গণতন্ত্র মানে জনগণ দেশের মালিক
গণতন্ত্র মানে জনগণ দেশের মালিক - ছবি : সংগ্রহ
গণতন্ত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আছে সেগুলো যদি সঠিকভাবে রাষ্ট্র পূরণ করতে না পারে তখনই সেই দেশের গণতন্ত্রের পতন ঘটে। যেমন : ধরুন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮৫০ ডলার। একই সাথে তাদের মাথাপিছু বৈদেশিক একটি ঋণ রয়েছে যা প্রায় ৬০০ ডলার। তারপর অনেকের দেশী বা ব্যক্তিগত ঋণ রয়েছে। সব মিলে জনগণ যদি তার আয় এবং ব্যয়ের ভারসাম্য সঠিকভাবে মেলাতে না পারে তখনই পরিবার, সংসার, সমাজ তথা দেশজুড়ে কলহের সৃষ্টি হয়। সরকার দেশ চালাতে তখন হিমশিম খেয়ে বহির্বিশ্ব থেকে আরো বিদেশী ঋণ নেয়। কিন্তু যদি রাষ্ট্র জনগণের সাথে কোনো কমিটমেন্ট ছাড়াই এ ধরনের কাজ করে তখন জনগণ দেশের চিন্তা ছেড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়। মানি লন্ড্রি বা মানি হুন্ডি এসকল দুর্নীতি করে। এ ধরনের ঘটনা বিশ্বের অনেক দেশে অতীতে ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে।
জনগণের নির্বাচনে যে সরকার গঠিত সে সরকার সবসময় জনগণের হয়ে কাজ করতে চেষ্টা করে, জনগণ তথা জনগণের প্রতিনিধির কাছে জবাবদিহি করে। দরকারে বহির্বিশ্ব থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। এখন যদি এসব ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করতে সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে শেষে জনগণের ঘাড়ের ওপর সে ঋণ সুদ আসলে চেপে বসে। কিন্তু যদি জনগণের কমিটমেন্ট ছাড়া কেউ এমন কাজ করে তবে কি মনে হয় জনগণ কি সে দায়ভার নেবে?
দেশের বাইরে থাকলেও দেশের নানা সমস্যা প্রতিনিয়ত আমার চোখে পড়ে। ওই সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আগে খুঁজি সমস্যার কারণগুলো। একটি সমস্যার সাথে আরেকটির সংযোগ রয়েছে। যেমন দুর্নীতির পেছনে রয়েছে শিক্ষার অবনতি। বন্দুকযুদ্ধ বা খুন-খারাবির পেছনে বিবেকের অবক্ষয় এবং অভাব-অনটন জড়িত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ন্যায় বিচারের অভাব বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এসব সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ওপরের সমস্যাগুলো শুধু যে বাংলাদেশে তা নয়; এ ধরনের সমস্যা কমবেশি সব দেশে লক্ষণীয়। এর মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশ এবং আফ্রিকার অনেক দেশ উল্লেখযোগ্য। যেসব দেশের সাথে বাংলাদেশের মিল দেখেছি তার মধ্যে একটি জিনিস বেশ পরিষ্কারভাবে লক্ষণীয়- জাতীয় জীবনে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। এখন প্রশ্ন, সামাজিক নিরাপত্তা কী এবং তা কিভাবে পাওয়া যেতে পারে? যেসব দেশে সামাজিক নিরাপত্তা রয়েছে তার স্বরূপ কেমন?
সামাজিক নিরাপত্তা মানে জাতির নূন্যতম একটি আয়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শিশু পুষ্টির ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, ছেলেমেয়ের স্কুলের ব্যবস্থা, বৃদ্ধের ভাতা, শান্তি এবং স্বস্তিতে বসবাস করা, বলতে গেলে কমবেশি সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
কিছু দেশে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেমন নিকটতম দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া। কিছু দেশে উচ্চতম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি। আবার অনেক দেশে বলতে গেলে এর কিছুই নেই যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ।
বাংলাদেশের পরিবর্তন আনতে হলে জনগণের ভালোবাসা, বিশ্বাস যদি সরকার অর্জন করতে না পারে তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা, দুর্নীতিমুক্ত, খুন-খারাবি, কুশিক্ষা এর কিছুরই পরিবর্তন হবে না। সেক্ষেত্রে প্রথম কাজটি হবে মানুষের কাছে গণতন্ত্রের চাবি ফিরিয়ে দেওয়া। অতীতে কে কী করেছে বা না করেছে এ প্যাচাল ছেড়ে নতুন প্যাচাল পাড়তে শিখুন যেমন গণতন্ত্র মানে জনগণ দেশের মালিক। অতএব গণতন্ত্রের চর্চা করতে শিখুন। যেমন জনগণের ভোটাধিকার, সেটা আগে প্রতিস্থাপন করুন, কায়েম করুন। ভোট চুরির বিদ্যা ছেড়ে সুস্থ এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন প্রতিস্থাপন করুন, সর্বোপরি শাসন, শোষণ এবং ভাষণ ছেড়ে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ুন। প্রতিটি নাগরিককে সম্মানের সাথে তাদের সামাজিক মৌলিক অধিকার এবং তাঁরাই যে মাস্টার অব দ্য আর্ট তা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। তাহলে সম্ভব বাংলার মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।
আমরা কি প্রস্তুত এমন একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে? আমি সুইডেনে থাকি, দেখছি এখানে কিভাবে বেকার ভাতা দিয়ে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করছে। এখানে যদি কেউ লেখাপড়া করতে চায় তাকে সে সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এখানে ভেজাল খাদ্যের কোনো উৎস নেই। এখানে দুর্নীতির জায়গা নেই। এখানে গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিস হচ্ছে প্রতিক্ষণ। সরকার দায়বদ্ধ তার মাস্টারের কাছে জবাবদিহি করতে এবং করছে। পুরো প্রশাসন জনগোষ্ঠীর জন্য ২৪ ঘণ্টাই তাদের সেবায় নিয়োজিত।
জনগণকে তার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে এবং প্রশাসনকে জনগণের পাশাপাশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেশকে সুইডেন বা নিউজিল্যান্ড করার স্বপ্ন দেখতে হবে এবং তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
প্রথম যে কাজ করতে হবে তা হলো সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। তবে শুরু করতে গেলে নতুন ধরনের বাধা আসতে পারে। তাই একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, সেই একাত্তরের রক্তের দাগ এখনও আমার মতো অনেকের হাতে লেগে আছে এবং সেটা তারা কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবে না। সেই রক্তের দাগ দুই ধরনের মানুষের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে। যারা বাংলাদেশ চেয়েছিল এবং রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করে গেছে; আর যারা বাংলাদেশ চায়নি, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, লেখকের হাত কেটেছে, মানুষের চোখ তুলে নিয়েছে, মানুষের বুক চিরে হৃদপিণ্ড বের করে নিয়েছে। তারা এবং তাদের বংশধর এখনো বেঁচে আছে। এত বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু তারা একবারও নিজেদের দোষ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। একাত্তরের ঘটনা আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের কাছে পুরোনো ঘটনা নয়; একাত্তরের ঘটনা আমাদের শরীরের রক্তক্ষরণ। আমি অনেক কিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করি, কিন্তু এই একটি ব্যাপার আমি কখনও ভুলিনি।
চলছে ধর্ষণ, দুর্নীতি, মানুষে মানুষ খুন, নীতিতে দুর্নীতি ঢোকানো, খাবারে ভেজাল মেশানো এসব হয়েছে বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ জনগণের কাজ। এরা কারা এদের চিহ্নিত করুন, বিচারের আওতায় আনুন, বিচার করুন।
সবকিছু জেনে শুনে, নতুন করে একত্র হয়ে, দেশের স্বার্থে, অতীতের কথা ভুলে, আর পুরোনো স্মৃতি মনে রেখে, সম্ভব হবে কি আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দেশ গড়ার কাজে? আমি বিশ্বাস করি, সম্ভব হবে। দেখুন ফিনল্যান্ডকে, অল্প বয়সের নতুন প্রজন্মের একটি মেয়ে, প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন নতুন করে ভাবিয়েছে তার দেশকে, মানুষকে। দেখুন জেলেনস্কি, ট্রুডো, সানা মারিন এরা স্যুট পরে নয়, জ্যাকেট পরে নিউ লুক, নিউ ইমেজ নিয়ে নেমেছেন পরিবর্তনের জন্য। এরা যখন পারছে কেন আপনারা পারবেন না!
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com