সাধের লাউ সুইডিশদেরও বৈরাগী বানাইছে
সাধের লাউ সুইডিশদেরও বৈরাগী বানাইছে - ছবি : সংগ্রহ
আমি ছোটবেলা থেকেই গান গাইতাম, স্কুল এবং কলেজেও গান গেয়েছি। গায়ক, লেখক এমনকি নায়ক হবার শখ ছোটবেলা থেকেই ছিল। কারণ স্কুল এবং কলেজের মঞ্চে গান এবং পুরোদস্তুর অভিনয় করেছি। এমনকি বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা এফডিসি, খুলনা বেতার কেন্দ্র- এসব জায়গাতে কর্তৃপক্ষের সাথে তখন দেখা করেছি। অতি অল্প বয়সে এ ধরনের কাজ করেছি সত্ত্বেও পেশা হিসেবে গান বা অভিনয় করার সৌভাগ্য হয়নি। তবে নেশা হিসেবে এসব অভ্যাস হৃদয়ে এখনো গেঁথে আছে।
আমার ছোটবেলায় 'সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী/ও সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী'/লাউয়ের আগা খাইলাম, ডোগা গো খাইলাম, আগা খাইলাম, ডোগা গো খাইলাম/লাউ দিয়ে বানাইলাম ডুগডুগি/আমি লাউ দিয়ে বানাইলাম ডুগডুগি'... গানটি বেশ জনপ্রিয় ছিল, এখনো এতবছর পার করার পরও গানটি বেশ জীবনসাথী হয়ে আছে দূরপরবাসে। কারণটি কী জানেন? আসুন জেনে নিই সেটা।
লাউ সত্যি একটি দারুণ সব্জি যা বাঙালি না হলে বোঝা যাবে না। হাজার শাকসব্জির মাঝে লাউ কেন যেন এক অমৃত সব্জি, কী এমন জাদু রয়েছে লাউয়ের মাঝে? লাউয়ের মধ্যে যে শুধু জাদু রয়েছে তাই নয়, রয়েছে মধুও। কারণ লাউকে নিয়ে যে গান রচিত হয়েছে আজ থেকে শত বছর আগে, সেই গানের সুরে আছে মধু মেশানো। সেই যে কবের কথা যখন দুলাল ভৌমিক ও হিমাংসু বিশ্বাস মিলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় হঠাৎ একদিন একটি অনুষ্ঠানে সিলেট এসে হাজির। তারা দু'জন ছিলেন পণ্ডিত রামকানাই দাশের ছাত্র। তারা পণ্ডিতজিকে বলল, আমরা 'সাধের লাউ'- এই গানের চার লাইন সংগ্রহ করেছি। কিন্তু আর কোনো লাইন নেই। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের খ্যাতনামা দুই গীতিকার কবি গিয়াসউদ্দিন ও ব্রাহ্মণ রাজবেরী চক্রবর্তী। পরে কবি গিয়াসউদ্দিন ‘সাধের লাউ’ গানের পরবর্তী তিন লাইন লিখলেন- লাউয়ের এত মধু…লাউ করলাম সঙ্গের সাথী..এবং গানের শেষ চার লাইন লিখেন ব্রাহ্মণ রাজবেরী চক্রবর্তী। তিনি যেহেতু ব্রাহ্মণ ছিলেন তাই গয়া ও কাশীর কথা লিখেন। গানটির প্রথম সুর করেন রাজবেরী চক্রবর্তী কিন্তু উপস্থিত মজলিসে আরো সুন্দর সুর তৈরি করার চেষ্টা চলে। তখন পণ্ডিত রামকানাই দাশ একটি সুর তুলেন এবং গাইলেন। সবাই বলল, এইটা ঠিক আছে। পরে সিলেটের বিভিন্ন দলে এই গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সিলেটের গণ্ডি পেরিয়ে এই গানকে দেশে পরিচিত করিয়ে দেন সিলেটের আরেক কিংবদন্তি শিল্পী সুরকার বিদিত লাল এবং এই গানকে মানুষের ঘরেঘরে পৌঁছে দেন কিংবদন্তি রুনা লায়লা।
বিদিত লাল দাস বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে চীন, সুইডেন, নরওয়ে, হংকং, ডেনমার্ক এবং ইংল্যান্ড সফর করেন। তবে ইতিহাস যাই বলুক না কেন, গানটি ১৯৮১ সালে রেকর্ডের সময় যাদের কথা উঠে আসে তারা হলেন গীতিকার : পণ্ডিত রামকানাই দাশ, সুরকার : বিদিত লাল দাস এবং প্রথম রেকর্ডের কণ্ঠশিল্পী : রুনা লায়লা। যাহোক গানটি এখনো যেমন চলমান ভবিষ্যতেও সেইভাবে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
অনেকের মতে লাউ শত শত সব্জির মঝে একটি সব্জি। কথাটি সত্য, তারপরও ভাবুন লাউকে নিয়ে গান থেকে শুরু করে কত কিছুই না হয়ে চলছে। লাউ এখন সারা বিশ্বে, লাউ এখন ঝুলছে আমার সুইডিশ বাগানে। লাউ এখন সুইডিশ জাতির প্লেটে, লাউ এখন স্পেন, ইটালি, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে। লাউ শুধু তরকারি হিসেবে নয়, মিষ্টান্ন খাদ্য হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করছে। আমি সুইডেনে নানা ধরনের সব্জি রোপণ করেছি তবে লাউয়ের প্রতি আমার দুর্বলতা কেন এত বেশি? এ প্রশ্ন আমার স্ত্রী কয়েক বছর আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন।
সময়ের সাথে লাউয়ের আগা, ডগা, পাতাসহ লাউ খেতে খেতে তিনিও কিছুদিন আগে একটি খাবার টেবিলে বলে দিলেন- লাউ হচ্ছে সব্জির জগতের সবচেয়ে মজাদার খাবার এবং এ সব্জি সত্যিই অমৃত। অমৃত কী তা কেউ জানে না, তবে তিনি আমার থেকে কোনো এক সময় শুনেছিলেন শব্দটি, সেটা হঠাৎ সেদিন জনসমাজে ব্যবহারও করলেন। অনেকে বলবে বেগুন, পটল, আলু, ফুলকপি- এসব সব্জিও তো মজাদার খাবার। নিঃসন্দেহে, তারপরও লাউ সকল সব্জির মাঝে রানি।
বাংলাদেশে জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় মাছ ইলিশ। জানি না জাতীয় সব্জি কী! তবে লাউ কি হতে পারে না আমাদের প্রাণের প্রিয় জাতীয় সব্জি? আমি যার জায়গায় লাউসহ অন্যান্য সব্জি রোপণ করি, তিনি একজন নাম করা সুইডিশ কৃষক পরিবারের সন্তান। সুইডেনে এখনো মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশ লোক কৃষিকাজে নিয়োজিত। ১৭৯২ সাল থেকে আমার বাড়ির পাশে এই কৃষক পরিবারের বাগান বাড়ি। এই বাগান বাড়ি অনেক জায়গা নিয়ে অবস্থিত। এব্বা হোর্ন (Ebba Horn) বর্তমান এই জমিদারি দেখাশোনা করছেন। এব্বার এই বাগান বাড়ির সাথে সুইডিশ সামারে আমিসহ আরো কিছু সুইডিশ পরিবার মিলে ছোট্ট একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি যেখানে রয়েছে নানা ধরনের সব্জির চাষ। নিচের ছবিতে বাগানবাড়িসহ লাউয়ের সাথে যাকে দেখতে পাচ্ছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই সুইডিশ ল্যান্ড লেডি, এব্বা হোর্ন। দেখুন লাউটাকে ধরে কী আনন্দে মেতে আছেন তিনি!
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com