বিশ্বকাপ ক্রিকেট বাংলাদেশের স্বপ্ন
বিশ্বকাপ ক্রিকেট বাংলাদেশের স্বপ্ন - ছবি : সংগ্রহ
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তাদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছে। এবারের বিশ্ব¦কাপ ক্রিকেটের আসর বসছে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে। উদ্বোধন হবে ৩০ মে। জমজমাট এই ক্রিকেট মহাযজ্ঞ চলবে এক মাস ধরে। দশটি দল অংশ নিচ্ছে। প্রতিটি দলের ক্রিকেটাররা টানটান উত্তেজনায় সময় ও দিনক্ষণ গুনে চলেছে। কেউ কাউকে ছেড়ে দেবে না তা বলাই বাহুল্য। দশ অধিনায়কের লক্ষ্য একটাই, তা হলো বিশ্বকাপ ট্রফিতে হাত ছোঁয়ানো। বিজয়ের আনন্দে এবং ক্রিকেটের নান্দনিকতায় নতুন ইতিহাস রচনা করা। যে ইতিহাস আগামী চার বছর সারা বিশ্বকে তোলপাড় করবে। বিশ্বকাপে নিজেদের সেটারা মেলে ধরার জন্য দলগুলো কঠিন পরিশ্রম সেরে নিয়েছে। এবারের ফরমেট একটু ভিন্ন। প্রতিটি দল একে অপরের মুখোমুখি হবে। ফলে জার্নি টু ওয়ার্ল্ড কাপ বেশ কঠিন হবে। ক্রিকেট যেহেতু চরম অনিশ্চয়তার খেলা তাই কোন দল ফেবারিট তা বলা মোটেও সহজ হবে না। প্রতিটি ম্যাচই হবে চরম পরীক্ষা। ভুলত্রুটি হয়ে গেলে পড়ে যেতে হবে খাদের কিনারায়। আসরের শক্তিশালী দলগুলো সে কথা জানে। তাই লড়াকু মনোভাব নিয়ে লড়তে হবে। জীবনবাজির ম্যাচে পেছন ফিরে তাকানো চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে শুধুই সামনের দিকে।
এবারের বিশ্বকাপে কারা ফেবারিট। এই তালিকা দীর্ঘ নয়। স্বাগতিক ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতকে শিরোপার দাবিদার হিসাবে ধরা হচ্ছে। কারণ এই তিন দেশের ভাণ্ডারে এমন সব ক্রিকেট অস্ত্র আছে যারা যে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী এলোমেলো করে দিতে পারে। সম্প্রতি এই তিন দেশ ওয়ান ডে সিরিজে তাদের দাপট দেখিয়েছে। এদের পরেই রয়েছে নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। এই তিন দেশ সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, ফেবারিট না হলেও চমক দেখিয়ে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় মেলে ধরতে পারে। যা তাদের বিশ্বকাপে ফেবারিটের আসনে বসিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং শ্রীলংকাকে বলা হচ্ছে ডার্ক হর্স। এদের প্রাপ্তির কিছুই নেই। এমনকি হারানোরও কিছু নেই। তবে এরা ফেবারিটদের সহজে ছেড়ে দেবে এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এদের কারিশমা এবং নৈপুণ্য এবারের বিশ্বকাপের চিত্র পাল্টে দিতে পারে।
এবারের বিশ্বকাপে কেমন করবে বাংলাদেশ। ডার্ক হর্স হিসাবে পরিচিত দলটির স্বপ্ন একটাই, তা হচ্ছে বিশ্বকাপ জয় করা। যদিও প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেমিফাইনাইলে খেলা। ইংলিশ কন্ডিশনে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার জন্য আয়ারল্যান্ডে একটি ত্রিদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আয়ারল্যান্ড। এরপর দু’টি প্রস্তুতি ম্যাচ। এ ছাড়া নিজেদের সেরাটা দেয়ার জন্য দেশের মাটিতে কঠোর অনুশীলন এবং প্রশিক্ষণ নিয়েছে টাইগাররা। মাশরাফির মতো অভিজ্ঞ এবং লড়াকু ক্রিকেটার দলের প্রধান সম্পদ। তিনি তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে টাইগারদের এক সূত্রে বেঁধেছেন। এ ছাড়া রয়েছে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, সৌম্য সরকার, লিটন দাস, সাব্বির রহমান, মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, মেহেদী হাসান মিরাজ। কী উজ্জ্বল একেকটি নাম। এরা ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস বিশ্বকাপে অঘটন ঘটিয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।
পেছন ফিরে দেখতে গেলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ বিশ্বকাপের মতো বৃহৎ আসরে ২০০৭ সাল থেকে ভালো করতে শুরু করে। ক্রিকেটের গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে টাইগারদের নৈপুণ্য হীরকদ্যুতির মতো জ্বলজ্বল করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসরে। সেই বিশ্বকাপে শচীন-সৌরভের ভারত এবং জ্যাক ক্যালিসের দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করেছিল মাশরাফি বাহিনী। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছিল বিশ্ব ক্রিকেটের নবীন সদস্য বাংলাদেশের অনুপম ক্রিকেট সৌন্দর্যের কাব্যগাথা। ২০১১ সালে নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে না পারলেও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। আর ২০১৫ বিশ্বকাপে মাশরাফির নেতৃত্বে টাইগাররা কোর্টার ফাইনালে উঠে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে নতুন ইতিহাস গড়ে।
মাশরাফি বিন মর্তুজা তার ২৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ পাদে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ফলে সোনা রঙের শেষ দিনগুলো রাঙাতে চান রংধনুর সাত রঙে। তাই তো ১১ জন লড়াকু ক্রিকেটার নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে পারেন তিনি। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জয়ের সামর্থ্য রয়েছে বলে মনে করেন ম্যাশ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বের দরবারে আজ সম্মান পেতে শুরু করেছে। ক্রিকেট পরাশক্তিদের সমীহ আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। নড়াইল এক্সপ্রেসের নাম সাফল্যের এই মিছিলে জড়িত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত যে চারটি সাফল্য বিসিবির ঘরে এসেছে তার অধিকাংশই মাশরাফির কারিশমার গুণে। এমন একজন ডায়নামিক নেতা এবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন। যা খুবই স্বাভাবিক।
এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ব্যালান্সড দল। তাই স্বপ্নের পারদ ঊর্ধ্বমুখী। তবে মানসিকতা বদল করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে পারেনি। মানসিক চাপে পড়ে দু-একটি উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ের তলানিতে তলিয়ে গেছে। বড় টুর্নামেন্ট জিতলে এসব চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে ইনজুরি সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে পেস ব্যাটারি সম্পর্কে বলা যায় যে, তারা ছোটখাটো ইনজুরিতে সবসময়ই থাকে। দলের বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ। তিনি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ইনজুরিতে পড়েছেন বহুবার। রাতে তিনি ব্যথা অনুভব করলেও সকালে খেলেছেন। এটা অবশ্যই অভ্যাসের ব্যাপার। তাই ছোটখাটো সমস্যা থাকলেও সেগুলো পেছনে ফেলে খেলার মাঠে শতভাগ দিতে হবে।
কন্ডিশন এবং ফরম্যাটের কারণে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপকে বাংলাদেশের জন্য কঠিন মনে করা হচ্ছে। দশ দলের টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ড বা সেমিফাইনালে যেতে হলে লিগ রাউন্ডে ৯ ম্যাচের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি ম্যাচ জিততে হবে। এ জন্য সেমিফাইনালকে টার্গেট করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি। মাশরাফি বলেছেন, এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমাদের সেমিফাইনালে যাওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেমিফাইনালে যদি যেতে পারি তা হবে অনেক বড় অর্জন। কারণ এবারের ফরম্যাট সেই ১৯৯২ সালের মতো। যা সত্যিই কঠিন।
সেমিফাইনালে যাওয়া অনেক বড় অর্জন। আমরা এর আগে সেমিফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে হেরেছি। সেমিফাইনালে উঠতে পারলে আমরা স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি চলে যাবো। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ভালো খেলা উপহার দিতে পারলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল গড়তে পারবে নতুন ইতিহাস। ওয়ানডে ক্রিকেট রানের জন্য আদর্শ কন্ডিশন হচ্ছে ইংল্যান্ড। এখানকার প্রতিটি ভেন্যুতেই রান ওঠে প্রচুর। ওয়ানডে ক্রিকেটে দুটি রানের বিশ্বরেকর্ড হয়েছে (৪৪৪ ও ৪৮১) ইংল্যান্ডে।
ফলে তিন শ’, সাড়ে তিন শ’ রান চেজ করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে। এই লড়াইয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে তামিম ইকবালকে। বাঁহাতি এই ওপেনারের কাছে প্রত্যাশা একটু বেশি। তার পার্টনার লিটন কিংবা সৌম্যকে হাত খুলে খেলার জন্য স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে পেতে হবে ধারাবাহিক পারফরমেন্স। আর পেসারদের মেলে ধরতে হবে নিজেদের সেরাটা। কারণ ভুলে গেলে চলবে না যে, কন্ডিশন ইংল্যান্ডের। তাহলেই ধরা দেবে মহাকাব্যময় এক স্বপ্নময় নীল আকাশ।