রাজনীতি, প্যারোল, পার্লামেন্ট
খালেদা জিয়া -
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদ, যা দশম সংসদের মতোই ‘একতরফা’। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পরে জাতীয় পার্টি একদিকে যেমন সরকারের মন্ত্রিসভায় ছিল, আবার বিরোধী দলের ভূমিকায়ও ছিল। ফলে দলটির মুখ থেকে সরকারের সমালোচনা তো দূরের কথা, পুরো সময় কেটেছে তোষণে, তৈলমর্দনে। একাদশ সংসদে নির্বাচিতরা বলতে গেলে সবাই সরকারি দলের। সেই জাতীয় পার্টিই ফের বিরোধী দলে!
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনেই জয় পায় আওয়ামী লীগ। দলটি পেয়েছে ২৫৭টি আসন। আসন প্রাপ্তির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাতীয় পার্টি। লাঙ্গল প্রতীকে দলটি পায় ২২টি আসন। এর পরের স্থানে আছে বিএনপি। সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও বিএনপির আসন প্রাপ্তির সংখ্যা বিস্ময়কর। মাত্র ছয়টি। এই ছয়জনকেই এখন নানা টোপ দেয়া হচ্ছে সংসদে নেয়ার! সরকারের কোনো কোনো নেতা বলছেন, ‘ছয়জনই ৬০ জনের আওয়াজ তুলতে পারবেন।’
নির্বাচনী বছরে (২০১৮) বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় দলটি গণফোরাম সভাপতি ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনের মাঠ চরম প্রতিকূল থাকলেও ফল যে এমন হতবাক করে দেয়ার মতো হবে, তা কারো ভাবনায় ছিল না। হতভম্ব সেই ট্রমা এখনো কাটাতে পারেনি বিএনপির নেতাকর্মীরা।
একাদশ নির্বাচনের ফল বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট প্রত্যাখ্যান করে পুননির্বাচনের দাবিতে নিয়ন্ত্রিত কিছু কর্মসূচি পালন করে চলছে। প্রতিবাদ হিসেবে এখনো সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেননি বিএনপির সবে ধন নীলমণি নির্বাচিত ছয়জন। যদি শপথ নিতে হয়, তাহলে নিয়মানুযায়ী ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই নিতে হবে। তা না হলে ওই আসনগুলো শূন্য হয়ে যাবে। পুনরায় নির্বাচন হবে। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে বিএনপির এ ছয় সংসদ সদস্য শপথ নেবেন কি না, কিংবা এর সাথে বেগম জিয়ার মুক্তির কোনো সম্পর্ক আছে কি না; তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। বলা হচ্ছে- পর্দার অন্তরালে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সরকার ও বিএনপির শীর্ষপর্যায়ে দেনদরবার চলছে। তার মুক্তি নিয়ে দুই পক্ষই শর্তারোপ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্যারোলো মুক্তি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশ চলে যেতে হবে। সেখানে তিনি চিকিৎসা করাতে পারবেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো কথাবার্তা বলতে পারবেন না। পাশাপাশি বিএনপির জনপ্রতিনিধিদের সংসদেও যেতে হবে। আর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে বেগম জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে। মুক্তি পেয়ে তিনি যেখানে খুশি সেখানে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তিনি সুস্থ হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হতে পারবেন। বেগম জিয়া প্যারোলো মুক্তিতে রাজি আছেন এমন আলোচনাও আছে। তবে এসব আলোচনার কোনো নিশ্চিত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দলের সিদ্ধান্ত মেনে বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে রাজি নন। যদিও ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচিত গণফোরামের দুইজন সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান ইতোমধ্যে শপথ নিয়েছেন। শপথ নেয়ার কারণে সুলতান মনসুরকে গণফেরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মোকাব্বির খানের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে। মোকাব্বির খান শপথ নেয়ার পরে ড. কামালের সাথে তার মতিঝিলের চেম্বারে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ড. কামাল তাকে বলতে গেলে ‘গলা ধাক্কা’ দিয়ে বের করে দেন। বিএনপি বলছে, যে নির্বাচন বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই সংসদে বিএনপির শপথ নেয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই। বিএনপির নির্বাচিতরাও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও কিছু করবেন না।
বেগম জিয়ার মুক্তিতে প্যারোলের আবেদনের কথাও ভাবছে না বিএনপি। তারা চান বেগম জিয়ার জামিন। সত্তোরর্ধ্ব বেগম জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তার পুরো শরীর ব্যথায় আক্রান্ত। অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি নড়াচড়া করতে পারেন না। এর পাশাপাশি ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। জানা যায়, অসুস্থতা সত্ত্বেও বেগম জিয়া বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা নিতে কখনোই রাজি ছিলেন না। তার আগ্রহ বিশেষায়িত হাসপাতাল ইউনাইটেডে চিকিৎসা নেয়ার। তার এ অনীহার কারণে গত মাসের মাঝামাঝিতে কারা কর্তৃপক্ষ একবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েও সফল হননি। অন্য দিকে বেগম জিয়া অসুস্থ হয়ে পরায় বিএনপিতেও উদ্বেগ বাড়ছিল। এরই একপর্যায়ে দলের সিনিয়র দুইজন নেতা পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা বেগম জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, যেখানেই হোক এ মুহূর্তে তার চিকিৎসা খুবই প্রয়োজন। নেতাদের এ সাক্ষাতের পথ ধরেই বিএসএমএমইউতে আসতে রাজি হন তিনি। সেখানে এখন তার চিকিৎসা চলছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা বেগম জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে চাইছেন। তার চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড রয়েছে। সেই মেডিক্যাল বোর্ড যেভাবে সুপারিশ করবে, সেভাবে তার চিকিৎসা হবে। বোর্ড যদি মনে করে, বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সম্ভব নয়, প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হবে, তাহলে সেটি বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী হবে না, তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
যতদূর জানা যায়, বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেতে চান না। এটি অসম্মানজনক মনে করেন তিনি। দলের কোনো নেতাও তার সামনে বিষয়টি উত্থাপনও করেননি। আইনজীবীরা তার জামিনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, সরকার বাধা না দিলে আইনি প্রক্রিয়ায় সহসা মুক্তি পাবেন বেগম খালেদা জিয়া।
আইনজীবীদের এ আশাবাদে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা অবশ্য ভরসা করতে পারছেন না। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়া বন্দি রয়েছেন। পুরান ঢাকার কারাগার থেকে তাকে এখন কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। যে মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে গেছেন, সেই মামলায় মাস দুইয়ের মধ্যেই তিনি জামিন পেয়েছিলেন, কিন্তু অন্য মামলার জালে তিনি এখন বন্দী। একটিতে জামিন পেলে অন্যটিতে গ্রেফতারি পরোয়ানা চলে আসে। এভাবে কেটেছে ১৩ মাস। বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন আন্দোলনে নামার হুঙ্কার দিচ্ছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে ঐক্যফ্রন্টও পাশে থাকবে বলে নেতারা বলছেন।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর রাজনীতির মাঠ ফাঁকাই বলা চলে। আন্দোলনের হুমকিধমকি আছে, কিন্তু সেগুলো যে খুব সহসাই হবে তা বলা যাচ্ছে না। রমজানের পর মাঠ কিছুটা গরম হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও ঐক্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে ফ্রন্টের গণশুনানিতে বেশ কয়েকটি বাম দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ঐক্যফ্রন্ট। তাদের মধ্যে ছিলেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের খালেকুজ্জামান ও বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদের (মুবিনুল) মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও সুধাংশু চক্রবর্তী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির মোশরেফা মিশু, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের মোশাররফ হোসেন নান্নু এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক। বাম নেতারা গণশুনানিতে না গেলেও তাদের সাথে কর্মসূচি পালনের ঐক্য গড়ে উঠতে পারে বলে কেউ কেউ বলছেন।