ব্রেক্সিট : ব্রিটেনের গলার কাঁটা
-
ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটেনের গণভোটে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে গরিষ্ঠ সমর্থনের পর মনে করা হয়েছিল, ‘এসপার-ওসপার একটা কিছু’ হয়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের বের হয়ে আসা সময়ের ব্যাপারমাত্র। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ‘ব্রেক্সিট’ এত সোজা নয়। বরং এটা ব্রিটেনের জন্য গলার কাঁটা হয়ে উঠছে। অর্থাৎ, না যায় ফেলা, আর না সম্ভব গিলে ফেলা। ইইউতে ব্রিটেনের আর সদস্যপদ ধরে রাখার উপায় নেই। অপরদিকে, যথাযথ চুক্তি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেন বের হয়ে এলে শুধু জাতীয় মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়া নয়; অর্থনৈতিক বিরাট ক্ষতির শঙ্কাও রয়েছে। ‘ব্রেক্সিট’ নিয়ে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলে কোন্দল ও অনৈক্য, প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র রাজনৈতিক সঙ্কট, বিরোধী শ্রমিক দলের চাপ, ব্রেক্সিট সমর্থক অনেকের হতাশা ও পরে বিপক্ষে অবস্থান এবং ব্রেক্সিট-এর ঘোষিত সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়া, প্রভৃতি মিলিয়ে ব্রিটেনে নিদারুণ অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন- ব্রেক্সিট ইস্যু নিয়ে আবার গণভোট করা যায়। উদ্ভূত সঙ্কট কাটাতে তার এহেন পরামর্শ। এদিকে, ব্রেক্সিটের বিরোধিতা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষত সম্মানজনক চুক্তি ছাড়া এটা না করার চাপে রয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ব্রেক্সিটের প্রতিবাদে লন্ডনে কয়েক লাখ মানুষের বিশাল সমাবেশের পরপরই অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘আরেকটা গণভোট অসম্ভব নয়।’ ব্রেক্সিট ইস্যুতে নতুন যে সঙ্কট মাথাচাড়া দিয়েছে, তা হলো খোদ প্রধানমন্ত্রীর আসন টলটলায়মান।
ব্রেক্সিট নিয়ে এত বিপদ হবে, তা ব্রিটেনের সরকার ও জনগণ কেউ বোধহয় কল্পনাও করেননি। ব্রেক্সিট মানে, ইইউ থেকে বেরিয়ে আসা। তবে এটা যে নিছক ইচ্ছেমতো চলে আসা নয়, বরং এর সাথে দেশটার জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদাও জড়িত, তা এখন সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন। নিকট অতীতে গণভোটের রায় ছিল, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, থেরেসা মে সরকার ইইউ’র সাথে যে চুক্তি করেছে, তার প্রতি পার্লামেন্টের সমর্থন মিলছে না। বারবার প্রয়াস সত্ত্বেও থেরেসা এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারেননি। তাই এই সময়সীমা ১২ এপ্রিল পর্যন্ত, মানে দুই সপ্তাহ বাড়িয়ে নিতে হলো। ২৯ মার্চ রাত ১১টার মধ্যে পার্লমেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করানোর বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে সেদিন ভোটে চুক্তিটি নাকচ হয়ে গেছে। এটি পাস করা হলে ব্রেক্সিটের জন্য ২২ মে পর্যন্ত সময় পাওয়া যেত। পার্লামেন্টে চুক্তি নাকচ করা হয়েছে ৩৪৪-২৮৬ ভোটে। ফলে বেক্সিটের সুফল পাওয়া আরো অনিশ্চিত হয়ে গেল।
‘ব্রিটিশ এমপিদের কাছে গ্রহণীয়’, এমন একটি চুক্তি গত ১২ মার্চ পার্লামেন্টে তোলার পরও তাদের সমর্থন পাওয়া যায়নি। তবুও থেরেসা মে থেমে যাওয়ার পাত্রী নন। তবে তিনি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতেও রাজি। এর বিনিময়ে ব্রেক্সিট চুক্তির প্রতি এমপিদের সমর্থন চেয়েছেন। তদুপরি জানিয়ে দিলেন, যদি এ চুক্তি পাস করা হয়, তা হলে পরের ধাপে, অর্থাৎ ইইউর সাথে সম্পর্ক নির্ধারণের আলোচনায় তিনি আর থাকছেন না। ২৭ মার্চ ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের এমপিদের বৈঠকে থেরেসা মে কথাগুলো বলেছেন। তার ভাষায়, ‘দেশ ও দলের জন্য যা সঠিক, তা করার লক্ষ্যে দায়িত্ব আগেভাগে ছাড়তেও সম্মত আছি। দলের এমপিরা পরবর্তী আলোচনায় আমাকে নেতৃত্ব দিতে দেখতে চান না। আমিও নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকতে চাই না।’
এ দিকে, বেক্সিট নিয়ে রক্ষণশীলদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, তথা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিভাজন, চরমে পৌঁছেছে। ২৫ মার্চ প্রস্তাব পাস করে কমন্স সভা সংসদীয় কার্যবিধির নিয়ন্ত্রণ নিজে নিয়ে নেয়। এতে গোঁড়া ব্রেক্সিটপন্থীরা প্রমাদ গোনেন এটা ভেবে যে, ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ আর থাকবে না। এ জন্য শেষরক্ষা হিসেবে তারা থেরেসা মে’র চুক্তি সমর্থন করার আভাস দিয়েছিলেন। তিনি এর আগে পর পর দু’বার চুক্তি পাস করাতে ব্যর্থ হন তাদের বিরোধিতার কারণেই। সরকারের শরিক দল ডিইউপি চুক্তিটির সরব প্রতিপক্ষ। তদুপরি স্পিকার বলে দিয়েছেন, চুক্তির প্রস্তাবে ‘নতুন কথা’ না থাকলে পার্লামেন্টে আরেক দফা ভোটাভুটির সুযোগ দেয়া হবে না। গত ২৭ মার্চ পার্লামেন্ট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এমপিরা ব্রেক্সিটের ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন। তখন ১৬টি বিকল্প প্রস্তাবের আটটির ওপর মত দেয়ার সুযোগ তাদের দেয়া হয়। এর ফলাফল হলো, কোনো প্রস্তাবই নি¤œকক্ষে গরিষ্ঠ সমর্থন পায়নি। এতে ইইউর সাথে কাস্টমস ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব, চুক্তি অনুমোদনে গণভোট অনুষ্ঠানের আহ্বান, ঘড় উবধষ ইৎবীরঃ, শুল্ক কাঠামো রক্ষা করে ব্রেক্সিট চুক্ত সম্পাদন- এসবই বাতিল হয়ে যায়।
২৯ মার্চ ব্রিটেনের নিম্নপরিষদ বা হাউজ অব কমন্সে এমপিরা ব্রেক্সিট প্রশ্নে আবার বিমুখ করলেন প্রধানমন্ত্রী ও রক্ষণশীল দলনেত্রী থেরেসা মে’কে। এর আগে আরো দু’বার তার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে গিয়ে। ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতেই এ প্রস্তাব। ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে না পেরে মে এটাকে ‘গভীর অনুতাপের ব্যাপার’ বলেছেন। তবে ফলাফলের অনিশ্চয়তার মধ্যেই ১২ এপ্রিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামের সুপ্রতিষ্ঠিত মহাদেশীয় ফোরাম ত্যাগ করতে হবে ব্রিটেনকে।
এই ‘বুড়ো বৃহৎশক্তি’ ইইউর অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে কয়েক দশক ধরে ভূমিকা রেখে এসেছে। ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে অনেকের ধারণা। তখন লন্ডন তার আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেকটা হারিয়ে ফেলতে পারে। এ দিকে পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে হেরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মে বলেছেন, ‘আমরা যা-ই করি না কেন, ইইউ নির্বাচনে আমাদের অংশ নেয়া প্রায় নিশ্চিত।’ বিরোধী শ্রমিক দলের আলোচিত নেতা জেরেমি করবিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কি মেনে নেবেন যে, তার চুক্তিকে আইন প্রণেতারা সমর্থন দিচ্ছেন না? থেরেসা মে ব্রেক্সিট চুক্তি পার্লামেন্টে গ্রহণ করাতে বহু চেষ্টা করেছেন। বলেছেন ‘এটাই শেষ সুযোগ। এ চুক্তি হলে ব্রিটেনের জনগণ ও বাণিজ্য উপকৃত হবে।’ তবুও এমপিদের মন গলেনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভোটাভুটির ফলাফল জেনে সাথে সাথে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল সম্মেলন ডেকেছে ১০ এপ্রিল।