পাক-ভারত যুদ্ধ : জানা-অজানা কথা
-
(১৯৪৭ সাল। ১৪ আগস্ট দিন পেরিয়ে রাত ১২টা ০১ মিনিটে ভারতের শেষ ইংরেজ শাসক লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের হাত দিয়ে উপমহাদেশ স্বাধীন হয় দু’টি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে- ভারত ও পাকিস্তান। জন্ম থেকেই অবিশ্বাস, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও অনিঃশেষ বৈরিতার যে সূচনা, আজো তার অবসান হয়নি। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে দু’টি অংশ নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান টিকে থাকুক, প্রথম থেকেই ভারতের শীর্ষ নেতা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউই তা চাননি। অন্য দিকে শুরু থেকেই বিশাল ও শক্তিশালী ভারতের পাশে পাকিস্তান অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কটে ভুগেছে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতাকে পরিপুষ্ট করার চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কাশ্মির নিয়ে দু’বার এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বে ১৯৭১ সালে একবার মোট তিনবার সর্বাত্মক যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছে। তারপর দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি একবার সীমিত সংঘর্ষ (কারগিল সংঘর্ষ), তারপর পাকিস্তানে দু’দফা ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ভারতে একবার পাকিস্তানের সীমিত বিমান হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা হোক, ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের জন্য অতীতে এ দু’টি দেশের মধ্যে সঙ্ঘটিত একাধিক যুদ্ধের কিছু জানা-অজানা বিষয় পরিবেশন করা হলো।)
কাশ্মির যুদ্ধ
ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায়, ভারত-পাকিস্তান সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রথম সূচনা হয় কাশ্মির নিয়ে। ভারত সব স্বভাবিক রীতিনীতির মূলে কুঠারাঘাত করে মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মিরকে যেভাবে ভারতভুক্ত করে তা পাকিস্তানের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় সিদ্ধান্ত হয় যে স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীন থাকতে অথবা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে। এ সময় কাশ্মিরের রাজা হরি সিং স্বাধীন থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু কাশ্মিরের মুসলমানদের বড় অংশই রাজার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেননি। তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পুঞ্চ ও মিরপুর এলাকায় মুসলমানরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ সময় পাখতুন খোয়া (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) এলাকার বহু মুসলমান এসে সংহতি প্রকাশ করে তাদের সাথে যোগ দেয়। এর পেছনে পাকিস্তানের ইন্ধন আছে বলে সন্দেহ করে রাজা হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চাইলে ভারত তাকে সাফ জানিয়ে দেয় যে, শুধু ভারতে যোগ দিলেই তা পাওয়া সম্ভব। রাজা তা মেনে নেন। ভারত সাথে সাথে কাশ্মিরে সৈন্য পাঠায়। পাকিস্তান রাজা হরি সিং-এর ভারতে যোগদানের বিষয়টি অন্যায্য বলে জানায়। ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানি বহিরাগতদের কাশ্মির থেকে তাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থায় গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ সামরিক ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ডগলাস গ্রেসিকে নির্দেশ দেন। কিন্তু কাশ্মিরের ভারতীয় সৈন্যরাও তখন যেহেতু ব্রিটিশ পতাকাধারী ছিল তাই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে জেনারেল গ্রেসি অস্বীকৃতি জানান। পরে পাকিস্তান যখন সৈন্য পাঠাতে সক্ষম হয় ততদিনে জম্মু-কাশ্মির উপত্যকা ও লাদাখ ভারত দখল করে নিয়েছিল। পাকিস্তান বাল্টিস্তান ও গিলগিটসহ কাশ্মিরের দুই-পঞ্চমাংশ মাত্র এলাকা নিজেদের অধিকারে আনতে সক্ষম হয়। কার্যত কাশ্মিরের সমৃদ্ধ অংশটুকুই ভারতের দখলে চলে যায়। ২১ অক্টোবর, ১৯৪৭ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮ পর্যন্ত কাশ্মিরে থেমে থেমে যুদ্ধ চলতে থাকে। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু বিষয়টি জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করেন। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর স্ব স্ব সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে পরবর্তীতে কাশ্মিরি জনগণ যাতে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীন থাকা বা ভারত বা পাকিস্তান যে কোনো একটি দেশে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করতে পারে সেজন্য জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে কাশ্মিরে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। কিন্তু ভারত যেমন কখনোই সে গণভোটের আয়োজন করেনি তেমনি জাতিসঙ্ঘও আশ্চর্যজনকভাবে এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসেনি।
দ্বারকা অভিযান
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কাশ্মির ও পাঞ্জাব ফ্রন্টে দু’দেশের স্থল ও বিমানবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলতে থাকে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উত্তরে সামরিক চাপ কমাতে ও ভারতীয় বিমানবাহিনীকে অন্য আরেকটি ফ্রন্টে ব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের নৌবাহিনী ব্যবহার ও দ্বারকা নৌ অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি অবশ্য অপারেশন সোমনাথ নামেও পরিচিত। দ্বারকা ছিল করাচি থেকে ২০০ কিমি দূরে ভারতের গুজরাট রাজ্যের জামনগর জেলায় অবস্থিত একটি ছোট উপকূলীয় শহর। এখানেই প্রাচীনকালের সুবিখ্যাত সোমনাথ মন্দির অবস্থিত। যদিও কালের বিবর্তনে ওই মন্দির ও একদা সমৃদ্ধ শহর উভয়েরই খ্যাতি একেবারে ম্লান হয়ে পড়েছিল। সামরিক দিক দিয়ে কার্যত এর কোনো গুরুত্ব ছিল না। এখানে থাকার মধ্যে ছিল একটি রাডার স্টেশন ও একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। পাকিস্তান নৌ গোয়েন্দা দফতর মনে করত যে এই রাডারের মাধ্যমে ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলোকে বিকন নির্দেশনা দেয়া হয়।
পাকিস্তান সামরিক কর্র্তৃপক্ষ দ্বারকা আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। তদনুযায়ী ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজগুলো করাচি বন্দর ত্যাগ করে। মোট সাতটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি সাবমেরিন এ অভিযানে অংশ নেয়। এগুলো হলো : যুদ্ধজাহাজ পিএনএস বাবুর, পিএনএস খাইবার, পিএনএস বদর, পিএনএস জাহাঙ্গীর, পিএনএস শাহ্জাহান, পিএনএস আলমগীর, পিএনএস টিপু সুলতান ও সাবমেরিন পিএনএস গাজী। দ্বারকা উপকূলে পৌঁছার পর রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে যুদ্ধজাহাজগুলো একযোগে আক্রমণ শুরু করে। ভারতীয় মতে, সাতটি যুদ্ধজাহাজ ২০ মিনিট ধরে গোলাবর্ষণ করে। প্রতিটি জাহাজ থেকে ৫০টি করে গোলা নিক্ষেপ করা হয়।
ভারতীয় মতে, পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজগুলোর গোলা বর্ষণে দ্বারকার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ, নিক্ষিপ্ত গোলার সবই সোমনাথ মন্দির থেকে রেডিও স্টেশন পর্যন্ত তিন কিমি. ফাঁকা এলাকায় পড়ে। তবে গোলাবর্ষণে কিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে স্থানীয় রেলওয়ে গেস্ট হাউসের একটি অংশ ভেঙ্গে পড়ে। এছাড়া দ্বারকার অ্যাসোসিয়েটস সিমেন্ট ফ্যাক্টরিটি ধ্বংস হয়ে যায়। এর ধোঁয়া ২০ কিমি দূরে সাগরে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজগুলো থেকে দূরবীণে দেখা যায়। তবে রাডার স্টেশনের কোনো ক্ষতি হয়নি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরে বেশ কিছু অবিস্ফোরিত শেল উদ্ধার করে। নিয়তির পরিহাস যে এগুলোতে ‘ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স’ লেখা ছিল। অর্থাৎ এগুলো তৈরি হয়েছিল চল্লিশের দশকে ব্রিটিশদের প্রয়োজনের জন্য। পরে এগুলো পাকিস্তানের ভাগে পড়ে।
দ্বারকা অভিযানের সমন্বয়কারী ছিলেন কমোডর এস এম আনোয়ার। এ অভিযানের যৌক্তিকতা নিয়ে খোদ পাকিস্তানেই প্রশ্ন ওঠে যে দ্বারকার মত একটি গুরুত্বহীন ছোট শহরে ৮টি পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ কি অভিযান চালালো? এ থেকে কি লাভই বা পাকিস্তানের হল? এসব প্রশ্নের কোন জবাব পাওয়া যায়নি। তবে পাকিস্তান এর পর থেকে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বরকে নৌ বাহিনীর বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
দ্বারকা অভিযানের পিছনে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের ৪টি উদ্দেশ্য ছিল। এক. কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণের চাপ কমানো, দুই. ভারতীয়দের নৈতিক মনোবলে আঘাত হানা, তিন. দ্বারকার রাডার স্টেশনটি ধ্বংস করা ও চার. ভারতীয় নৌবাহিনীকে যুদ্ধে টেনে এনে সাবমেরিন গাজীর শিকারে পরিণত করা। দ্বারকায় পাকিস্তানি অভিযানের পর ভারতীয় পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে খুব হৈচৈ হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার জন্যও জোর দাবি ওঠে। কিন্তু, ভারত সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে। তখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে ভারত পাকিস্তানের সাথে ‘৬৫ সালের যুদ্ধে তার নৌবাহিনীকে একবারেই ব্যবহার করতে চায়নি। কার্যত ভারত শুধু স্থল ও আকাশযুদ্ধেই লিপ্ত থাকতে চেয়েছে। জানা যায়, এ সময় ভারতের একমাত্র বিমানবাহী জাহাজ ‘বিক্রান্ত’ ও অন্য ২৩টি যুদ্ধ জাহাজের অধিকাংশই মেরামত কাজের জন্য বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে ছিল।
দ্বারকা অভিযানের ঘটনা পরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য আশাতীত সুফল বয়ে আনে বলে দেখা যায়। ঐ বছরই ভারতীয় নৌবাহিনীর বার্ষিক বাজেট ৩৫ কোটি রুপি থেকে বৃদ্ধি করে ১১৫ কোটি রুপি করা হয়। তখন থেকেই ভারত তার নৌবাহিনীর আধুনিকায়নের জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু আধুিনক যুদ্ধ জাহাজ ও সাবমেরিন সংগ্রহ করা হয়। অন্যদিকে অর্থ সঙ্কটের কারণে পাকিস্তানের নৌবাহিনীর উন্নয়ন কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়ে। ফলে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কোনো আধুনিকায়ন ঘটেনি। অচিরেই ভারত এর সুফল লাভ করতে সক্ষম হয়। মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় যুদ্ধে শক্তিশালী ভারতীয় নৌবাহিনী এক দিকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানে নৌ অবরোধ সৃষ্টি করে, অন্য দিকে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেই সমুদ্র অবরোধের পাশাপাশি করাচি বন্দরে দু’দফা হামলা চালিয়ে পাকিস্তান নৌবাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি সাধনসহ পাকিস্তানের পরাজয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
বাঙালি বৈমানিকের বীরত্ব
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এক বাঙালি বৈমানিক অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। স্বল্প সময়ে অধিক সংখ্যক জঙ্গি বিমান ধ্বংসের বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেন তিনি যা আজো কেউ ভাঙতে পারেনি। তিনি হলেন মুহাম্মদ মাহমুদ আলম। তার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, তিনি ১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের পর তার পরিবার পাকিস্তানে চলে যায় ও করাচিতে বসবাস শুরু করে। তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে পাঞ্জাবের সারগোদা বিমান ঘাঁটিতে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি ছিলেন এফ-৮৬ স্যাবর জেট জঙ্গি বিমানের একটি স্কোয়াড্রনের অধিনায়ক। ৬ সেপ্টেম্বর আলম তার জঙ্গি বিমান নিয়ে ভারতের আকাশে ডগ ফাইটে লিপ্ত হন। তিনি দুটি হান্টার বিমান ধ্বংস ও ২টি বিমানের ক্ষতি সাধন করেন। ৭ সেপ্টেম্বর পুনরায় আকাশযুদ্ধে তিনি ৩০ সেকেন্ডে ৪টি ভারতীয় হান্টার বিমান ভূপাতিত ও পরমুহূর্তে ৫ম আরেকটি বিমান ভূপাতিত করেন। এভাবে ১ মিনিটেরও কম সময়ে তিনি মোট ৫টি জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেন। ওই যুদ্ধে মোট ৯টি ভারতীয় জঙ্গিবিমান ভূপাতিত ও ২টি জঙ্গি বিমানের ক্ষতি সাধন করেন তিনি। পাকিস্তান সরকার অসীম বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাকে সিতারায়ে জুরাত পদকে ভূষিত করে। আরো পরে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন। এরপর তার ব্যাপক মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি মদ্যপানের ঘোর বিরোধী হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাঙালি বলে তাকে আকাশে উড়তে দেয়া হয়নি। ১৯৮২ সালে তিনি এয়ার কমোডর হিসেবে পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর তিনি করাচিতে নিজ বাড়িতে অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে ধর্মীয় পরিবেশে দিন যাপন করেন। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান।
১৯৭১ সালের নৌযুদ্ধ
১৯৭১ সালে ভারতের সাথে তৃতীয় বারের মতো অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান। কার্যত, ১৯৬৫ সালের দ্বিতীয় দফা যুদ্ধের পর বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ভারত সামরিক ক্ষেত্রে বিপুল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে। ফলে স্থল ও বিমানবাহিনীর মতো তার নৌবাহিনীরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় উভয় দেশের নৌশক্তির তুলনামূলক চিত্র-১ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হবে :
’৭১-এ পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের নৌশক্তি
১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় দফা যুদ্ধ আসন্ন হয়ে উঠলে সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে দু’দেশের সামরিক শক্তির বৈষম্য প্রকট হয়ে চোখে পড়ে। দেখা যায়, স্থল, আকাশ বা নৌশক্তিতে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বিশেষ করে এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় পাকিস্তানিদের অবহেলা বা অপারগতা দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে। তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর ছিল মাত্র ৪টি ডিভিশন (তাও পূর্ণাঙ্গ নয়)। বিমান প্রতিরক্ষার জন্য ছিল মাত্র এক স্কোয়াড্রন এফ-৮৬ স্যাবর জেট। ভারতের অত্যাধুনিক মিগ-২১ জঙ্গি বিমানের সমকক্ষ ছিল না সেগুলো। বিশেষ করে সংখ্যাল্পতার কারণে যুদ্ধ শুরুর মাত্র দু’তিন দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ ভারতের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এবং নদীমাতৃক পূর্ব পাকিস্তানে কোন নৌ স্কোয়াড্রন ছিল না। এ সময় পাকিস্তান ইস্টার্ন ন্যাভাল কমান্ডের প্রধান বা ফ্ল্যাগ অফিসার কমান্ডিং ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরীফ। ক্যারিয়ারের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অফিসার। পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর নাজুক অবস্থা দেখে তিনি কেন্দ্রের কাছে অনেক সংস্কার প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু তা উপেক্ষিত হয়। তার অধীনে কোনো যুদ্ধ জাহাজ নয়, মাত্র গোটা কয় গানবোট ছিল। এগুলো হলো : পিএনএস সিলেট, পিএনএস রাজশাহী, পিএনএস কুমিল্লা, পিএনএস যশোর ও পিএনএস বালাঘাট। এসব গানবোট দিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দমন তৎপরতা চালানো গেলেও কোনো নৌবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তান নৌবাহিনী কমান্ডের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে তাদের কাছে যেসব যুদ্ধজাহাজ আছে তা দিয়ে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিধান করাও সম্ভব নয়। উপরন্তু, পূর্ব বা পশ্চিমে কোথাও পাকিস্তানি নৌবহরকে অতিপ্রয়োজনীয় বিমান ছত্রছায়া দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই তারা পূর্ব পাকিস্তানকে প্রথম থেকেই তাদের হিসাব থেকে বাদ দিয়ে রেখেছিল। যা হোক, পূর্ব পাকিস্তানে যে গানবোটগুলো ছিল এগুলোর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২০ নট ( ৩৭ কিমি)। এ গুলো ২৯ জন পর্যন্ত নাবিক বহন করতে পারত। ভারি মেশিনগান দিয়ে এগুলো সজ্জিত করা হয়েছিল। রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজির ডানহাত ছিলেন। তিনি এসব গানবোট দিয়ে নিয়াজির বাঙালি দমন তৎপরতায় মদদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি গানবোটগুলো ছিল চট্টগ্রামে। এদিন ভারতীয় বিমান হামলায় পিএনএস রাজশাহী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর পিএনএস কুমিল্লা ধ্বংস হয়। ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী খুলনায় ২টি পেট্রোল বোট ডুবিয়ে দেয়। ৬ ডিসেম্বর পিএনএস সিলেট, ৯ ডিসেম্বর পিএনএস বালাঘাট ও ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী পিএনএস যশোর ধ্বংস করে। এদিকে বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পিএনএস রাজশাহীকে মেরামত করে লে: কমান্ডার শিকদার হায়াত ভারতের নৌ অবরোধ এড়িয়ে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের আগেই মালয়েশিয়া পৌঁছতে সক্ষম হন।
পিএনএস গাজী ধ্বংস
পিএনএস গাজী পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রথম সাবমেরিন। পাকিস্তানই শুধু নয়, উপমহাদেশ এমনকি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও এটি প্রথম সাবমেরিন। গাজী আসলে ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর একটি সাবমেরিন। এর নাম ছিল ডায়াবলো। ১৯৪৫ সালের ৩১ মার্চ এটি মার্কিন নৌবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়। মার্কিন নৌবাহিনীতে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৪ সালে এটিকে পাকিস্তান নৌবাহিনী লিজ নেয়। ১৯৬৪ সালের ১ জুন পিএনএস গাজী নামে তা পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। উল্লেখ্য, ২৮টি টর্পেডো নিক্ষেপের ক্ষমতাসম্পন্ন গাজীকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরের আগে তুরস্কে ব্যাপকভাবে পুনঃসজ্জিতকরণসহ মাইন পাতার উপযোগী করে তোলা হয়। ৩১১ ফুট দীর্ঘ ও ২৭ ফুট প্রস্থ, ডুবন্ত অবস্থায় ৯ নট (১৬ কিমি.), ভাসমান অবস্থায় ২০ নট (৩৭ কিমি.) গতিবেগসম্পন্ন গাজী ছিল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য বড় ধরনের হুমকি যদিও ওই সময় এটি কোনো যুদ্ধে অংশ নেয়নি। ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে পাকিস্তান নৌবাহিনীর দ্বারকা অভিযানকালে অন্য ৭টি যুদ্ধ জাহাজের সাথে গাজীও ছিল। বলা দরকার, শুরু থেকেই পাকিস্তান গাজীর ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতীয় নৌবাহিনীকে যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ভারত আকাশ ও স্থলযুদ্ধের মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে গাজী প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনের সুযোগ পায়নি।
১৯৭১ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ আসন্ন হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে গাজীর গুরুত্ব নতুন করে বৃদ্ধি পায়। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ধারণা করে যে ভারত বিমানবাহী জাহাজ ‘বিক্রান্ত’কে তার ক্যারিয়ার গ্রুপসহ আন্দামান সাগরে মোতায়েন করবে। সেখান থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব খুব বেশি নয়। উল্লেখ্য, এ সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নৌ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে ছিল। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ কোন যুদ্ধ জাহাজই পূর্ব পাকিস্তানে রাখেনি। এ অবস্থায় বিক্রান্ত’র মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তানের কাছে গাজী ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। অন্যদিকে ভারতও এটা ভালোভাবেই জানত। সুতরাং তারা তাদের একমাত্র বিমানবাহী জাহাজ রক্ষার ব্যাপারে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। গাজী যাতে বিক্রান্ত’র কোনোক্রমেই নাগাল না পায় সে জন্য ১২ নভেম্বরের দিকে বিক্রান্তকে তার এসকর্ট গ্রুপসহ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের কাছে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অজানা।
এদিকে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ গাজীকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন শাখার কমান্ডিং অফিসার ও জুনিয়র অফিসাররা এর বিরোধিতা করেন। তারা যুক্তি দেখান যে গাজীকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো ঠিক হবে না এ কারণে যে, প্রথমত চট্টগ্রাম বন্দরে সাবমেরিন মেরামতের কোনো সুবিধা নেই, দ্বিতীয়ত, লজিস্টিক সুবিধা ও বিনোদন সুবিধার অভাব, সর্বোপরি জরুরি প্রয়োজনে গাজী কোথাও আশ্রয় নিতে পারবে না। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ গাজীর কমান্ডে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। কমোডর জাফর মুহাম্মদ খান নতুন কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে গোয়েন্দা টহলের লক্ষ্যে গাজী করাচি বন্দর ত্যাগ করে। ২৬ নভেম্বর তার রিপোর্টিং তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
গাজী তার টহল মিশনে ১৯ নভেম্বর সিংহল উপকূলে ও ২০ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে। ২৩ নভেম্বর মাদ্রাজ উপকূলে সে বিক্রান্ত’র সন্ধান করতে থাকে। কিন্তু কোনো সন্ধান না পেয়ে সে বিশাখাপত্তনমের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল আর. এন. কৃষ্ণা ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ আইএনএস রাজপুতকে জানান যে, গাজীকে সিংহল উপকূলে দেখা গেছে এবং এখন সেটি অবশ্যই মাদ্রাজ পেরিয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি গাজীর পিছু নিতে রাজপুতকে নির্দেশ দেন। রাজপুত ৩ ডিসেম্বর রাত ১১টা ২২ মিনিটে বিশাখাপত্তনম বন্দর থেকে সাগরের দিকে অগ্রসর হয়।
৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের কিছু পর গাজী সাগরের গভীরে রহস্যজনকভাবে ধ্বংস হয়। এ সময় সাগর গভীরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ৯ ডিসেম্বর গাজী ধ্বংস হওয়ার কথা প্রচার করে। এর পুরো কৃতিত্ব দেয়া হয় রাজপুতকে। তবে পাকিস্তানি সূত্রে দাবি করা হয় যে অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণজনিত কারণে কিংবা বিশাখাপত্তনমের উপকূলে মাইন পাতার সময় দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরণে গাজী ধ্বংস হয়। উল্লেখ্য, ঐদিন বিশাখাপত্তনম বন্দরে অবস্থানরত একটি মিসরীয় বাণিজ্য জাহাজের একজন অফিসার পরে জানান, বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার অন্যূন পৌনে এক ঘণ্টা পর দু’টি ভারতীয় জাহাজকে বন্দর ত্যাগ করতে দেখা যায়। যা হোক, গাজী যেখানে ধ্বংস হয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সে স্থানের তীর বরাবর বিশাখাপত্তনম বন্দরে একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেছে।
২৬ নভেম্বর গাজীর করাচি বন্দরে রিপোর্ট করার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার পরও গাজীর তরফ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় বেস কমান্ডার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শুরু হয় গাজীর সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠার বেপরোয়া প্রচেষ্টা। কিন্তু সে সংযোগ আর কোনো দিনই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গাজীর সাথে কেন সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি, তার কোনো জবাব মেলেনি।
’৭১-এর যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ব্যয়ে সাগরতল থেকে গাজীর ধ্বংসাবশেষ উত্তোলনে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু ভারত সরকার তাদের কাউকেই অনুমতি দেয়নি।
আইএনএস খুকরির সলিল সমাধি
পিএনএস হাঙর ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর দ্বিতীয় সাবমেরিন। ফ্রান্সের কাছ থেকে পাকিস্তান ১৯৭০ সালে ডাফনে শ্রেণীর এ সাবমেরিনটি কেনার পর ওই বছর ২০ ডিসেম্বর এটি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। এটির দৈর্ঘ ছিল ১৮০ ফুট। গতিবেগ পানির নিচে প্রায় ৯ নট (১৫ কিমি.), পানির উপরে ১২ নট (২২ কিমি.)। ১২টি টর্পেডো বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে সক্ষম হাঙরকে ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান আসন্ন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পশ্চিম পাকিস্তানের উপকূল রক্ষায় মোতায়েন করা হয়।
১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর হাঙর ভারতের কাথিওয়াড় উপকূল বরাবর টহল দিতে বের হয়। টহল চলাকালে সাবমেরিনটি পানির উপরে দু’টি জাহাজের অবস্থান শনাক্ত করে। এ সময় হাঙর আক্রমণাত্মক অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করলেও শত্রু জাহাজ দু’টির গতিবেগ বেশি থাকায় তা সম্ভব হয়নি। তবে হাঙর জাহাজ দুটির পরিচয় জানতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালের ২ ও ৩ ডিসেম্বর রাতে বোম্বে উপকূলে সাগরতলে অপেক্ষমাণ অবস্থায় হাঙর ভারতীয় নৌবাহিনীর অনেক যুদ্ধ জাহাজের সমাবেশ থেকে বুঝতে পারে যে করাচির ওপর হামলা আসন্ন। এই নৌবহর তার খুব কাছ দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হাঙর সব প্রকার রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখায় তার উপস্থিতির বিষয়টি ভারতীয়দের অজ্ঞাত থেকে যায়। সে তৎক্ষণাত করাচি নৌ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করে। কিন্তু তার এ বার্তা ভারতীয়রা ধরে ফেলে। ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর বেতার সঙ্কেত নির্ণয়কারী যন্ত্রে গুজরাটের দিউ বন্দর থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরে একটি পাকিস্তানি সাবমেরিনের উপস্থিতি নির্ণীত হয়। তৎক্ষণাৎ সাবমেরিন বিধ্বংসী ফ্রিগেট আইএনএস খুকরি ও আইএনএস কিরপানকে ওই সাবমেরিনের সন্ধানে পাঠানো হয়। কেউ কেউ মনে করেন যে ভারতের কাছে সাবমেরিন বিধ্বংসী বিমান না থাকায় আধুনিক ডাফনে শ্রেণীর সাবমেরিনের মোকাবিলায় ফ্রিগেট দু’টি পাঠানো হয়। ৯ ডিসেম্বর সকালে হাঙর কাছাকাছি দূরত্বে ভারতীয় ফ্রিগেট দু’টির অবস্থান ও পরিচয় শনাক্ত করে। কিন্তু পরে সে আবার তাদের হারিয়ে ফেলে। ঐদিন সন্ধ্যায় হাঙর পুনরায় ফ্রিগেট দু’টিকে খুঁজে পায়। কমান্ডার আহমেদ তাসনীম সাগরের গভীরে ডুব দেয়া ও সব ট্রান্সমিশন বন্ধ করে আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিরপান ও খুকরি হাঙরের আক্রমণের পাল্লায় আসার পর রাত ৭টা ৫৭ মিনিটে কিরপানকে লক্ষ্য করে প্রথম টর্পেডো নিক্ষেপ করা হয়। তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কিরপানের উপর টর্পেডো ছোঁড়া হয়েছে - এটা বুঝতে পারার সাথে সাথে কিরপানের ক্যাপ্টেন ফুল স্পিড তুলে পালাতে শুরু করেন। এদিকে খুকরি সোজা হাঙরকে লক্ষ্য করে ছুটে আসে। হাঙর খুকরির উদ্দেশে তার দ্বিতীয় টর্পেডো নিক্ষেপ করে। খুকরি আঘাতটি এড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে ১৯৪ জন অফিসার ও নাবিকসহ খুকরি আরব সাগরের অতলে নিমজ্জিত হয়। খুকরির ক্যাপ্টেন মহেন্দ্রনাথ মুল্লা জাহাজ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান ও নিজের জাহাজের সাথেই সলিল সমাধি বরণ করেন।
এদিকে দূরে সরে গেলেও কিরপানের কমান্ডিং অফিসার খুকরির পরিণতি দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি কিরপানকে নিয়ে পূর্ণবেগে হাঙরের দিকে ছুটে আসেন এবং আক্রমণ চালান। কিরপান ডেপথ চার্জ শুরু করে। এ সময় হাঙর তার তৃতীয় টর্পেডো নিক্ষেপ করে এবং তা কিরপানের পেছন দিকে আঘাত হানে। তখন কিরপান রণে ভঙ্গ দেয়। এদিকে হাঙরও লড়াই ছেড়ে পশ্চিমে গভীর পানির দিকে অগ্রসর হয়। আরো ৪ দিন ওই অঞ্চলে টহল দেয়ার পর হাঙর নিরাপদেই নিজ বন্দরে প্রত্যাবর্তন করে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কোনো সাবমেরিন কর্তৃক যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসের এটাই প্রথম ঘটনা। অন্য দিকে, ভারতীয় নৌবাহিনীর ইতিহাসে এটিই তাদের কোনো যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংসের একমাত্র ঘটনা। গুজরাটের দিউ-এর উপকূলবর্তী আরব সাগরে এ ঘটনা ঘটে। পরে ভারতীয় নৌবাহিনী ঘটনাস্থল বরাবর তীরে পাহাড়ের ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে।
অপারেশন ট্রাইডেন্ট
অপারেশন পাইথন
৪ ডিসেম্বর অপারেশন ট্রাইডেন্টের মাত্র ৪ দিন পর ৮ ডিসেম্বর রাতে ভারত করাচি বন্দরে দ্বিতীয় দফা হামলা চালায়। করাচি বন্দরের বাইরের সাগরে ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজের আনাগোনা থেকে পাকিস্তানিরা অচিরেই করাচি বন্দরে আরেক দফা হামলার আশঙ্কা করছিল। এজন্য তারা তাদের নৌগোয়েন্দা বিমানের নজরদারি বৃদ্ধি করে। নিজেদের যুদ্ধ জাহাজের বিরাট ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক জাহাজের সাহায্যে বিষয়টি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল। এ অবস্থায় ভারত করাচি বন্দরে দ্বিতীয় দফা আঘাত হানে। মিসাইল বোট আইএনএস বিনাশ এবং বহুমুখী ভূমিকা পালনকারী দু’টি ফ্রিগেট আইএনএস তলোয়ার ও আইএনএস ত্রিশূলকে নিয়ে হামলাকারী নৌ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ট্রাইডেন্টের মতো একই কৌশল অবলম্বন করে ভারতীয় টাস্কফোর্স রাতের আঁধারে করাচির সন্নিকটে পৌঁছে। বিনাশ ৪টি স্টিক্স ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। প্রথমটিতে করাচি বন্দরের প্রধান তেল মজুদ কেন্দ্র কিয়ামারি তেল ডিপো ধ্বংস, দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্রে পানামার পতাকাবাহী তেল ট্যাংকার গালফ স্টার নিমজ্জিত, তৃতীয়টিতে পাক নৌবাহিনীর তেল ট্যাংকার পিএনএস ঢাকা ও চতুর্থটিতে ব্রিটিশ জাহাজ এসএস হারমাটান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতীয়রা মাকরান উপকূলে একটি পাকিস্তানি জাহাজও আটক করে। এদিকে অপারেশন ট্রাইডেন্ট ও পাইথনের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনী করাচি বন্দরে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। এসব হামলায় বন্দর এলাকায় ১৭৯০ জন নিহত ও ২ শ’র বেশি আহত হয়। জ্বালানি ও গোলা-বারুদের ডিপোর শতকরা ৫০ ভাগই ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় তিন বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। উপসাগর থেকে পাকিস্তানের বন্দরসমূহে তেল সরবরাহের পথে সম্পূর্ণরূপে ভারতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। করাচি বন্দর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
লঙ্গেওয়ালার বিপর্যয়
১৯৭১-এর স্থলযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজস্থান সীমান্তের একটি ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ চৌকি দখল করতে গিয়ে মুখে পরাজয়ের চুনকালি মেখে এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ লঙ্গেওয়ালা সীমান্ত চৌকি দখলে নিয়ে সহজেই রাজস্থানের জয়সলমীর ও আশপাশের শহরগুলোসহ এক বিশাল ভূখণ্ড দখল করা যাতে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে ভারতের সাথে দর-কষাকষিতে সুবিধাজনক স্থানে থাকা যায়। কিন্তু ভাগ্য পাকিস্তানকে সাহায্য করেনি।
পাকিস্তান ৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে লঙ্গেওয়ালা দখলে অভিযান শুরু করে। পাকিস্তানি কমান্ডাররা শুরু থেকেই একের পর ভুল করায় এ অভিযান সম্ভাব্য বিজয়ের পরিবর্তে মর্মান্তিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সবচেয়ে বড় ভুল তারা যেটা করেছিলেন তা হলো ভারতীয় বিমান সমর্থনের বিষয়টি তারা বিবেচনাতেই আনেননি। তারপর থর মরুভূমি অঞ্চলের বালিময় মাটি যে ট্যাংক, আর্মার্ড কারসহ অন্যান্য সামরিক যানবাহন চলাচলের কতটা উপযোগী, সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। পাকিস্তান এ অভিযানে ২টি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ও ২টি আর্মার্ড রেজিমেন্ট মোতায়েন করে। এদিকে লঙ্গেওয়ালা চৌকিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ভারতীয়রা সেখানে আগেই মেজর কে এস চাঁদপুরীর নেতৃত্বে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি মোতায়েন করে। অন্য দিকে গোটা সীমান্ত চৌকি এলাকা তিন পর্বের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল যা পাকিস্তানি সৈন্যদের জানা ছিল না। মেজর চাঁদপুরীর নিয়োজিত স্কাউট টিম পাকিস্তানি সেনাদের এগিয়ে আসার খবর যথাসময়ে তাকে জানায়। অন্যদিকে সীমান্ত এলাকায় টহলরত ভারতীয় সেনা গোয়েন্দা বিমানও বিষয়টি নিশ্চিত করে। চাঁদপুরী পুরো বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে জরুরি সাহায্য পাঠানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু তাকে জানানো হয় যে অন্যূন ৬ ঘণ্টার আগে কোনো সাহায্য পাঠানো যাবে না। এ অবস্থায় তাকে চৌকি ছেড়ে চলে আসা অথবা প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়। মেজর চাঁদপুরী তার সৈন্যদের নিয়ে লড়াই শুরু করেন। সারারাত লড়াই করেও পাকিস্তানি সৈন্যরা চৌকিটি দখল করতে ব্যর্থ হয়। পরদিন ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণে গোটা পাকিস্তানি বাহিনী ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ে। তারা পাল্টা কোনো বিমান সমর্থন পায়নি। নরম বালির মধ্যে আটকা পড়ে পাকিস্তানি ট্যাংক ও সামরিক যান। সেগুলো ধ্বংস হয় অথবা আটক হয়। অবশিষ্ট সৈন্য, ট্যাংক ও সামরিক যান পশ্চাৎপসরণ করে।
লঙ্গেওয়ালের যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান তুলনামূলক শক্তি ছিল এ রকম :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনো যুদ্ধে এত ট্যাংক বা সামরিক যানবাহন ধ্বংসের ঘটনা ঘটেনি।
দু’দেশের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
’৭১-এর যুদ্ধের পর উভয় দেশের ক্ষয়ক্ষতির যে তুলনামূলক বিবরণ প্রকাশিত হয় তাতে পাকিস্তানের অপূরণীয় ক্ষতিই চোখে পড়ে। বিশেষ করে নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে :
অন্যদিকে ’৭১ সালের যুদ্ধে পর্যুদস্ত ও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় পাকিস্তান বিমানবাহিনী। এ বিষয়ে শতভাগ সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তান সে যুদ্ধে ভারতের ১৩০টি জঙ্গি বিমান ধ্বংসের দাবি করে। ভারত মাত্র ৪৫টি বিমান হারানোর কথা স্বীকার করে। ভারত দাবি করে যে, সে পাকিস্তানের ৯৪টি জঙ্গি বিমান ধ্বংস করেছে। পাকিস্তান মাত্র ২৫টি বিমান হারানোর কথা স্বীকার করে। এদিকে স্থল যুদ্ধে ভারত ৩৮৪৩ সৈন্য নিহত ও ৯,৮৫১ জনের আহত হওয়ার কথা জানায়। পাকিস্তানের ৯,০০০ সৈন্য নিহত ও ৪৩৫০ জন আহত হওয়ার কথা জানা যায়। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে তার নিয়মিত সৈন্য ও মিলিশিয়া মিলিয়ে ৯৩ হাজার সদস্যের এক বাহিনী ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। উপরন্তু ভারত শুধু পশ্চিম রণাঙ্গনেই প্রায় ১৩ হাজার বর্গ কিমি. গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পাকিস্তানি ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিল। পক্ষান্তরে পাকিস্তান ভারতের কচ্ছ ও থর এলাকার ৫ হাজার বর্গ কিমি. পরিমাণ জলাভূমিবেষ্টিত ও মরুময় এলাকা দখল করতে পেরেছিল। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী পরে ভারত ও পাকিস্তান তাদের হারানো এলাকা ফিরে পায়।
’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ও বিপুল ক্ষতির জন্য বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সদস্যদের সাথে বৈরী আচরণ বিপুলাংশে দায়ী বলে দেখা গেছে। বিশেষ করে বিমান বাহিনীর টেকনিক্যাল শাখার লোকের অভাবে পাকিস্তানি বিমানগুলো ঠিকমতো আকাশে উড়তেও পারেনি অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তারা বাঙালিদের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল ছিল। অথচ সেই বাঙালিদের সাথেই তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।
তিন তিনটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের বিপর্যয়ের পর আন্তর্জাতিক সামরিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন এই যে ভারতের মতো একটি বিশাল সামরিক শক্তির কাছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এতদিন যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এটাই তাদের একমাত্র ও সবচেয়ে বড় সাফল্য।
সূত্র : ইন্টারনেট