পশ্চিমে শ্বেত সন্ত্রাস
পশ্চিমে শ্বেত সন্ত্রাস -
শান্তির সূচকে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড। সেই শান্তিপ্রিয় দেশের ক্রাইস্টচার্চ শহরে দু’টি মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়েছে এক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী। ১৫ মার্চ জুমার নামাজরত মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশীসহ ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তিন বছরের দুধের শিশুও রেহাই পায়নি নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ থেকে। ব্রেন্টন ট্যারান্ট নামের এক অস্ট্রেলীয় শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী এ ঘৃণ্য অপকর্ম করেছে। পুলিশ এ ঘটনায় ট্যারান্টসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। আটকদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। এ ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন টুইটে বলেছেন, ‘ক্রাইস্টচার্চে নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার জায়গা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী সম্প্রদায়ের। নিউজিল্যান্ডই তাদের বাড়ি। তারা আমাদের লোক।’ ঘটনার দিনটি তার দেশের অন্ধকারতম দিন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ক্রাইস্টচার্চে স্থানীয় সময় দেড়টার দিকে মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের ওপর স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে হামলা চালায় ওই সন্ত্রাসী। হামলার ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভও করে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ২৮ বছর বয়সী হামলাকারী ট্যারান্ট।
বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টাল প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানায়, চার পাশে শুধু মানুষের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা।
প্রত্যক্ষদর্শী এক ফিলিস্তিনি জানান, ‘আমি পরপর দ্রুত তিনটি গুলির আওয়াজ পাই। ১০ সেকেন্ড পর আবার গুলি শুরু হয়। এটি অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হবে মনে হয় আমার। তা না হলে কোনো মানুষের পক্ষে এত দ্রুত ট্রিগার টানা সম্ভব নয়। লোকজন দৌড়াতে শুরু করেন। কারো কারো দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পাই আমি।’
প্রথম হামলাটি চালানো হয় মধ্য ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে। মসজিদ ছিল মুসল্লিতে পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় হামলা চালানো হয় কাছাকাছি লিনউড শহরতলির এক মসজিদে। স্টাফ ডট কো ডট এনজেড নামে নিউজিল্যান্ডের একটি নিউজ পোর্টালে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, নামাজ আদায়রত অবস্থায় তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। তিনি দৌড়ে মসজিদ থেকে পালিয়ে এসে দেখেন তার স্ত্রী ফুটপাথে মৃত পড়ে আছেন। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি শিশুদের গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন। চারপাশে শুধু লাশ আর লাশ। রেডিও নিউজিল্যান্ডকে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গুলির শব্দ শোনার পর তিনি দেখেন রক্তে চার দিক ভেসে যাচ্ছে।
২০১১ সালে নরওয়ের অসলোতে অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক নামে এক সন্ত্রাসীর হামলায় ৭৭ জন নিহত হন। নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসী ট্যারান্ট ওই হামলার ঘটনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই হামলা চালায় বলে উল্লেখ করেছে তার টুইটার ইশতেহারে।
নিউজিল্যান্ডে এভাবে বন্দুক হামলার ঘটনা বিরল। ১৯৯০ সালে সাউথ আইল্যান্ডের আরামোয়ানা শহরে কথিত মানসিক এক রোগী গুলি করে ১৩ জনকে হত্যার পর দেশটির অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে কড়াকড়ি করা হয়। ১৯৯২ সালে আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের ব্যাপারে দেশটির আইনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপরও ১৬ বছরের বেশি বয়সী কেউ নিরাপত্তা কোর্স সম্পন্ন করার পর নির্ধারিত মানের অস্ত্র নিবন্ধনের সুযোগ পান।
এই বর্বর সন্ত্রাসী হামলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সদস্যরা। সংবাদ সম্মেলনে ব্যস্ত থাকায় ঘটনার শিকার ওই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যেতে তাদের একটু দেরি হয়। এ কারণে এ নৃশংসতা থেকে ক্রিকেটাররা রক্ষা পেয়ে যান। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের পূর্বনির্ধারিত তৃতীয় টেস্ট বাতিল করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অভিবাসনবিরোধী হামলাকারী টুইটারে বলেছে, হামলার মাধ্যমে সে দেখাতে চায়- তাদের ভূমি কখনো অভিবাসীদের ভূমি হবে না, যতক্ষণ শ্বেতাঙ্গরা জীবিত থাকবে। হামলাকারী কট্টর ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ এবং চরমপন্থী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে এ আন্দোলনের সাথে জড়িতরা এখানে-সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এর আগে হল্যান্ডে, ইংল্যান্ডে এ চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গদের সন্ত্রাস চালাতে দেখা যেত। এবার নিউজিল্যান্ডে যা ঘটল তা বিশ্ববাসীর সামনে এক বড় প্রশ্ন হাজির করল, শান্তিবিনাশী এমন অপশক্তি বিনাশে বিশ্ববাসী কি কোনো কার্যকর ভূমিকা নেবে?
চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা শান্তির পথে চরম বাধা। এরা মানবতার শত্রু। বিশ্ববাসীকে সম্মিলিত প্রয়াসে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
যে অস্ট্রেলীয় নাগরিক নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটাল সে প্রকাশ্যে জানিয়েছে, সে পশ্চিমা জগতে মুসলমান অভিবাসী চায় না। কিন্তু এ নির্বোধের জানা নেই, আজকের অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ নিজেরাও মূলত অভিবাসী ছিল। যারা ইউরোপকে আজ সভ্য ও বাদবাকিদের অসভ্য ভাবে তারা জানে না, আরবের রেনেসাঁ থেকেই আলো নিয়েছিল ইউরোপীয় আধুনিকতা। প্রাচীন সংস্কৃত, লাতিন ও গ্রিক ভাষা টিকে গিয়েছিল মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই। ইউরোপের জাতীয়তাবাদী নেতাদের কেউই বিশুদ্ধ স্বজাতীয় নন। এটি সত্য, পৃথিবীতে কোনো বিশুদ্ধ জাতি নেই। সব জাতিই পরস্পরের কাছে ঋণী। তাই মুসলিম অভিবাসনবিরোধী হওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আগামীর বিশ্বকে শান্তিময় করতে ও মানবসমাজের বসবাসের উপযোগী রাখতে চাইলে এ সন্ত্রাসীদের সমূলে বিনাশ করা ছাড়া বিকল্প নেই। এরা হোক না যেকোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ভুক্ত। পশ্চিমা দেশগুলোকে এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রুখতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা গোটা মানবজাতির শত্রু, তেমনিভাবে শত্রু নিজেরও। এরা প্রগতির শত্রু, মানবজাতির শান্তিবিনাশী। বিশ্বের মুসলমানদের এদের মোকাবেলা করতে হবে ধৈর্যের সাথে, শান্তিপূর্ণভাবে। সন্ত্রাসের জবাব সন্ত্রাসে নয়, মুসলমানদের শান্তিবাদী আচরণ আর নিজেদের যথাযোগ্য প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তোলাই হবে এর সমুচিত জবাব। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষণে-প্রশিক্ষণে, দক্ষতায়-সক্ষমতায় বলীয়ান সুশৃঙ্খল জাতিই সব ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তি থেকে বৈশ্বিক জীবনে কখনো শান্তি আসেনি, সম্ভবও নয়। এটিই শাশ্বত সত্য। ইদানীং বিশেষত, পশ্চিমের দেশে দেশে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা চরমে পৌঁছেছে। এর সর্বশেষ জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ১৫ মার্চের হামলা। মর্মান্তিক এ ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের স্মরণে হামলার শিকার মসজিদসংলগ্ন পার্কে ২২ মার্চ সমবেত হন অসংখ্য মানুষ। সেখানকার সমাবেশে নারীরা সবাই মাথায় পরেছিলেন মুসলিম ঐতিহ্যবাহী পোশাক স্কার্ফ। অনেকের চোখে ছিল বেদনার অশ্রু। স্বেচ্ছাসেবী এবং পুলিশ সদস্যরাও সংহতির বাইরে ছিলেন না। এক নারী পুলিশ তো রীতিমতো হাতে অস্ত্র, মাথায় স্কার্ফ আর বুকে লাল গোলাপ নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। সত্যিই এমন সংহতি পাশ্চাত্যে বিরল, যা নিউজিল্যান্ডে দেখল দুনিয়াবাসী।
আধুনিক নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ১৫ মার্চের ঘটনা। দুনিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর এমন হামলা নিকট অতীতে আর হয়নি। এ হামলার পর থেকে নিউজিল্যান্ড দেখিয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ মার্চ দিনটিকে বেছে নেয়া হয় মুসলিমদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা জানাতে ২০ হাজার মানুষ সমবেত হন ঘটনাস্থল আল নূর মসজিদের কাছে হেগলি পার্কে।
নীরবতা কখনো কখনো মারণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। নীরবতার প্রচণ্ড আঘাতে সন্ত্রাস, চরমপন্থা, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে পরাভূত করতে পুরো নিউজিল্যান্ড ২২ মার্চ দুই মিনিট নির্বাক কাটিয়েছে। যেন ভরদুপুরে নেমে আসে মধ্যরাতের স্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতায় ছিল মহাসাগরের তীব্র গর্জন। নীরবতার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় শান্তি, ঐক্য ও সংহতির মানবতাবাদী অবিনাশী বারতা। ইতিহাসকে পথ দেখিয়ে খ্রিষ্টানপ্রধান দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভিতে ধ্বনিত হয় আজানের সুমধুর ধ্বনি। নামাজের জামাতও সরাসরি সম্প্রচার করা হয় সরকারি প্রচারমাধ্যমে। মুসলিমদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে ছুটে আসেন দেশটির অমুসলিম নাগরিকেরা। তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। ইমামের খুতবার আগে সংক্ষিপ্ত কিন্তু হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন তিনি। পার্কে উপস্থিত মুসলিম-অমুসলিম জনতার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুরো নিউজিল্যান্ড আপনাদের সাথে কাঁদছে। আমরা অভিন্ন।’ একটি হাদিস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ সা:-এর মতে দয়া, সমবেদনা ও সহমর্মিতায় বিশ্বাসীরা একটি দেহের মতোই। যখন শরীরের একটি অঙ্গ কষ্ট পায়, তখন পুরো শরীরেই যন্ত্রণা হয়।’ হিজাব পরিহিত আরডার্ন প্রায় আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত এ ভূমিকা মুসলিম-অমুসলিম সবার প্রশংসা কুড়ালেও কিছু লোক যে এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা স্পষ্ট। সোস্যাল মিডিয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে।
তবে নিউজিল্যান্ডে এমন নৃশংস হামলার পর এটাই আবার বিশ্ববাসীর কাছে উৎকটভাবে ধরা দিলÑ কোনো সমাজ বাইরে থেকে যতই অসাম্প্রদায়িক, উদার ও গণতান্ত্রিক মনে হোক তার ভেতরে যদি প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা না থাকে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। সমাজের ভেতরের অন্তত একটি অংশের মৌন মদদ না থাকলে কেউ ঠাণ্ডা মাথায় এমন কাজ করতে সাহস পাবে না। যতই দূরবর্তী দ্বীপ হোক, সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হোক, পশ্চিমের খ্রিষ্টান মৌলবাদী রাজনীতির প্রভাব তার জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদৌ নেই, তা ভাবা ঠিক নয়। এজাতীয় বর্বরতাকে শুধুই একজন ধর্মান্ধ উন্মাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত নিষ্ঠুর কাজ মনে করা নির্বুদ্ধিতা।
ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসাবিদ্বেষ কোনো কোনো দেশের মানুষের গায়ে লেখা থাকে, কোনো কোনো দেশের মানুষের চামড়ার ভেতরে থাকে। একজনেরটা দেখা যায়, আরেকজনেরটা দেখা যায় না। বিশেষ করে কারো রঙ যদি ভেজা এঁটেল মাটির মতো কালচে বা বাদামি হয়, তাহলে তার দোষ বেশি। মানুষটা যদি ধবধবে ফরসা হয় এবং ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান না হয়, তার সাত খুন তো বটেই, সত্তর খুন পর্যন্ত হালকাভাবে দেখা হয়। পাশ্চাত্যে অনেকের মনোজগতের গঠন এখন এমনই। তারা মুসলিমদের সন্ত্রাসী ভাবতে পছন্দ করে। এই মানসিকতার দ্রুত বিস্তার ঘটে নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার পর। ওই হামলা কারা ঘটিয়েছে তা নিয়ে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা।
পশ্চিমের পত্রপত্রিকা পড়লে মনে হবে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী শুধু মুসলমানেরা। অথচ এএফপির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পোপ ফ্রান্সিস ২০১৫ সালের পয়লা ডিসেম্বর বাঙ্গুইতে বলেছিলেন, মৌলবাদ রোমান ক্যাথলিকসহ সব ধর্মেরই ব্যাধি- ‘ডিজিজ অব অল রিলিজিয়নস ইনক্লুডিং রোমান ক্যাথলিক চার্চ’। তিনি আরো পরিষ্কার করে বলেন, শুধু ইসলামই একমাত্র ধর্ম নয় যা এই উগ্রতার রোগে আক্রান্ত, আমাদের ক্যাথলিকদের মধ্যেও কিছু, এমনকি বহু মৌলবাদী আছে- ‘উই ক্যাথলিক, উই হ্যাভ অ্যা ফিউ, ইভেন মেনি ফান্ডামেন্টালিস্টস’।
এ দিকে, ইউরোপের খ্রিষ্টান মৌলবাদীরা নিজেদের মৌলবাদী বলে আখ্যায়িত করা পছন্দ করে না। তারা একটু নরম শব্দ ব্যবহার করে থাকে। পশ্চিমের দেশগুলোতে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আজ প্রবল। কোনো কোনো দেশে তারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আছে, কোনো কোনো দেশে তারা বিরোধী দলে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে পারে। নিউজিল্যান্ডের নারকীয়তার কয়েক ঘণ্টা পর ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ইউরোপে ‘খ্রিষ্টান সংস্কৃতি’ রক্ষার দাবি জানিয়ে বলেন, তা যদি না করা হয়; তাহলে ইউরোপ খ্রিষ্টানদের থেকে মুসলমানদের কাছে চলে যাবে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পর আলকায়েদা নামক এক চরম উগ্র মুসলিম গোষ্ঠীর কথা বিশ্ববাসী জানতে পারে। তারপর থেকে ইউরোপ-আমেরিকার সাধারণ মুসলমানের ওপর আক্রমণ অব্যাহত আছে। বহু দেশের মসজিদে তাদের ওপর হামলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ২০১৭ সালেও কানাডার একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে উগ্রবাদীরা ছয়জনকে হত্যা করে। গত বছর ইতালিতে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ছয় অভিবাসীকে হত্যা করা হয়। পত্রপত্রিকায় লেখা হয়, এসব শ্বেতাঙ্গ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কাজ, খ্রিষ্টান মৌলবাদ কথাটি বলা হয় না।
বহু মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠী যেমন দেশে দেশে সক্রিয়, তেমনি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে বহু শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। তাদের পরিচালিত ‘হেইট ক্রাইম’-এর কথা প্রচারমাধ্যমে যৎসামান্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাদের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকদের পরিচয় অপ্রকাশ্য থাকে। মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর ইসলামী সংগঠনগুলোর নাম বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়, কিন্তু খ্রিষ্টান দেশগুলোতে যেসব মারাত্মক উগ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, সেগুলোর কথা মানুষ খুব কমই জানে।
জার্মানিতে চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মার্কেল ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছেন। তারা অবশ্য অশ্বেতাঙ্গ নন, জার্মানদের মতোই রীতিমতো ফরসা। কিন্তু সেই শ্বেতাঙ্গরা মুসলিম। তাহলে সেই শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে জার্মানির নব্য নাৎসিবাদী ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মান’ দলের আক্রোশ কেন? তার অর্থ হলো, শুধু শ্বেতাঙ্গ হলেই হবে না, হতে হবে খ্রিষ্টানও।
ইউরোপ-আমেরিকার আজকের আর্থসামাজিক উন্নতির পেছনে অভিবাসীদের অবদান অত্যন্ত বেশি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফরাসি প্রভৃতি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে এশিয়া-আফ্রিকার অভিবাসীদের জামাই আদরে গ্রহণ করা হতো। ওইসব দেশে দুই বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিক সঙ্কট ছিল তীব্র। এখন অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হলেও বস্তুত তাদের আক্রোশ মুসলমানদের ওপর এবং কিছুটা উপমহাদেশের সব ধর্মের বাদামি মানুষের বিরুদ্ধে।
ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে ‘নরডিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’ এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে খ্রিষ্টীয় জঙ্গিদের যে উত্থান ঘটেছে, তা মানবসভ্যতাকে হুমকিতে ফেলবে এবং বিশ্ব অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাস নয়, এক ব্যক্তির পরিচালিত নেকড়ের আক্রমণ। এ জাতীয় জঙ্গির নাম দেয়া হয়েছে ‘লোন উলফ’। এসব মুসলিমবিদ্বেষী নেকড়ে দেশে দেশে আজ তাদের চক্রান্তের জাল বুনছে। তারা এখন একজন ভয়ঙ্কর বড় নেতাও পেয়ে গেছে, তার নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিউজিল্যান্ডের হামলাকারী শুধু যে গত এক দশকের অন্যান্য খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে তাই নয়, তার আদর্শিক গুরু ট্রাম্প।
এই যে বিশ্বব্যাপী মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড চলছে, এতে বাংলাদেশের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকেরা আজ ইউরোপ-আমেরিকার প্রায় সব দেশেই অবস্থান করছেন। তারা শ্রম দিয়ে সেসব দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। অন্য দিকে তারা নিজেদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখছেন। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের উদ্বেগের আরেকটি কারণ, এখানে ধর্মপ্রাণ মানুষের সংখ্যা কম নয়। হয়তো তারা সন্ত্রাস জড়িয়ে পড়েননি। কিন্তু বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের ওপর হামলা হতে থাকলে তারাও প্রতিহিংসা থেকে বিপজ্জনক পথে পা বাড়াতে পারেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস বিবেচনার বিষয়, সমাজে মানুষ তার মনের কথা স্পষ্ট করে প্রকাশ্যে নির্ভয়ে বলার পরিবেশ পেলে গোপন ষড়যন্ত্র করার পথ অনেকটাই বন্ধ হয়। আমাদের দেশে সেই পরিবেশ যদি নষ্ট হয়, তাহলে অন্য দেশের কুদৃষ্টান্ত থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে বিপথগামী হতে পারে।
হিংসায় আক্রান্ত পৃথিবী। তার শিকার সাধারণ মানুষ। এ অশান্ত ও উন্মত্ত পৃথিবীতে শান্তির বারি বর্ষণ করে প্রেমময় সমাজ প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। যে ধর্মাবলম্বী বা যে বর্ণের মানুষই হিংসার পথ বেছে নিক না কেন, তা অবশ্যই ঘৃণার। প্রগতিশীল পশ্চিমকে তার ছদ্মবেশ খুলে ফেলতে হবে। নির্ভেজাল মানবতাবাদই হিংসামুক্ত সমাজ ও পৃথিবী নির্মাণ করতে পারে।