বাংলা তুমি বিশ্ব প্রযুক্তিতেও কথা বলো
-
বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। এ ভাষা রক্ষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। ভাষা রক্ষার আন্দোলন থেকে আমাদের স্বাধিকার, আর স্বাধিকার থেকে অর্জন করেছি স্বাধীনতা। ফেব্রুয়ারি মাসে এলে দেশে বইমেলা অনুষ্ঠান চলে, সাথে নানা স্বপ্ন, বাংলা ভাষাকে এটা করব, সেটা করব, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর যে লাউ সেই কদু। এভাবে চলছে যুগ-যুগান্তর ধরে। প্রযুক্তির উন্নয়নে ও ভাষা শহীদদের সম্মানে বাংলা প্রোগ্রামিং এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে কী করছে বাংলা একাডেমি আর কী ভাবছেন বিবেচকরা?
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু গেলেন, বাংলা ভাষাও গেল!
বাংলা ভাষায় কথা বলে এখন গোটা বিশ্বে প্রায় ৩২ কোটি মানুষ কিন্তু শুদ্ধ বানানে কত মানুষ এই ভাষা লিখতে পারে? অন্যান্য ভাষা, প্রোগ্রামিং, টেকনিক্যাল অনুবাদে এ ভাষা কত শক্তিশালী? তারপর বানান নিয়ে অনেক পণ্ডিতের রয়েছে নানা পরামর্শও।
ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। এর মুখে বাঁধ দিলে তা হ্রদে পরিণত হয়, বহমানতা আর থাকে না। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের গর্ভ থেকে উৎপত্তি হয়ে বহু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। বাংলা ভাষা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা হিসেবে পরিচিত। তবে, প্রোগ্রামিং এবং টেকনিক্যাল অনুবাদে এ ভাষা অন্যান্য ভাষার সাথে পেরে উঠতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, যারফলে বিশ্ব দরবারে বাংলাভাষার কোন ব্যবহার নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে, আমার মত কিছু লোক অন্যান্য ভাষার মত বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার উন্নয়ন প্রস্তাবনা করেছেন। বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা কর্তৃপক্ষ হিসেবে অদ্বিতীয় অবস্থানে আছে। এমতবস্থাই একটি বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার উন্নয়ন করা এখন কি সম্ভব নয়? বাংলাভাষার উন্নয়ন না হওয়ার কারণে প্রোগ্রামিং ভাষা, টেকনিক্যাল ভাষার উন্নতি করা সম্ভব হচ্ছে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তার নিজ যোগ্যতাই বাংলা শিখছে বটে তবে সে বাংলার কোয়লিটি কখনও বিশ্বে সর্বজনীন স্বীকৃতি পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) বলেছিলেন তার সময়ে, ‘পাঁচ কোটি বাঙালির অধিকাংশই বানান ভুল করে।’
ওই আমল থেকে এখন পৃথিবীতে আমাদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। বর্তমানে আমরা পৃথিবীর মধ্যে এক বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। আমাদের সংখ্যা বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৩২ কোটি হলেও আমরা কিন্তু আমাদের ভাষার শব্দগুলোর বানান সম্পর্কে এখনও একমত হতে পারিনি।
ইংরেজি ভাষার বর্ণমালা মাত্র ২৬টি। তাই দিয়ে ইংরেজিতে সবকিছু লেখা যায়। সেই তুলনায় বাংলা ভাষার বর্ণমালা বেশ বড়। স্বরবর্ণ ১১টা, ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টা, মোট ৫০টা। এরপর আছে কার চিহ্ন, যুক্তবর্ণ ইত্যাদি নানা বিষয়।
আরো আলোচ্য অংশ হলো বাংলা প্রোগ্রামিং ও টেকনিক্যাল ভাষাটি ভাষা শহীদদের জন্য একটি উপযুক্ত স্মরণীয় বিষয় হবে এবং প্রযুক্তি নতুন ও সৃজনশীলভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও উন্নয়ন করতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে প্রযুক্তিশিল্প দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে উচিত বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার প্রস্তাবনা করে একটি নতুন প্রোগ্রামার জেনারেশন তৈরি করা। এছাড়া একটি বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার বিকাশে অনেক বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে। একটি নতুন সিনট্যাক্স, ব্যাকরণ এবং ইত্যাদি লাগবে ভাষাটির জন্য। তবে, একটি বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষা অনেক সুফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে। বাংলা ভাষায় প্রোগ্রামিং শেখানো হলে, শিক্ষার্থীরা তাদের জাতীয় ভাষায় কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রধান বিষয় শিখতে পারবে। এটি তাদের এ বিষয়কে সহজে বুঝতে সাহায্য করতে পারবে।
আমরা এখনো ভাষার লিখিত রূপ বা বানান নিয়ে বিভ্রান্ত। ই,ঈ, (হ্রস্ব-ই-কার, দীর্ঘ-ঈ-কার) উ,ঊ, (হ্রস্ব-উ-কার,দীর্ঘ-ঊ-কার), ন,ণ, স,শ,ষ, জ,য ইত্যাদি বর্ণ, কার চিহ্ন নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে বহু মানুষ। অনেকে বানান ভুলের আশঙ্কায় বাংলা লেখে না। অনেকে ইংরেজি হরফে বাংলা ভাষা লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ও বাংলা ভাষাকে গণমানুষের ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলা ভাষার লৈখিক রূপের কিছু পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ যদি বাঙালিদের কাছেই স্বাচ্ছন্দপূর্ণ না হয় তাহলে বিদেশিদের কাছে তা কিভাবে জনপ্রিয়তা পাবে? স,শ,ষ এর যেকোনো একটা, ই,ঈ এর মধ্যে যে কোনো একটা, উ,ঊ এর যে কোনো একটা, ন,ণ, এর যে কোনো একটা, জ,য-এর মধ্যে একটা, ত, ৎ এর মধ্যে একটা হলে কি ক্ষতি?
একটু উদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা নিশ্চিতভাবে বাংলা ভাষাকে আরও সহজভাবে লেখার ব্যবস্থা করতে পারি বৈকি।
ভাষার লিখিত রূপ সহজ সরল করতে পারলে আমরা সহজে বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব এবং সম্ভব হবে, ব্যবসা, বাণিজ্যসহ সকল বিষয়ে যোগাযোগ সহজতর করা।
নিচের দুটো বাক্য লক্ষ্য করা যেতে পারে :
১। আমরা একটি মহান জাতি।
২। আমরা জাতি দিয়ে সুপারি কাটি।
ওপরের বাক্য দুটোতে ‘জাতি’ শব্দটা একই বানানে দুটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। ‘যাতি’ এর স্থলে ‘জাতি’ দৃষ্টিকটু হলেও বুঝতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু।
আজ কথা বললাম সাইমুমের সঙ্গে, সে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্র। তার সাথে আলোচনা করে বেশ কিছু মতামত জানা গেল। যেমন সে জানাল, সে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে লেখাপড়া করছে, এখানে মানুষের প্রয়োজনে এবং সুবিধার্থে প্রোগ্রামিং-এর ভাষাগুলো পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, কেউ একটা ভাষা নিয়ে আটকে নেই, তবে একটা ভাষার উপর ভিত্তি করে নতুন ভাষা নিয়ে আসা হচ্ছে। আমার মনে হয় বাংলা ভাষাকে করায়ত্ব করে ধরে রাখা হয়েছে। মানুষের প্রয়োজনে ভাষা এসেছে এবং যুগে যুগে এর পরিবর্তন হয়েছে এবং হবে। নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার পর আরো একটা বিপ্লব ঘটলো। আমরা আমেরিকান প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তাদের ভাষায়, প্রতিনিয়ত ব্যবহারের ফলে তাদের ভাষার শব্দ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে কেউ আটকাতে পারছে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা সেই জাতি যারা ভাষার জন্যে রক্ত ঝরিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। কোটি বাঙালির জন্যে আমরা কি বাংলায় একটা প্রোগ্রামিং ভাষা নিয়ে আসতে পারি না? আমাদের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা কি এটা করতে পারি না? প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে বাংলা একাডেমির প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি যাতে তারা এমন একটা প্রোগ্রামিং ভাষা নিয়ে আসতে সরকারকে বা সংশ্লিষ্টদের প্রস্তাব পেশ করে! এখন তো লেখালেখি কমে আসছি, এমন প্রোগ্রাম নিয়ে আসেন যাতে ভুল বানান টাইপেই না আসে, আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়!
আমার ব্যক্তিগত মতামত তার কথার সাথে মিলেই গেলো। আমি চাই দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক। বাংলায় এরকম একটা প্রোগ্রামিং ভাষা যদি নিয়ে আসি তাহলে আমরা নিজেরাই কমপক্ষে কিছু একটা করে দেখাবো। কতদিন আর অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবো? আমাদের কি প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে না? প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে হবে না? নাকি শুধু অনুদানের টাকায় নেচে-গেয়ে সভা-সমাবেশ করলেই চলবে? যেন আধুনিক ফকির!
ইউরোপ আমেরিকা কি আমাদের ভাষায় ওদের প্রযুক্তি বের করবে নাকি ওদের নিজেদের ভাষায়? ওরা তো চাইবেই ওদের ভাষা, সংস্কৃতি ছড়িয়ে যাক সারা বিশ্বে। যদিও ওদের প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার রয়েছে তবুও সেটা কি উপযুক্ত বা সেটা কি পুরোপুরি সঠিকভাবে হচ্ছে। আমরা কিছু করতে না পারি অন্তত ওদের সাথেই কাজ করে একটু দায়িত্ব নিয়ে আমাদের ভাষার উন্নয়ন ঘটালেই তো পারি! ধীরে ধীরে হাতের লেখা কমে আসবে, সবই প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে তাই আমার এত কিছু বলা। দয়া করে, বাংলা ভাষাকে বাঁচান।
সামগ্রিকভাবে বাংলাকে প্রযুক্তি জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান দিতে বাংলা একাডেমি বাংলা প্রোগ্রামিং ভাষার বিকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে করে প্রযুক্তি বাংলাদেশ এবং বিশ্বের জন্য অপূর্ব গুরুত্বপ্রাপ্ত হবে।
আমরা যদি উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাষার লিখিত রূপ সংস্কারের জন্য উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করি, বাঙালির প্রাণের ভাষায় বাঙালি পৌঁছে যাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে। মোদের গরব, মোদের আশা, নআ’মরি বাংলা ভাষা।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com