জীবনের পথে পথে

নুসরাত রীপা | May 19, 2019 01:50 pm
জীবনের পথে পথে

জীবনের পথে পথে - ছবি : নয়া দিগন্ত

 

দিনের সব হিসাব-পত্র মেলাতে মেলাতে আতাউল আর একবার রাস্তার দিকে তাকাল। হাইওয়ে থেকে যে রাস্তাটা নেমে সোজা রাজপুর গাঁয়ের দিকে চলে গেছে, সে রাস্তার ওপরই তার দ্য গ্রেট বেঙ্গল হোটেল। শীতের রাত। ১১টা প্রায় বাজে। আজ আর কাস্টমার আসার সম্ভাবনা খুবই কম, তবুও আতাউল ডানে-বাঁয়ে একবার চোখ বুলায়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো এ পথ দিয়েই আসা-যাওয়া করে এবং প্রায়ই এর হেলপার ও ড্রাইভারেরা এখানে গাড়ি থামিয়ে রুটি আর ডাল খেয়ে যায়। এই রুটি আর ডাল স্পেশাল করে তৈরি এবং এর আলাদা কারিগর আছে। রুটিগুলো সাধারণের তুলনায় বড় ও পুরু আর ডালটা দু’তিন রকম ডাল মিশিয়ে ঘন ও ঝাল করে রাঁধা হয়। গরমের দিনে এ কারণেই রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত হোটেল খোলা রাখে আতাউল। তবে শীতকালে অন্য ব্যাপার। রাস্তা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। রাস্তায় গাড়ি নামায় না চালকেরা। তব কিছু রুটি আর ডাল রয়ে যাওয়াতে আতাউল কাস্টমার আশা করে।

কর্মচারীরা প্রায় সবাই চলে গেছে। মালেক আর সাজু আছে। দোকানের সব কাজ শেষ হলে, হিসাব পত্র মেলানোর পর দোকানের সাটার বন্ধ করে, তালা ঝুলিয়ে আতাউলের হাতে চাবি দিয়ে তবে তারা যায়। না তখনো তারা থাকে। মধু রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে এলে আতাউল বাড়ির পথ ধরলে তবে তারা যায়।
রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হোটেলের ভেতর তাকায় আতাউল। সাজু আর মালেক কান মাথায় মাফলার জড়িয়ে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আতাউল তাকাতেই সাজু বলে, আরো একটু থাকবেইন মামা?
নাহ্। আর থাকি কি হবে। আজ আর কাস্টমার আসার নয়। রুটি-ডালটুকু নিয়ে যাও। স্কুলঘরের বারান্দায় যে পাগলিটা থাকে, ওকে দিয়ে দিও নে। বলতে বলতে আতাউল চেয়ার ছেড়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়।

রাজপুর মফঃস্বল শহর। ডিশ, মোবাইল, ইন্টারনেট সুবিধা থাকলেও নেটওয়ার্ক বড়ই দুর্বল। ইলেকট্রিসিটির অবস্থাও ভালো নয়। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টগুলো বেশির ভাগই নষ্ট। আতাউলের হোটেলের গা ঘেঁষে দুটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, একটা মোটরসাইকেল সারাইয়ের দোকান। তারপর সামনে এগিয়ে ফটোকপির দোকান, সেলুন ইত্যাদি। রাস্তার উল্টোপাড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে সরকারি অফিসের উঁচু দেয়াল। সে দেয়ালের ধার ঘেঁষে কিছু ঝুপড়ি ঘর। পান-বিড়ির দোকান। সরকারি জায়গা দখলমুক্ত করার কর্মসূচি হিসেবে ঝুপড়ি ঘরগুলো আপাতত ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে বাঁশ বেড়ার কঙ্কাল পড়ে আছে। এখন, শীতের এই রাত্তিরে দ্য গ্রেট বেঙ্গল হোটেল ছাড়া এদিকের আর সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য ফরিদের টিভি-ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানটা এখনো খোলা। দোকানের ভেতর থেকে লাল আলো এসে রাস্তায় পড়েছে। সেই সাথে টিভি বা মিউজিক প্লেয়ারে বাজা হিন্দি গানের অস্পষ্ট সুরও ভেসে আসছে।
দোকানের সামনের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আতাউল একটা সিগারেট ধরাতে যাবে, ঠিক সেই সময়ই ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলোয় হালকা কুঁয়াশার মাঝে অস্পষ্ট এক মানব মূর্তি হেঁটে আসতে দেখা যায়।

আবছায়া মূর্তিটি হেঁটে আসছে। যত কাছে আসছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে এক নারীর অবয়ব। রাজপুরের বহু ছেলেমেয়ে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাত-বিরাতে এ এলাকায় একা কোনো মেয়েকে রাস্তায় হাঁটতে দেখাটা এখানে এখন কোনো দুর্লভ দৃশ্য নয়। কিন্তু এটি কে তাই ভেবে আতাউল ভ্রু কুঁচকায়। সাজু সাটার টানতে শুরু করতে সে চেঁচিয়ে ওঠে, এখুনি লাগাস না। একটু থাম।

২.
বড্ড ঝাল ডাল দিয়ে মোটা রুটি খেতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। আতাউলের নির্দেশে সাজু চা-ও বানিয়ে দিয়েছে। এই রাতে হোটেলে দুধ নেই। লেবু নেই। কেবল গরম পানিতে চা-পাতা সেদ্ধ করে ওতে চিনি মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অখাদ্য কী না তা পরখ করতে আতাউলও এক গ্লাস চা নিয়েছে।
মেয়েটার নাম টুসী। রাজপুরে সে এসেছে রজতের খোঁজে।
ডালে ভেজানো এক টুকরো রুটি দীর্ঘ সময় ধরে চিবিয়ে নিয়ে ওটা এক চুমুক চা দিয়ে গিলে নিলো টুসী। দরজার একপাশে সাজু আর মালেক বসে আছে। মনে মনে ওরা বিরক্ত। শীতের রাত, এখন বাসায় গিয়ে লেপ-কাঁথা গায় জড়িয়ে ঘুমানোর সময়। আর কোথা থেকে উটকো ঝামেলা এসে হাজির!
মনে মনে বিরক্ত হলেও তার প্রকাশ নেই তাদের মধ্যে। কারণ আতাউলকে ভালো করেই জানে তারা। যা করতে চায়, তাই সে করে।
কালো, হালকা পাতলা গড়নের শরীর আতাউলের। মাথার কোঁকড়ানো চুল ঈষৎ ফিঁকে হয়ে আসছে। শ্যামল কঠিন মুখটার কোথায় যেন একটা মায়া ছড়ানো। সারাদিন হোটেলের ক্যাশে বসে থাকায় এই বয়সেই একটু ভূড়ি গজিয়েছে। তবে দেখতে যাই হোক, সে হলো এককথার মানুষ। একই সাথে জেদি এবং কোমল হৃদয় তার। টুসী নামের মেয়েটা যখন হোটেলের সামনে তিনজন পুরুষ মানুষকে দেখতে পায়, তখন সে ভীষণই ভয় খেয়ে গিয়েছিল।
অচেনা জায়গা, শীতের প্রায় মধ্যরাত। সে একটু দূরে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল। সে সময় আতাউলই কথা বলে উঠেছিল। কে আপনি? আসেন এদিক। ভয় নাই। আমি এ হোটেলের মালিক। এরা আমার কর্মচারী।
মেয়েটা এগিয়ে এসেছিল। হোটেলের আলোয় মেয়েটাকে হালকা একনজর দেখেই আতাউল বুঝে গিয়েছিল ভদ্র বাড়ির শিক্ষিত মেয়ে। তবে এ গ্রামের নয়। মেয়েটার প্রথম কথাই ছিল, আপনার হোটেল কি বন্ধ হয়ে গেছে? প্রায় ১৫ ঘণ্টা খাইনি। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।
অতঃপর আতাউল মেয়েটিকে ভেতরে এনে বসায়। খাওয়ার বন্দোবস্ত করে। মেয়েটি হাত মুখ ধুতে চাইলে আতাউল একটু অস্বস্তিতে পড়ে। তার এখানে বেশির ভাগই খুব সাধারণ লোকজন বা এলাকার মানুষ আসে। ওয়াশরুম তেমন ব্যবহৃত হয় না। হোটেলের বাইরে লাগানো সিরামিকের বেসিনটাতেই লোকজন হাত মুখ ধুয়ে নেয়। আতাউল মনে মনে ঠিক করে ওয়াশরুমটা নতুন করে সাজাতে হবে।

খেতে খেতেই মেয়েটা কথা বলে। ঢাকায় থাকে। দুই মাস হলো মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে। রজত নামে একটা ছেলের খোঁজে এতদূর আসা। ছেলেটা একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করত।
করত মানে? আতাউল প্রশ্ন করে।
টুসী বলে, মানে গত সপ্তাহে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটা আমি জানি না।
রজত মেয়েটির কে হয়, এ কথা সে মুখে না বললেও আতাউল আন্দাজ করে নেয়।
মেয়েটি বলে, রজতকে ফোনে পাচ্ছি না। শেষে বাসায় কাউকে কিছু না জানিয়ে এখানে চলে এলাম। ওর বাড়িতে যাবো। অন্তত যোগাযোগ করছে না কেন সেটা জানতে।
কেন যোগাযোগ করছে না সেটা আপনি বুঝছেন না?
আতাউলের প্রশ্নে মেয়েটা চুপ করে থাকে।
আতাউল প্রসঙ্গ ঘোরায়। খেতে কষ্ট হচ্ছে, না? যা হোক পেটে কিছু দেন। এত রাতে আপনি কই যাবেন?
বাস এত লেট করবে বুঝতে পারিনি। মেয়েটা রুটির টুকরো দলা পাকাতে থাকে। ভেবেছিলাম দিনে এসে পৌঁছাব।
এখন এই রাতটা কোথায় কাটাবে ভেবে সে উৎকণ্ঠিত হয়। একটা আবাসিক হোটেল কি আছে আশেপাশে? জানতে চায়।
আতাউল বলে, যদি কিছু মনে না করেন আপনি আমার সাথে আমার বাসায় যেতে পারেন। রাতটা কাটিয়ে সকালে আপনার কাজে বের হবেন। অবশ্য যাবেন কী না সেটা আপনার ইচ্ছে।
টুসী বলে, যাবো। এত রাতে নইলে আর কই থাকব।
আতাউল চিৎকার করে সাজুকে বলে, মধুরে বল চলে যেতে। আমি হেঁটে বাসায় যাবো।

৩.
পূর্ণিমা তিথি। শীতের রাত হলেও কুঁয়াশা চাঁদটাকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারেনি। নরম ঝাপসা একটা আলো লেপ্টে আছে প্রান্তরজুড়ে। দু’পাশে ফসলের ক্ষেতের মাঝখান চিরে ইট বসানো পথ ধরে ওরা হাঁটছে। চারিদিকে থই থই নির্জনতায় কে বলবে দিনের বেলা এ রাস্তা ধরেই লোকজন বাজারে যায়, স্কুল কলেজ যায়, শহরে যায়। এরাস্তায়, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল চলে।
হোটেলের সাটার লাগিয়ে আতাউলের হাতে চাবি দিয়ে সাজু আর মালেক চলে গেছে। আতাউলের বাসা হোটেল থেকে রিকশায় মিনিট কুড়ি লাগে। হাঁটতে হাঁটতে আতাউল বলে, রিকশা বিদায় দিলাম, আমার মতো অপরিচিত কারো সাথে রিকশায় উঠবেন না সন্দেহে।
টুসী বলে, ভালো করেছেন। হাঁটতে বেশ লাগছে।
আপনার তো ক্ষিদা আছে, বাসায় গিয়ে ভাত খাবেন তো?
না, না আমি আর কিছু খাবো না। একটু রেস্ট নিতে পারলেই হয়। জীবনে এত পথ জার্নি করিনি। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
টুসীর কথায় আতাউল একটু আস্বস্ত হয়। এত রাতে বাসায় কে আয়োজন করবে ভেবে মনে উদ্বিগ্ন ছিল।

টুসী একটু চুপ থেকে বলে, আসলে এভাবে অচেনা জায়গায় চলে আসাটাও আমার ঠিক হয়নি।
আতাউল সে কথার উত্তর দেয় না। বলে, একটু সাবধানে হাঁটেন। ইটের রাস্তা, উঁ-ু নীচু কোথাও হোঁচট খেতে পারেন।
শীতের রাত হলেও, পরণে ভারী গরম কাপড় থাকায় ঠাণ্ডাটা ওদের কারোই খারাপ লাগছিল না। বরং ফসলি ক্ষেতের, শুকনো খড়ের, ঝরাপাতার গন্ধমাখা হাওয়ার স্পর্শ কেমন যেন ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
আগে কখনো এভাবে শীতের রাতে গ্রামের পথে হাঁটেনি টুসী। পাশে অপরিচিত পুরুষ। অথচ ভয়ের বদলে ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল ও। রজতের কথা, এখানে আসার কথা সব মন থেকে উধাও যেন। মনের অজান্তেই টুসী একটা গান গুন গুন করতে শুরু করল। রাতের নির্জনতায় সেই মৃদু সুর অদ্ভূত এক মোহময় আবেশ ছড়িয়ে দিলো।
গানের সুরে নিমগ্ন হয়ে দু’জন অপরিচিত মানুষ অনেক দিনের পরিচিতের মতো পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
গান একদম শেষ না করে টুসী হঠাৎ থেমে গেল। তারপর লাজুক গলায় বলল, বড্ড বেসুরো গাইলাম। হিহি!
আতাউল নিজেও গান জানে। বলল তা কেন! বেশ লাগছিল শুনতে। সে গান নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। তার কথা বলার ভঙ্গি ভারী মিষ্টি। টুসীরও আতাউলের সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিল। কথায় কথায় কখন যে বাড়ির দরজায় চলে এসেছে টেরই পায়নি ওরা।
আতাউল ঘড়ি দেখে। সোয়া একটার কিছু ওপরে বাজে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
মস্তবড় উঠানের দুইপাশজুড়ে বিল্ডিং। সামনে লম্বা টানা বারান্দা। বারান্দার এক পাশ দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি। আতাউল টুসীকে নিয়ে দোতলায় উঠে আসে। বিশাল ছাদের একপাশে দুটো ঘর। আতাউল একটা ঘরের তালা খুলতে খুলতে বলে, আমি এখানে থাকি। এটা আমার ঘর। আপনি রাতে এখানে ঘুমাবেন। আমাদের গ্রামগঞ্জে কারো বাসায় গেস্ট রুম কিছু থাকে না। বাসায় বেশ কটা ঘরই খালি আছে। কিন্তু লোকজন থাকে না। তাই তেমন পরিষ্কার নয়। হঠাৎ একটা বন্ধ ঘর খুলে দিলেও থাকতে পারবেন না। মশা পোকামাকড় ঝামেলা করবে।
বলতে বলতে ঘরের আলো জ্বালে আতাউল। ভেতরে আসেন, দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে টুসীকে ভেতরে ডাকে। টুসী ভেতরে ঢুকবে কী না একটু ইতঃস্তত করে। আতাউল হেসে ফেলে। ভয় পাচ্ছেন? তাইলে আসার দরকার নেই। আপনি ছাদে হাঁটাহাঁটি করেন। ওই যে দেখেন টবে একটা গন্ধরাজ গাছ আছে। পুরো ছাদে ওই একটাই গাছ। কেন জানেন?
বলতে বলতে আতাউল টুসীর পাশে এসে দাঁড়ায়।
টুসী অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কেন?
আতাউল বলে, পরীদের জন্য।
যাহ। মিছে কথা।
মোটেই মিছে নয়। সত্যি। দেখছেন না ছাদটা কত বড়। এখানে মাঝে মধ্যেই জ্বীন-পরীরা এসে বিশ্রাম নেয়।
টুসীর ভূত প্রেতে তেমন ভয় নেই। ও পুরো ছাদে দৃষ্টি বুলায়। ছাদটা অনেক বড়। এক প্রান্তে কি একটা গাছ ছাদের ওপর বেশ অনেকটুকু ঝুঁকে একটা গাঢ় ঝাঁকড়া অন্ধকার সৃষ্টি করেছে। মধ্যরাতে, কুঁয়াশার ঢাকা রহস্যময় আকাশের নিচে সে অন্ধকার বুকে একটু কাঁপন তোলে বৈ কি। আর তা ছাড়া গ্রামগঞ্জের ব্যাপার। অনেক রকম ঘটনা তো না শোনা নয়!
টুসী আতাউলকে বলে, চলেন ভেতরে যাই।
দুজনে ঘরে আসে। সাদা আলোয় টুসী ঘরের ভেতর চোখ বুলায়। বইপত্র, কাপড়-চোপড়ে তুলকালাম। অগোছালোর চূড়ান্ত। বিছানার ওপর শার্ট লুঙ্গি পড়ে আছে। আতাউল সেগুলো দ্রুত হাতে তুলে নিতে নিতে নিজে নিজেই বলে, কয়দিন ভীষণ ব্যস্ততায় কাটছে। গোছগাছের সময় পাচ্ছি না। তারপর দরজার সামনে গিয়ে বলে, রাত প্রায় ২টা বাজে। আমি তো ৬টায় বেরিয়ে যাই। বাসায় বলা থাকবে। আপনি নাশতা করে বের হবেন। আর প্রয়োজন হলে বাসার কাউকে বলবেন, আমাকে ডেকে দেবে।
এবার দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ুন। আর হ্যাঁ, ওই পাশে বাথরুম আছে।
আতাউল বের হয়ে যায়। নিচে বসবার ঘরে রাতটা কাটিয়ে দেবে ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে।

৪.
ঘরটা বিশাল। একপাশে একটা ছোট্ট তেপায়ার ওপর একটা টিভি। পাশে একটা পানির জগ, গ্লাস। ঘরের একদিকে চওড়া জানালা, খোলা। সর্ষে রঙা পর্দা গোটানো। জানলার বাইরে অন্ধকার ঝুলে আছে। সেই দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যায় টুসী।
বসবার ঘরে একটা বিছানা পাতা আছে। আতাউলের বাবা দিনের বেলা এ বিছানাতেই বিশ্রাম নেন। আতাউল উঠোনের কোণের চাপকল থেকে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে। অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন ঘুমানো প্রয়োজন।
কিন্তু চোখ বুঁজতে গিয়েও মোবাইলটা অন করে। ফেসবুকে গিয়ে টুসী নামে সার্চ দিতে থাকে। অনেকগুলো টুসী আসে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাসার দোতলায় ঘুমাতে রেখে আসা আগন্তুক টুসীকে পাওয়া যায় না। সার্চ দিতে দিতে ক্লান্ত আতাউল আপন মনেই মুচকি হাসে। মনে মনে বলে, কী বোকা আমি! হয়তো মেয়েটা অন্য নামে আইডি খুলেছে। আর আমি ---!!-- ওর ফেসবুক আইডির দরকারই বা কি আমার!
ফোনটা বালিশের পাশে রেখে পাশ ফিরে শোয় সে।
আতাউল চলে যাবার পর টুসী অনেক ক্ষণ চুপ করে বসে রজতের কথা ভাবছিল। রজতের সুন্দর মুখশ্রী ও সুমিষ্ট বচনে ও এতটাই বিমোহিত হয়েছিল যে, তার সম্পর্কে কোনিা কিছু জানার কথা মনেই হয়নি কোনাদিন। এ গ্রামের নামটা কথায় কথায় একদিন রজত বলেছিল। তার বাড়ির ঠিকানা বা কে কে আছে অথবা আর কোন ভাই বোনের নাম কিছুই জানা নেই টুসীর। কি সূত্র হাতে নিয়ে রজতকে খুঁজবে টুসী? গ্রামে লোকদের কাছে গিয়ে জনে জনে জিজ্ঞেস করবে রজতকে চেনে কি না?
পরিবারের লোকদের কাছে নিঃসন্দেহ থাকতে নিজের স্মার্ট ফোনে রজতের একটা ছবিও সেভ করে রাখেনি। এসব চিন্তার পর টুসী একটা সিদ্ধান্তেই এসেছে ও আর রজতের খোঁজ করবে না। সকাল হলেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে। বাসার সবাই নিশ্চয়ই ভাবছে। টেনশন করছে। পুলিশে খবর দেয়াও অসম্ভব নয়। বাসায় ফিরে যাবে ও। তার আগে অবশ্য বাসা থেকে না বলে বেরোবার একটা কারণও বানাতে হবে।
টুসীর ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করে। প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসে না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা আসছে। গায়ের চাদরটা জড়িয়ে বিছানার কোণে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে। একসময় আর শুয়ে থাকতে পারে না। ওর মনে হয় এখুনি মনের ইচ্ছাটা কারো সাথে শেয়ার করা উচিত। মোবাইলে বন্ধু-বান্ধবদের নামগুলো এক এক করে দেখে। কিন্তু কারোকেই নিজের মনের কথাগুলো বলার উপযুক্ত মনে হয় না। তারচেয়ে সদ্য পরিচিত, একদম অচেনা এক গ্রাম্য হোটেলের মালিক আতাউলকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়। মনে হয় এই লোকটার সাথে নিজের সিদ্ধান্তটা শেয়ার করা যেতে পারে।
ঘুম কিছুটা গাঢ় হয়েছিল বুঝি। দরজায় ধাক্কা শুনে টুটে গেল। আতাউল ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখে টুসী দাঁড়িয়ে। আতাউলের বিস্ময় দৃষ্টিকে লক্ষ না করে টুসী ঘরে ঢুকে বসতে বসতে বলে, আমি ঠিক করেছি আমি আর রজতকে খুঁজব না। আপনি সকালে হোটেলে যাওয়ার আগে আমাকে একটু বাসে তুলে দেবেন, প্লিজ।
আতাউল বিরক্ত হয়ে বলে, সকাল হতে তো আরো দেরি। আপনি নাশতা খাওয়ার সময়ও কথাটা বলতে পারতেন।
আমি নাশতা খাবো না। তার আগেই যাবো।
সে তো হবে না। গেরস্থ বাড়ি থেকে সকাল বেলা কাউকে না খেয়ে বেরোতে দেয়া হয় না।

ছি: ছি: তুমি শেষ পর্যন্ত ঘরে মেয়ে নিয়ে এসেছ... নারী কণ্ঠের ছিছিক্কারে আতাউল এবং টুসী দুজনেই চমকে ওঠে। দরজার সামনে আতাউলের স্ত্রী নাঈমা দাঁড়িয়ে আছে। এলো চুল, ঘুম ভাঙা চোখে রাগ জ্বলছে।
আতাউল আর নাঈমার প্রেমের বিয়ে। পরস্পরকে চোখে হারায়। আবার মাসে তিন চারবার ঝগড়া হয় ওদের। আর সে সময় নাঈমা আতাউলকে ঘরে ঢুকতে দেয় না। আতাউল তখন দোতলার ঘরে শোয়। আজ তিনচারদিন সেইরকম ঝগড়া কাল চলছিল। ঝগড়া চলাকালীন আতাউলকে বিব্রত করার চেষ্টায় থাকে নাঈমা। মূল উদ্দেশ্য স্বামীকে চাপে রাখা। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর বাগানে যাওয়ার জন্য উঠানে নেমে হঠাৎ বসারঘর খোলা দেখে এগিয়ে এসে আতাউল আর টুসীকে গল্পরত দেখতে পেয়ে সে ধরেই নিয়েছে টুসী আতাউলের প্রেমিকা। নাঈমার থেকে দূরে থাকার সুযোগে প্রেমিকাকে ঘরে নিয়ে এসেছে আতাউল।
নাঈমার রাগের কারণ বুঝে আতাউল তাকে বোঝাতে থাকে, টুসী তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। এক রাতের অতিথি মাত্র। ঝগড়ার কারণ বুঝে টুসী হতভম্ব হয়ে পড়ে। ও বিব্রত কণ্ঠে বলে সরি, আপু আপনি আমার কথা শুনুন।
কিন্তু কোনো কথাই শোনে না নাঈমা। রাগী কণ্ঠে আতাউলকে বকা দিতে দিতে বেরিয়ে যায়। আতাউলও নাঈমার পেছন পেছন ঘর ছাড়ে।
টুসী কিছুক্ষণ কি করবে বুঝতে না পেরে থম মেরে বসে থাকে। ইস ওর জন্য একটা সংসারে ঝগড়া বেঁধে গেল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগতে থাকে। সকাল সাড়ে ৬টা বাজে। কিন্তু গাঢ় কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু তাই বলে এ বাসায় বসে থাকাটাও ভালো লাগে না।
ব্যাগটা হাতে তুলে কুয়াশার মধ্যেই রাস্তায় নেমে পড়ে টুসী।

৫.
হোটেলে এসেই বাস স্টপেজে টুসীর খোঁজে সাজুকে পাঠিয়েছিল আতাউল। সাজু টুসীর দেখা পায়নি।
ক্যাশ কাউন্টারে বসে কাস্টমারের কাছে থেকে পেমেন্ট বুঝে নিতে নিতে আতাউল ভাবে টুসীর সাথে এই জীবনে আর কোনোদিনই হয়তো দেখা হবে না। পৃথিবীতে একজীবনে ক্ষণিকের জন্য কতো মানুষের সাথেই না পরিচয় হয়। যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু স্মৃতিতে ঠিকই থেকে যায়।

(এ গল্পের চরিত্র ও কাহিনী পুরোটাই কাল্পনিক। বাস্তবে কারো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us