মেসি, মেসি এবং মেসি
মেসি, মেসি এবং মেসি - ছবি : সংগ্রহ
পৃথিবীতে দুটি শহর আছে, যেখানে নবজাত শিশুদের জন্য দুইটি নাম রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইন করে। কারণ, সেই শহরে বিপুল সংখ্যায় দম্পতিরা তাদের শিশুদের জন্য ওই নামটি রাখছিলেন কয়েক বছর ধরে। এতে করে স্কুলে সমস্যা হচ্ছে, ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রেও হবে। শহরটি অর্হেন্তিনার (ইংরেজিতে আর্জেন্টিনা) তৃতীয় বৃহত্তম শহর রোসারিও। নামের জন্য নিষিদ্ধ শব্দটি 'মেসি'। এত কষ্ট করে গর্ভধারণ করে মায়েরা বাচ্চার নাম রাখতে চান 'মেসি'। কতটা ভালোবাসা থাকলে এমন পাগলামি করা যায়!
অন্যদিকে কাশ্মিরে এর আগে কখনো ‘আরতুগ্রুল’ নামে কেউ ছিল না। অথচ গত দু’তিন বছরে এ উপত্যকায় যেসব শিশু জন্ম নিয়েছে তাদের অনেকেরই নাম রাখা হয়েছে ‘আরতুগ্রুল’। ওই কাশ্মিরেও আর্তুগুল গাজী নামকরণ নিষিদ্ধ করার জন্য আইন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা হচ্ছে।
যাহোক সেই আইন করা শহরের মেসির জন্মদিন আজকে। শুভ জন্মদিন লিওনেল অ্যান্দ্রেস মেসি আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের প্রিয় ফুটবলার।
কৈশোরে মেসির জন্য প্রতিদিন সকালে নিয়মিত বাজারে পত্রিকা পড়তাম। কম করে হলেও তিন থেকে চারটা পত্রিকা না পড়লে পেটের ভাত হজম হবে না মনে হতো! কৈশোরে তার অলিম্পিক গেমসের ফাইনাল ম্যাচ দেখেছিলাম আমাদের বাজারে বসে। সেই দিন দুই বন্ধু (এখলাছ) তার সোনার মেডেল জিতার আনন্দে বাজার থেকে তৃপ্তির হাসি দিয়ে অনেকটা নাচানাচি করে এসে ছিলাম বাজার থেকে।
এত আনন্দ আর কখনো ফুটবলে পাইনি মেসির কাঁধে ভর করে ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বজয় করে যেন সে আনন্দ পায়নি! কৈশোরের ভালোবাসা যে আলাদা।
ফুটবলের বাইরের একজন মানবিক মেসির গল্প শোনাবো। ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০১৮ সালে পৃথিবীর সেরা ৫০ জন দাতার তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকার অন্যতম একজন হচ্ছেন আর্জেন্টিনার সুপারস্টার লিওনেল মেসি। ফোর্বস বলছে, লিওনেল মেসির বার্ষিক আয় ৭৪০ কোটি টাকা।
এর ২৫ ভাগই তিনি দান করে দেন দাতব্য সংস্থা ইউনিসেফকে! বাকি ৭৫ ভাগের চল্লিশ ভাগ যায় অন্যান্য দাতব্য তহবিলে। ‘সিএনএন’ জানিয়েছে- মেসি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করা খেলোয়াড়দের মধ্যে দ্বিতীয়। সারা বিশ্বে এই ভদ্রলোকের টাকায় ১৮৯টি দেশে তৈরি হয়েছে সাড়ে আট হাজারের বেশি স্কুল!
এছাড়া সারা পৃথিবীর চার কোটি শিশুর স্কুলের যাবতীয় খরচ দিয়ে তিনি থাকেন। গত বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার ১৬০০ বাচ্চার জন্য ২০টি ক্লাসরুম উপহার দিয়েছিলেন তিনি। আবার ২০১৪ বিশ্বকাপে রানার্সআপ হওয়ার পুরো টাকাটাই তিনি দিয়েছেন আর্জেন্টিনার একটা হাসপাতালকে!
ইসরাইলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে মাঠে নামলেই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পেয়ে যেতেন লিওনেল মেসি! তবে টাকা নয়, আত্মসম্মান ও মানবতাকেই বড় করে দেখলেন মেসিরা। তাই কাড়ি কাড়ি টাকা প্রাপ্তির নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া করে দেশের ফুটবল ফেডারেশনকে দিয়ে ম্যাচটা বাতিলই করালেন মেসি!
মানবতাকেই বড় করে দেখলেন মেসিরা। তাই কাড়ি কাড়ি টাকা প্রাপ্তির নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া করে দেশের ফুটবল ফেডারেশনকে দিয়ে ম্যাচটা বাতিলই করালেন মেসি!
এমনকি ইরায়েল যখন ফিলিস্তিনের শিশুদের ওপরে হামলা করছিল তখনো তিনি বলেছিলেন- আমি ঘৃণা করি সেই লোকেদের যারা নিরীহ বাচ্চাদের ওপর হামলা করার নাম দিয়েছে যুদ্ধ!
পৃথিবীর সবচেয়ে হার্টথ্রব স্পোর্টস জার্নাল ‘প্লেবয় ম্যাগাজিন’ লিখেছিল- মেসি এই গ্রহের খেলোয়াড় না, মেসি ভিনগ্রহের! তখন অনেকেই খুব হেসেছিলেন। কারণ আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো এক ম্যাচ ভালো না খেললেই, গোল করতে না পারলেই সহজেই বলে দেওয়া যায়- এই খেলে ভিনগ্রহের খেলোয়াড়!
কিভাবে? ‘প্লেবয়’ ম্যাগাজিন আসলে ঠিকই লিখেছিল। কারণ এই গ্রহে থেকেও গ্রহের মানুষদের খবর রাখে কয়জন? টাকা থাকলেই দেয় কয়জন? আমাদের অসংখ্য মন্ত্রী এমপি আছেন যাদের জন্য আমাদের মাথা কাটা যায়। যারা দেশের কোটি টাকা মেরে দিয়ে সুইস ব্যাংকে জমিয়েছেন। সাধারণ কৃষক শ্রমিকের টাকা পর্যন্ত মেরে দিয়ে জীবনযাপন করছেন বিলাসের সাগরে।
মেসির মতো অসাধারণ মানুষটিকে ভালোবাসার কারণ তার মোহনীয় ফুটবল খেলা নয়। তিনি ভালোবাসা অর্জন করে নিয়েছেন নিজ গুণে। মানবিকতায় যিনি এতো অনন্য, ভালো ফুটবল না খেললেও তার যায় আসে না! মানবিকতার কাছে ফুটবল খুবই তুচ্ছ বিষয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মোর্তাজা আহমাদি নামের পাঁচ বছরের পিচ্চি ছেলেটার কথা মনে আছে? ওই যে ‘ফুটবলের সবচেয়ে দুঃখজনক জার্সি গায়ে ছোট্ট মেসি’ এমন শিরোনামে পুরো বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিল যে। যার স্বপ্ন ছিল লিওনেল মেসি। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ছেলেটা কান্নাকাটি করতো…. যে সে মেসির সাথে দেখা করবে। অনেক কষ্টে যখন তাকে বোঝানো গেল লিও নামের এই গ্রহ তাদের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে; তখন মেসির জার্সির জন্যে বায়না শুরু করতো। যার ঘরে অন্ন জোগাড় করার অর্থ নেই; জার্সি কোথা থেকে আসবে?
বড় ভাই হামায়োন তার এই আবদার পূরণ করল। তাকে তৈরি করে দিয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যাগ কেটে বানানো জার্সি, যার পিছনে লেখা ছিল শুধুই মেসি। আর বালক মোর্তাজা সেটি পেয়েই কি খুশি; তার ঠোঁটে খেলেছিল এক পরশ নির্মল হাসি। যার তৃপ্তির হাসি, নিষ্পাপ মনে খুশি ছোঁয়া লেগে বেরিয়ে এসেছিল ঝর্ণাধারার মতোই।
তার বক্তব্য ছিল যেমন-
'আমাদের বাসার কাছে খেলার কোন মাঠ নাই। আমার একটা ফুটবল ছিল তাও নষ্ট হয়ে গেছে। আমি মেসিকে পছন্দ করি। সে অনেক ভালো খেলে। আমিও বড় হয়ে তার মত হতে চাই। আমার ভাইয়া আমাকে যে জার্সিটি বানিয়ে দিয়েছে ওটা আমার অনেক পছন্দ।'
মোর্তজা ঠিক কতটা ভালোবেসেছিল মেসিকে একবার ভাবুন তো। আমাদের মতই রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষও ঠিক কতটা অনিন্দ্য সুন্দর ফুটবল খেলে যে, এই ছোট্ট বাচ্চা ছেলেও মেসিতে এত মাতাল হয়ে গেল।
মেসি এমনই সুন্দর। আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ আর হতাশা মুহূর্তই এক নান্দনিক ড্রিবলিংয়ে ভুলিয়ে দেওয়ার নাম মেসি। বাঁ পা দিয়ে সবুজ মাঠে সবচেয়ে সুন্দর ছবি আঁকা শিল্পীর নাম মেসি। ২১ শতকের ইউরোপের প্রায় সব মাস্টারমাইন্ড কোচকে তাদের ডিফেন্স মেকানিজম বদল করতে বাধ্য করা মানুষটি হলো মেসি।
কারিকারি সম্পদ থাকলেই একজন লিওনেল মেসিকে তৈরি করা যায় না! একমাত্র উপরওয়ালা চাইলেই তা সম্ভব হয়।
পৃথিবীর সব মানুষকে তার পায়ের কারিশমা দেখিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছেন। যার বাম পায়ের জাদুতে মোহাবিষ্ট পুরো পৃথিবী। তাঁর ড্রিবলিং যতটা দুর্বোধ্য, মানুষ তিনি ততটাই সরল।
চলতি শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়দের নাম জিজ্ঞেস করা হলে নিশ্চিতভাবেই সবার উপরে থাকবেন। এমন কি সর্বকালের সেরা ফুটবলার মাত্র ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনার সাথে টিস্যু পেপারে চুক্তিবদ্ধ হওয়া মেসি! ক্ষুদ্রকায় দেখে কোচরা ডিফেন্ডারদের মানা করেছিল তাকে কড়া ট্যাকেল না করতে। সেই তিনি কয়েক বছর পর পৃথিবীর সেরা সব ডিফেন্ডারের রাতের ঘুম হারাম করে দিলো তার পায়ের জাদুতে! এরপর থেকে বাকিটা কেবল মেসি, মেসি এবং মেসি।