায়নি। সবাই সায়মার জামাকাপড় আর বই জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আমার পরীর মতো মেয়েকে যে কষ্ট দিয়ে মেরেছে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে তার ফাঁসি চাই।
দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, যাদের সন্তান আছে তারা এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে কিভাবে আপনার সন্তানদের দূরে রাখবেন, বিষয়টি ভেবে দেখবেন। আমি আমার মেয়েকে দেখে রাখতে পারিনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মেয়েটা আমার স্ত্রীকে বলে ১০ মিনিটের জন্য বাইরে গেল। এরপর আমার মেয়েটা আর ফিরল না, তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো। গত ২ দিন ধরে আমি একফোঁটা পানিও খাইতে পারিনি। ঘরে গেলে মেয়ের কাপড়চোপড়, ছবি দেখে আর ঠিক থাকতে পারি না। আমার পুরো পরিবারটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল।
কান্নাভেজা গলায় মেয়ের স্মৃতিচারণ করে আব্দুস সালাম বলেন, আজকের পর যেন ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে না যায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।