যে সৃজনশীল সে সচেতনও
যে সৃজনশীল সে সচেতনও - ছবি : সংগ্রহ
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই সুইডেনের রাজার রাজত্বে, তা নাহলে আমরা এখানে বাস করতে পারতাম না। এখানে যার যা খুশি তাই করতে পারে সত্ত্বেও সবাই কিন্তু যা খুশি করে না এটাও সত্য। গত দু'দিন আগেও সুইডেনের জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে, পুলিশের সামনে, পার্লামেন্টের সদস্যদের সামনে কুরআন শরিফ পোড়াল, সেটা আবার টেলিভিশনে দেখানো হলো। আমরা সাধারণ মানুষ দেখলাম, মনে মনে নিন্দা করলাম, কেউ বাহবাও দিলো, কিন্তু কুরআন শরিফ সেই মনের মধ্যেই রয়ে গেল। এমনকি আরো বেশি মানুষ আল কুরআন পড়তে এবং বুঝতে লেগে গেল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে পবিত্র এই গ্রন্থে যে একবার ঢুকছে সে আর বের হচ্ছে না। গণতন্ত্র এবং বাক-স্বাধীনতার যে দিকটাকে আমি পছন্দ করি সেটা হলো সবাই তার ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। ভালো- মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের দায়ভার কিন্তু আমাদের। যতক্ষণ কেউ আমাকে জোর জুলুম না করছে, ততক্ষণ আমি আমার নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি। এখানে কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে না। কিন্তু যদি কেউ জোর করে আমার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চায় তখনই সমস্যা। যেমন ধরুন, অনলাইনের দুনিয়ায় যার যা ইচ্ছে সেটাই কিন্তু করছে। আমার কাছে কোনো একটি বিষয় মজা লাগছে বা ‘ইন্টারেস্টিং' মনে হচ্ছে, সাথে সাথে সেটা নানাভাবে (ম্যাসেঞ্জারে বা হোয়াটসঅ্যাপে) পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভাবছি না, বিষয়টি অন্যের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে!
পৃথিবীতে এখন কত কিছু ঘটছে, অতীতেও ঘটেছে, কিন্তু এখনকার মতো তখন জানার সুযোগ হয়নি। ভবিষ্যতে জানার আরো সুযোগ হবে। যদি আপনি মনে করেন, আপনি সবকিছু জানতে চান না তার জন্য কিন্তু নানা ধরনের অপশনও আছে, যেমন অনেকেই ইতিমধ্যে দেখবেন ম্যাসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে 'ইগনোর' করে রেখেছে। যত লিঙ্ক, অডিও, ভিডিও, ফটো, টেক্সট পাঠান না কেন, সেটার নোটিফিকেশন পর্যন্ত যাবে না। সমস্যা কী জানেন? একদিন আপনার জরুরি, ব্যক্তিগত, গুরুত্বপূর্ণ, একটি খবর যা সত্যি জরুরি কিন্তু সেটা কারো চোখেই পড়বে না।
কী করণীয় এমতাবস্থায়? উচিত নিজের দেয়ালে যা খুশি করুন, যদি কারো মন চায় দেখবে নইলে দেখবে না। ভালো-মন্দের বোঝা অন্যের ওপর না চাপিয়ে নিজের দেয়ালে রাখুন। আগ্রহীরা পছন্দ বা অপছন্দের ওপর লাইক বা কমেন্ট করবে।
আমি উপদেশ দিতে মূলত লিখতে বসিনি। অতীতের স্মৃতিচারণ করতে লিখতে বসেছি। এর মধ্যে একের পর এক বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে খবরের পর খবর আসছে। লেখায় মনোযোগী হতে পারছিনা। যে খবরটা ঘন ঘন আসছে সেটা হচ্ছে- পুরুষ আটকায় গর্তে কিন্তু নারী আটকায় কিসে? আমার নজরে এসব খবর পড়লেও একটু এড়িয়ে চলি, কিন্তু আমার এক বন্ধু ফোন করে প্রশ্ন করল, তুই আমার মেসেঞ্জারের উত্তর দিলি না, কারণ কী? আমি শুধু বললাম এর উত্তর যে লিখেছে, তারে দিতে বল। সে বলে, এটা পুরো দেশের ‘হট নিউজ‘ অথচ তুই কিছু বলবি না? নাছোড় বান্দা, শেষে বললাম তেঁতুল হবে উত্তর। বন্ধু শুধু উত্তর পেয়ে গেছি বলে টেলিফোন রেখে দিলো। আমিও কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
এবার আসি যে উদ্দেশ্যে লিখতে বসেছি সেই ঘটনা নিয়ে। আমি ছোটবেলায় গরু ছাগলের ভুঁড়ি খেতে পছন্দ করতাম। ভুঁড়িকে সুন্দর পরিপাটি করে ভুনা করলে খেতে সত্যিই দারুণ, যাকে বলে অমৃত। মায়ের হাতের ভুঁড়ি রান্না যারা খাননি, মা বেঁচে থাকতে থাকতে ট্রাই করতে পারেন। ঘটনাটি হবে সম্ভবত ১৯৮৭ সালে। বান্ধবী এসেছে ফিনল্যান্ড থেকে। আদর যত্ন করতে হবে। ভাবছি মজাদার বাংলাদেশের কিছু একটা রান্না করব। জিজ্ঞেস করলাম, কী খেতে পছন্দ কর? সে নিজ থেকে বলল, তোমার দেশের এমন একটি খাবার, যা তুমি তোমার মায়ের হাতে খেয়েছো এবং তোমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার খাবার। আমি বললাম, মায়ের হাতের সব খাবারই তো চমৎকার? সে বলল, তা ঠিক, তারপরও তোমার সবচেয়ে প্রিয় কোনো না কোনো খাবার আছে, যা এ মুহূর্তে মনে পড়তেই দেখবে যে তোমার জিহ্বা দিয়ে রীতিমতো পানি চলে আসছে। আমি এ কথা শুনতেই গরুর ভুঁড়ির কথা ভাবছি, কিন্তু গরুর ভুঁড়ি কোথায় পাব? পেলাম না হয়, মান-ইজ্জতসহ প্রেম-প্রীতি ধুলিস্যাৎ হবে, সাথে রটাবে বদনাম। দরকার নেই বাবা, অন্যকিছু ভাবতে হবে। আমি ভাবছি! অতিথি আমার নাছোড়বান্দা, বলে, প্লিজ তোমার প্রিয় খাবার কিন্তু রান্না করবে।
আমি ইতিমধ্যে দুই বছর হলো সুইডেনে, রান্না-বান্না ভালোই শিখেছি। মাঝে মধ্যে মাকে চিঠি লিখতাম তখন, কোন খাবার কিভাবে রান্না করতে হবে জানার জন্য। আমি ইতিমধ্যে এক বাঙালি বড় ভাইয়ের বাসায় গরুর ভুঁড়ি খেয়েছি, দেশের মতো অতো ভালো হয়নি, ফ্রিজে করে দেশ থেকে এনেছিল। তবে সেই ভাইয়ের বউ বলেছিলেন, শহরে একটি ইস্ট ইউরোপিয়ান দোকান আছে, সেখানে গরুর ফ্রোজেন ভুঁড়ি বিক্রি হয়। বলে রাখা ভালো, ভুঁড়ি দিয়ে সুপ তৈরি করে যে সব দেশগুলো খায়, তার বেশির ভাগ দেশ কিন্তু ইস্ট ইউরোপের মধ্যে তখন। ভুঁড়ি স্পেন এবং ফ্রান্সের মানুষও খেয়ে থাকে, তবে নর্ডিক দেশগুলোতে এর তেমন প্রচলন হয়নি তখন।
চলে গেলাম দোকানে যা যা দরকার কিনলাম, সাথে ফ্রোজেন ভুঁড়ি। বান্ধবী জিজ্ঞেস করল, এটা কী? আমি বললাম, এক ধরনের ছোট গোস্ত। একে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মসলাপাতি দিয়ে ভুনতে হবে, তারপর বিশ্বভোজন হবে রাতে। রান্না শুরু করেছি ডর্মিটরির কিচেনে। মোটামুটি সুগন্ধ ছড়িয়ে গেছে। কিচেনে যেই ঢুকছে সেই প্রশ্ন করছে কী রান্না করছি? আমি সোজা উত্তর বলছি, অমৃত। ভেবেছিলাম সহজ একটি উত্তর খুঁজে পেয়েছি সেটা দিয়ে চালিয়ে দিব। কিন্তু মহাবিপদে পড়লাম। পাল্টা প্রশ্ন অমৃত কী? বললাম স্বর্গীয় একটি খাবার। বলে স্বর্গীয় খাবার, সে আবার কী? বললাম তোমাদের সবার দাওয়াত রাতে, খেলে বুঝবা।
ডর্মিটরিতে আমরা মোট আটজন প্লাস আমার ফিনিস বান্ধবী। ভাবলাম ভুঁড়িতে তো ঝাল হবে তা একটু ডালও রান্না করে রাখি। রান্নার শুরুতে বেশ একটু খারাপ গন্ধ টের পাচ্ছিলাম। পরে সব ধরনের মসলাপাতির কবলে পড়ে দুর্গন্ধ কিছুটা সুগন্ধে পরিণত হয়েছে। রান্না শেষে খাবার পরিবেশনের পালা। আমি ছাড়া জীবনে কেউ এর আগে ভুঁড়ি খায়নি। সবাই খেতে শুরু করেছে, নানা ধরনের প্রশ্ন সাথে কথা একটাই খুব ঝাল, তবে মজা লাগছে। আমি তখন বললাম, এই সবাই বলছ, মজা লাগছে এটাই হলো সেই স্বর্গীয় খাবার যার নাম অমৃত।
আজ এত বছর পর আমার সেই ঘটনা মনে পড়েছে। কারণ আমরা মজা পেতে এবং মজা করতে পছন্দ করি। এত পছন্দ করি যে সেই মজাকে আমি সেদিন অমৃতের সাথে তুলনা করেছিলাম। এখন সোশ্যাল মিডিয়া যদি আমাদের হাসি-তামাশা তুলে ধরে আর দশজনকে মজা দেয় তবে ক্ষতি কী! তবে সেটা যেন সীমা লঙ্ঘন না করে সেদিকে খেয়াল রাখা আমাদের সকলেরই নৈতিক দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো নিশ্চিত শালীনতার মধ্যে পড়ে না- এ বিষয় সৃজনশীল মানবজাতি সচেতন।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com