নতুন বিশ্বের সন্ধানে
নতুন বিশ্বের সন্ধানে - ছবি : সংগ্রহ
বর্তমানে প্রতিযোগিতাশীল সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মানুষের প্রকৃতিতে কিছু জঘন্য উপাদান জিইয়ে রাখছে। ক্ষমতার মোহ ও অপব্যবহার তার অন্যতম। রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীনতা, উদারতা ও আইনের শাসনের মতো উপাদান উপস্থিত থাকলেও সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ চলছে কলে-কৌশলে অতি সূক্ষ্মভাবে। রাষ্ট্রের হাতে ব্যক্তিসাধারণের নিয়ন্ত্রণ ও অবদমন চলছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। বিভিন্ন আদর্শকে নামমাত্র ব্যবহার করা হচ্ছে শাসনের সুবিধার্থে।
সাধারণত বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে আদর্শকে সামনের রেখে কোনো কিছু অর্জন করার কথা ভাবা হয়। আদর্শ দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হয়। এ আদর্শ সম্পর্কিত ধারণা সময়ের বিভিন্ন পরিক্রমায় সৃষ্টি হয়। এর সাথে সম্পর্ক থাকে ক্ষমতার। কিন্তু যখন আন্দোলনের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে ফেলা হয় তখন আর আদর্শ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জায়গা থেকে সরে আসা হয়। তখন আবার ওই আদর্শের ধারণাকে রূপান্তর করা হয়। সময়ের পরিক্রমায় বিদ্যমান ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত হয়ে বা ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সে আদর্শ ভিন্নরূপ লাভ করে। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন এবং তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বৈষম্য ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, এসব কথা বলার ক্ষেত্রে তারা নীরব থাকেন। কারণ এসব কথা বলতে গেলে ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। তাই মূল চেতনা সামনে না নিয়ে এসে তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হিসেবে মনে করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক অর্থাৎ নি¤œশ্রেণীর লোকদের অবদান ছিল অপরিসীম। অন্য দিকে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ লোকজন ছিল দ্বিধান্বিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সরকারকে সাহায্য করেছেন। স্বাধীনতার পর, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সরকারকে যারা আন্তরিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাদের চিহ্নিত করার জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন এ বি এম সফদার। যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা। (আনিসুজ্জামান : বিপুলা পৃথিবী: ২৬)
এদের মতো লোকদের অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। অন্য দিকে, আমাদের দেশের অনেক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, যারা যুদ্ধের আগে ছিলেন ভূমিহীন কৃষক, এখনো তাই। এদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন বর্তমানে যে বৈষম্যের বিশাল দেয়াল তা দূর করা। এটিই মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ। বর্তমানে এ আদর্শকে ভিন্নরূপে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। যৌক্তিক কোনো দাবি বা আন্দোলনকে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী চিহ্নিত করছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বলে। আবার মূল চেতনার প্রশ্নে তারা নীরব।
বর্তমানে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূক্ষ্মতম কৌশল হচ্ছে সাংস্কৃতিক তৎপরতা। ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই সাংস্কৃতিক তৎপরতার মাধ্যমে প্রাচ্যের উপনিবেশগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি।
ঔপনিবেশিক শক্তি বা পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রাচ্যকে শোষণ ও অবদমন করার সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াকে এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ নাম দিয়েছিলেন অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যব্যবসা। এ প্রাচ্যব্যবসার অংশ হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বঙ্গপ্রদেশে শাসন শুরু করল তখন তাদের সহযোগিতায় খ্রিষ্টান মিশনারিরা বাংলা ভাষায় বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। সমাচার দর্পন, দিগদর্শন এগুলো ছিল অন্যতম। এসব পত্রিকায় সাধারণত দুই ধরনের চিত্র উপস্থাপন করা হতো। একটি হচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে বিভিন্ন রাজ্যের পরিস্থিতি, যাদের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত রয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। অন্য দিকে, ভারতবর্ষের যে সামাজিক অবস্থান উপস্থাপন করা হতো সেটি ছিল বর্বর এবং পিছিয়ে থাকা একটি সমাজ, যেখানে আছে- সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা, বলীপ্রথা, পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কুসংস্কার প্রভৃতি। এসব বিষয় উপস্থাপনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাদের শাসন ও শোষণকে যৌক্তিক ও বৈধ করে তোলা। যেন তারা উপনিবেশ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে বর্বর ভারতবর্ষের সমাজের লোকদের সভ্য করার জন্য।
উপনিবেশোত্তর যুগে রাষ্ট্র সাংস্কৃতিক আধিপত্য সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও অবদমনের ক্ষেত্রে আরো বেশি কৌশলী। অধিকাংশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সাধারণ জনগণ তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলেন না ; তারা কথা বলেন শাসকগোষ্ঠীর ভাষায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত পশ্চিমের মতো উন্নত দেশগুলোতেও সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে নব্য উদারতাবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে করপোরটদের স্বার্থ হাসিল করা। এ ধরনের বাজার ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ সীমিত করা হয়, করপোরেটদের ওপর ট্যাক্সের বোঝা শিথিল করা হয় এবং বিশ্বের যেকোনো স্থানে তাদের অবাধ ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হয়। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর হাতে। অন্য দিকে, সাধারণ মানুষ শোষিত হতে থাকে করপোরেটদের হাতে। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ জনগণ বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলছে। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট বা সাম্প্রতিক ইয়োলো বেস্ট আন্দোলন হচ্ছে তার অন্যতম উদাহরণ।
পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমেই যে প্রশ্নটি জটিল আকার ধারণ করছে সেটি হচ্ছে বর্ণবাদী ও কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দলের উত্থান। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে অভিবাসন সমস্যা ও ইসলামভীতিকে কাজে লাগিয়ে। সুইডেনের মতো অভিবাসী সমর্থক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অভিবাসন বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে ঝবিফবহ উবসড়পৎধঃ নামক বিরোধী রাজনৈতিক দল ১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
অন্য দিকে, পশ্চিমা বিশ্বে ক্রমশ ইসলামভীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর ফায়দা নিচ্ছে কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলামভীতির মূল কারণ হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। পাশ্চাত্য বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও এ ধর্মের বিকৃতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় মধ্যযুগ থেকে প্রাচ্যব্যবসার অংশ হিসেবে। দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বা ভলটেয়ারের নাটকে সচেতনভাবে ইসলামকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটি আরো তীব্রতর হয় সভ্যতার সঙ্ঘাত নামক ডিসকোর্সের মাধ্যমে। সভ্যতার সঙ্ঘাতের প্রবক্তা হান্টিংটনের মতে ইসলামি মৌলবাদ নয়, বরং ইসলাম হচ্ছে পাশ্চাত্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে এ সভ্যতার সঙ্ঘাতে বিশ্বাস করেন এবং এরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সর্বদা আগ্রহী। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ও ইউরোপীয় বর্ণবাদীরা মুসলিন অভিবাসীদেরকে নিজেদের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করেন, যার সর্বশেষ প্রমাণ হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের ঘটনা। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের বর্ণবাদী আচরণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক শাসন থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। পৃথিবীর প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প জার্মান নাৎসি বাহিনী কর্তৃক নয় এটি তৈরি করা হয় কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মাধ্যমে। নাৎসি বাহিনীর দোষ তারা তাদের বর্ণবাদী আচরণ ইউরোপ পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল, আর ইউরোপের অন্যান্য দেশ এটি সীমিত করে রেখেছিল এশিয়া ও আফ্রিকায়। বর্তমানে এ বর্ণবাদী আচরণ এক নতুন রূপ লাভ করেছে পশ্চিমা বিশ্বে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষত শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো দেশগুলোতে ধর্মীয় উগ্রতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রতাকে পুঁজি করে মসজিদ, মন্দির বা গীর্জার মতো পবিত্র স্থানে হামলা চালানো হচ্ছে। ধর্মীয় অরাজকতা সৃষ্টির পিছনে দুটি গোষ্ঠীর লোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা অন্যধর্মের লোকদের প্রতি অসহিঞ্চু। অরেক শ্রেণির লোক তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘু লোকদের নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এরা বিভিন্ন সময় কট্টর শ্রেণীর কর্তৃক সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার অভিযোগ এনে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান এগিয়ে নিয়ে যায়। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর ওপর।
আমরা যে বিশ্বে বাস করছি সেটি সার্বিক বিচারে সুখী, সমৃদ্ধি ও মানবিক নয়। একটি সুখী বিশ্ব যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় না, জাতিতে জাতিতে হিংসা বিদ্বেষ ছড়ায় না। একটি সুখী-সমৃদ্ধি বিশ্ব তৈরি মানবীয় ক্ষমতার বাইরে নয়। যে ক্ষমতার অপব্যবহার, শোষণ, অবদমন চলছে তা একদিন আত্মসমর্পণ করবে শোষিত, সচেতন নাগরিকদের কাছে, ইতিহাসের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। বিনির্মিত হবে নতুন এক বিশ্ব।