তারুণ্য ধরে রাখা কি আসলে সম্ভব?
-
বার্ধক্য মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অধ্যায়। যে শিশু আজকে জন্ম নিলো, জীবনের নানা পর্যায় পেরিয়ে তাকে একসময় বার্ধক্য মেনে নিতে হয়। তবে প্রত্যেক মানুষেরই সব সময় চেষ্টা থাকে নিজের তারুণ্য ধরে রাখার; শরীরে বয়সের ছাপ ঠেকিয়ে রাখার। এজন্য নানা ধরনের ব্যায়াম, নানা ধরনের খাদ্য বর্জন ও গ্রহণের প্রক্রিয়া তারা অবলম্বন করেন। লক্ষ্য একটাই- নিজেকে চিরসবুজ, চিরসতেজ রাখা। কিন্তু এসব করে কি বয়স ঠেকিয়ে রাখা যায়? বার্ধক্য আটকানো যায়? এ জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর কোনো বিজ্ঞানী কিংবা খ্যাতিমান চিকিৎসকেরও জানা নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই চলছে গবেষণা। এখনো তেমন কোনো সাফল্য এসেছে বলে শোনা যায়নি। তবে অদূর ভবিষ্যতে এসব গবেষণায় ভালো কোনো ফলাফল আসতে পারে বলে আশা করছেন গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা।
তারুণ্য ধরে রাখা কিংবা বার্ধক্য প্রতিরোধ করার বিষয়টিকে আসলে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করাও একটি কঠিন কাজ। এ বিষয়টির একটি সঠিক বা যথার্থ সংজ্ঞা নির্ধারণ করার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা দীর্ঘ দিন ধরেই চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে একেকটি গ্রুপ একেকভাবে বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে। যেমন বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে যারা বার্ধক্য প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণা করছেন, তারা বিষয়টিকে দেখছেন বয়স বাড়ার গতি শ্লথ করে দেয়া, প্রতিরোধ করা বা বয়স বাড়ার প্রক্রিয়াকে উল্টে দেয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে। তারা এ গবেষণাকে খুবই সম্ভাবনাময় হিসেবে অভিহিত করলেও বর্তমানে বা এ মুহূর্তে তেমন কোনো কিছু প্রমাণ হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞান হাজির করতে পারেনি, যা মানুষের বয়স বৃদ্ধির গতি থমকে দিতে বা শ্লথ করে দিতে পারে। (যদিও এদের কেউ কেউ খাদ্যে ক্যালরির মাত্রা সঠিক রাখা এবং নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর জোর দিচ্ছেন)।
চিকিৎসাবিদ্যা ও এসংক্রান্ত খ্যাতনামা ব্যবসায়ী মহলের কাছে বার্ধক্য প্রতিরোধের ওষুধের অর্থ হচ্ছেÑ বার্ধক্যজনিত রোগব্যাধিগুলো প্রথমেই বা শুরুর দিকেই সঠিকভাবে শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা করা। এটি বার্ধক্য প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার চেষ্টার ক্ষেত্রে একটি ভিন্নতর বিষয়। এ ছাড়াও এর সাথে নানা কৌশল ও থেরাপির প্রয়োগ করা হয় বর্তমানে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিমিত ক্যালোরি গ্রহণ বয়স বৃদ্ধিজনিত নানা শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
বার্ধক্য প্রতিরোধ নিয়ে মেডিক্যাল ব্যবসায় জমজমাট হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের পণ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক বড় বড় কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এসব কোম্পানি বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে তারুণ্য ধরে রাখতে তাদের পণ্য কিনতে প্রলোভিত করছে। এভাবে বাড়াচ্ছে তাদের ব্যবসা। বার্ধক্য প্রতিরোধ কথাটি মার্কেটে এখন একটি ব্র্যান্ড হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ক্রিম, লোশন, তেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে; যা শরীরের চামড়া সতেজ রাখবে বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ এগুলো দেদার কিনছে। একই ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যও বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আসলে কোম্পানির সেলসম্যানরা তাদের পণ্য বিক্রি বাড়ানোর সুবিধাটাই কেবল পাচ্ছে, বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বয়সের সাথে সম্পর্কিত কিছু রোগের সঠিক চিকিৎসা করার মাধ্যমে হয়তো কিছু লোকের আয়ু কিছু দিন বাড়তে পারে; কিন্তু কোনো পণ্য ব্যবহার করে বয়স কমিয়ে ফেলার মতো কোনো ঘটনা আদৌ ঘটে বলে এখনো স্বীকৃত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হৃদরোগ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ওষুধের সাথে বার্ধক্য প্রতিরোধের চিকিৎসার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ দুটো রোগের সঠিক চিকিৎসা করার মাধ্যমে একজন মানুষ অনেক দিন সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এটি কি বার্ধক্য প্রতিরোধের গবেষণা? বিজ্ঞানীরা বলছেন- না, কিন্তু কিছু মেডিক্যাল ও ব্যবসায়ী গ্রুপ বলছে- হ্যাঁ। বার্ধক্য প্রতিরোধ বা তারুণ্য ধরে রাখার ওষুধ বা পণ্যসামগ্রীর প্রচারণা নিয়ে বাজারে যা ঘটছে তা নিয়ে ব্যথিত বিজ্ঞানীরা। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোও এ বিষয়টি নিয়ে যে প্রতারণা চলছে তাতে হতাশা ব্যক্ত করেছে। বার্ধক্য প্রতিরোধ করার বিষয়টি বিজ্ঞান ও ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি খুবই মূল্যবান ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও এ থেকে মুনাফা অর্জন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সবগুলো গ্রুপ। বার্ধক্য প্রতিরোধ কথাটির অর্থ এবং এর ওপর আইনি বৈধতা লাভ করার জন্য ব্যবসায়ী গ্রুপ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বলতে গেলে একটা যুদ্ধই শুরু হয়ে গেছে। কারণ, কথাটা আইনি বৈধতা পেলে বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণায় যেমন মোটা অঙ্কের অর্থ আসার পথ সুগম হবে, তেমনিভাবে ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর রমরমা ব্যবসার পথও প্রশস্ত হবে বার্ধক্য প্রতিরোধের পণ্য বাজারজাত করার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে আবার ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ বিজ্ঞানীরা। কারণ তারা মনে করছেন, জনগণ যদি এটা বিশ্বাস করে ফেলে যে বার্ধক্য প্রতিরোধের বা তারুণ্য ধরে রাখার জন্য বাজারে যেসব পণ্য আসছে সেগুলো সত্যি সত্যিই কার্যকর, তাহলে তাদের গবেষণার জন্য আর কোনো অর্থ বরাদ্দ আসবে না।
বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বলছেন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, যথোপযুক্ত জীবন যাপন পদ্ধতি, ব্যায়াম ও আধুনিক ওষুধপত্র সেবনের মাধ্যমে সুস্থ জীবন যাপন করে আয়ু বাড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বিভিন্ন দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়াই এর প্রমাণ। বয়স বৃদ্ধিজনিত যেসব রোগব্যাধি আছে, সেগুলোর যদি সঠিক সময়ে আধুনিক চিকিৎসা করানো যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ অনেক দিন বাঁচবেন। এ ছাড়া এ বিষয় প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমেও অনেক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে বলে বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা দাবি করছেন। যেমন বয়স ৩৫ পেরোলেই মানুষের হাড় দুর্বল হতে থাকে। বাত বা অস্টিওপোরোসিসের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এ সমস্যায় শরীর ও চেহারায় বার্ধক্য বা বুড়োর ছাপ পড়ে যায়। এ ধরনের সমস্যা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাদ্য গ্রহণ করলে তা অনেকটাই কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে কেউ যদি কোনো পণ্য কিনে ব্যবহার করেন তাতে তার সমস্যার সমাধান হবে না বলেই বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মনে করেন।
গবেষণা কী বলছে?
বার্ধক্য প্রতিরোধ বা তারুণ্য ধরে রাখার উপায় দীর্ঘ দিন ধরেই গবেষণা করছেন আউব্রে দ্য গ্রে। তার মতে, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা প্রযুক্তি একদিন এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে, মানুষ তার বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া থামিয়ে দিয়ে বা তারুণ্য ধরে রেখে শত শত বছর বা হাজার বছরও সুস্থভাবে বাঁচবে। গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আমরা সে রকম সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তিনি মানুষের বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে একটি গাড়ির সাথে তুলনা করে বলেন, ব্যবহার হতে হতে গাড়ির আয়ু যেমন কমতে থাকে, তেমনিভাবে মানুষের শরীর ব্যবহৃত হতে হতে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর কর্মক্ষমতা কমে এক সময় তা অচল হয়ে পড়ে। তার মতে, শরীরবৃত্তীয় এই বাস্তবতা এড়ানোর সম্ভাব্য উপায় হলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে এই ক্ষতি সারিয়ে তোলা বা মেরামত করা। এ জন্য অবশ্য অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের গবেষণার জন্য দরকার প্রচুর অর্থ ও দীর্ঘ সময়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব তা অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।
একাডেমিকভাবে এবং প্রাইভেট সেক্টরের অনেকেই বার্ধক্য প্রতিরোধের বা তারুণ্য ধরে রাখার গবেষণার প্রতি জোর দিচ্ছেন, বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। আউব্রে দ্য গ্রের নিজের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্স রিচার্স ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে অধিকতর গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহে পাঁচটি কোম্পানির সাথে আলোচনা করেছেন। তারা সমঝোতায়ও পৌঁছেছেন। গ্রের মতে, বয়সকে পরাজিত করার গবেষণা ও এর সাফল্য ভবিষ্যতে কেবল একটি বড় শিল্পই হয়ে উঠবে না, এটি হবে খুবই লাভজনক এবং স্বাস্থ্যের জন্যও হবে চূড়ান্তভাবে উপকারী। আউব্রে দ্য গ্রে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে ওয়ার্ল্ড স্টেম সেল সম্মেলনে লিপসম্যাগ নামের একটি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক কাইরা পিকফকে সাক্ষাৎকার দেন নিজের গবেষণার বিষয়ে। সাক্ষাৎকারে তিনি তার গবেষণার বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
প্রায় এক যুগ আগে প্রকাশিত হয়েছে আউব্রে দ্য গ্রের সাড়া জাগানো বই ‘এনডিং এজিং’। বইটিতে তিনি স্টেম সেল গবেষণা ও জেনম এডিটিংসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন। এগুলোর মধ্যে কোন বিষয়টি তার গবেষণাকে বেশি প্রভাবিত করেছে জানতে চাইলে জবাবে গ্রে বলেন, সবগুলো বিষয়ই কোনো-না-কোনোভাবে আমার গবেষণাকে প্রভাবিত করেছে। আমরা যে লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছি, সে লক্ষ্যে পৌঁছতে এসব বিভিন্ন উপায়ে সহায়তা করেছে। বইটিতে আমরা শরীরচক্রের ক্ষতির সাতটি বড় ধরনের ক্ষেত্রের বর্ণনা দিয়েছি এবং এগুলো সারানো বা মেরামত করার সুনির্দিষ্ট উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি। সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বার্ধক্য প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ চিকিৎসায় সংস্কারের মাধ্যমে পুরনো টিস্যুর নবজীবন লাভ সম্পূর্ণ অঙ্গের জন্ম কিভাবে হবে বা কিভাবে কাজ করবে- জানতে চাইলে আউব্রে দ্য গ্রে বলেন, সম্পূর্ণ নতুন অঙ্গের জন্ম বা পুনঃউৎপাদন এ ক্ষেত্রে খুবই স্বল্পমেয়াদে কাজ করবে বা ভূমিকা রাখবে এবং দ্রুতই এটির মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। এর কারণ হচ্ছে, এটিকে কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন হবে অস্ত্রোপচারের, যেটা হবে খুবই আক্রমণাত্মক একটি কাজ। আমরা সেটাও করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলেই মনে হচ্ছে। টেকসই একটি সম্পূর্ণ নতুন অঙ্গ তৈরির জন্য আমাদেরকে আরো অনেক কাজ করতে হবে এবং আমরা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো অঙ্গ পরিবর্তন করার চেয়ে সেটাকে মেরামত বা সংস্কারের ওপরই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। সার্জারি ব্যতিরেকে মাইক্রোস্কপিক লেভেলে এ ধরনের মেরামতের জন্য সঠিক ধরনের স্টেম সেলের ইনজেকশন দিতে হবে। গ্রে আরো জানান, তার এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বছরে প্রয়োজন পাঁচ কোটি ডলার। এই অর্থ পেলে এখন আমরা যে গতিতে কাজ করছি তার চেয়ে তিন গুণ দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারব।
বার্ধক্য প্রতিরোধ নিয়ে এখন আপনি ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছেন। ২০২১ সালের দিকে মানুষের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করার সময় নির্ধারণ করেছেন কি না জানতে চাইলে গ্রে বলেন, বিষয়টি প্রায় সে রকমই বলা যায়। যেহেতু আমরা শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হই বা মোকাবেলা করি, সেজন্য এসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা বা মেরামত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের থেরাপিও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। থেরাপিগুলোও একেকটি আলাদাভাবে তৈরি করার বা গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়ে। ক্ষতি মেরামত প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে গিয়ে থেরাপিগুলো একটি আরেকটির সাথে ক্রিয়া করে। এ সময় একটি ক্ষতি মেরামতের প্রক্রিয়া হয়তো আরেকটি ক্ষতির পথ তৈরির গতিকে শ্লথ করে দেয়। এভাবেই সার্বিক মেরামত প্রক্রিয়াটি এগিয়ে চলে এবং এই থেরাপিগুলোর কোনো কোনোটির প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন অন্যগুলোর চেয়ে অনেক সহজ। যে সহজতর উপাদানগুলো আমাদের বেশি প্রয়োজন বিশেষত স্টেম সেল থেরাপির, সেগুলো ইতোমধ্যেই ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলোর তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে। কাজেই যখন আমি ২০২১ সাল কিংবা ২০২০ সালের প্রথমার্ধের মতো সময়সীমার কথা বলি তখন ধরে নিতে হবে যে আমরা থেরাপির জটিল উপাদানগুলো নিয়েই ভাবছি।
সাম্প্রতিক সময়ের কোন অগ্রগতিটি নিয়ে আপনি উত্তেজনা বোধ করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রে বলেন, যদি বিগত কয়েক বছরের দিকে আমি ফিরে তাকাই তাহলে বিশেষভাবে গর্ববোধ করি কয়েকটি জটিল ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের জন্য। আপনি যদি আমাদের ওই সাতটি উপাদানের দিকে ভালোভাবে লক্ষ করেন তাহলে দেখা যাবে যে, এর মধ্যে দু’টি উপাদানের ক্ষেত্রে প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে আমরা একই জায়গায় আটকে ছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই বাধা দু’টি পেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। দুই বছর আগে আমরা সাইন্স ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছি, যেখানে চামড়ায় ভাঁজ পড়া বা বলিরেখা পড়া এবং উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী কারণ তুলে ধরেছি। এক বছর আগে আমরা ডিএনএ নিয়েও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছি, যেটাতে আমরা ডিএনএ নিয়ে নতুন পদ্ধতি তুলে ধরেছি।
বার্ধক্য প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বর্তমান কোনটাকে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন- প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ আইনগত কাঠামো, ব্যয় অথবা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি কোনটা- এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রে বলেন, আমরা এগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে দেখতে চাই না। প্রযুক্তিগত দিক একটি বিষয়, কিন্তু আমরা জানি আমরা কোথাও যাবো, আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। অন্যগুলোর প্রতিটিই একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। তবে আইনগত বাধাও একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। ল্যাবরেটরিতে যখন আমরা এটা প্রমাণ করতে পারব যে, আমাদের এখানে থাকা বুড়ো ইঁদুরগুলো অন্য বুড়ো ইঁদুরের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ আছে এবং তারা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সময় ধরে বেঁচে আছে, তখন সবাই এটা জানবে।
আশা করা হচ্ছে, ইঁদুরের বার্ধক্য প্রতিরোধ করার গবেষণার ক্ষেত্রে আপনি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই সফলতা লাভ করবেন। মানুষের ক্ষেত্রে সেটা কত দিন লাগতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রে বলেন, ইঁদুরের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের মধ্যে সফল হবো বলে আমি আশা করছি। তবে কোনো কারণে সময়টা ১৫-২০ বছরও লেগে যেতে পারে। একইভাবে মানুষের বার্ধক্য প্রতিরোধের গবেষণায় সাফল্য পেতে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ৫০ : ৫০ চান্স আছে। আবার ১০ শতাংশ চান্স আছে যে, আমরা হয়তো কয়েক শ’ বছরেও এ ক্ষেত্রে সফলতা পাবো না।
দীর্ঘজীবী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সুবিধাটির বিষয়ে সংশয়বাদী লোকজনকে আপনি কী বলবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রে বলেন, আমি বলব যে মানুষের দীর্ঘজীবী বিষয়ে কোনো প্রশ্নকে আমি বলব ভুল প্রশ্ন। কারণ, দীর্ঘ জীবন হিসেবে যে বিষয়টিকে নির্ধারণ করা হয় তা আসলে ঘটে থাকে মানুষের স্বাস্থ্যের সাইড অ্যাফেক্ট বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে। আপনি কত দীর্ঘ সময় আগে জন্মেছেন নাকি সাম্প্রতিক সময়ে জন্মেছেন সেটি বিষয় নয়, বরং আপনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আমরা আপনার এই অসুস্থতাকে ঠেকাতে বা প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে তাড়াতাড়িই মারা যাবেন। আর আপনি যদি স্বাস্থ্যবান হন তাহলে আপনার তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার আশঙ্কা নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যদি আমরা লোকজনকে স্বাস্থ্যবান ও তারুণ্যে ভরপুর রাখতে পারি তাহলে তিনি যত আগেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন তার জীবন হবে দীর্ঘমেয়াদি।
এখন যারা জন্মগ্রহণ করছে তারা আপনার ওই গবেষণার সুবিধা কিভাবে পাবে জানতে চাইলে গ্রে বলেন, এখন যারা মধ্যবয়সে আছে তাদেরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ আছে। স্মরণ করে দেখুন, আমি বলেছি আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমাদের এ গবেষণার সুফল পাওয়ার ৫০ : ৫০ চান্স আছে। কাজেই যখন আপনি ওই জায়গায় পৌঁছবেন তখন আপনি বায়োলজিক্যালি ৭০-৮০ বছরের থাকবেন না, বরং আপনি বায়োলজিক্যাল ৩০-৪০ বছর বয়সের কোঠায় থাকবেন। আপনি যত আগেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, আপনি পরিপূর্ণ একটি যুবকের মতোই থাকবেন।