বন্ধু এসেছে বহু বছর পরে
বন্ধু এসেছে বহু বছর পরে - ছবি : সংগ্রহ
বহু বছর পর এসেছি কোপেনহেগেনে। স্টকহোম থেকে সর্বমোট ফ্লাইট সময় ৫৫ মিনিট। তারপরও বাসা থেকে এয়ারপোর্ট পরে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল (ডোর ট্যু ডোর) সব মিলে সময় লেগেছে পাঁচ ঘন্টা। এতটুকু সময় আগেও লাগত। প্রযুক্তির যুগেও জীবনের ঝুঁকি বেড়েছে, জটিলতাও বেড়েছে বেশ। যেমন বিমানে ওঠার আগে যে সকল নিয়ম কানুন যুক্ত করা হয়েছে সেগুলো অতীতের তুলনায় আরো জঘন্য হয়েছে। ভালো এবং আরো উন্নত মানের যানবাহনসহ অন্যান্য জটিলতার সমাধান না থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা, বাণিজ্য বা বিনোদনের সুবাদে আমাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। যদিও আমরা কিছুটা অভ্যস্ত এ যুগে কুইক ফিক্সে। যেমন অতীতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা খবর পাঠাতে সময় লাগত কয়েক দিন বা মাস এখন সেটা মুহূর্তেই সম্ভব হচ্ছে। আবার যানবাহন, রাস্তা-ঘাট, সেতু নির্মাণ, টিকিট কেনাসহ অন্যান্য সুযোগ- সুবিধার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতিও হয়েছে।
এতক্ষণের আলোচনায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ভালো-মন্দের কথা উঠে এসেছে যা আমরা মনে মনে মেনে নিতে না পারলেও- মেনে নিয়েই জীবনযাপন করে চলছি।
মজার ব্যাপার হলো, আমি আমার ভাবনায় এসব সফর কিন্তু অত্যন্ত দ্রুততার সাথেই করতে পারি। এ সফর এত দ্রুত যে সেটা শুধু ভাবনাই করা সম্ভব। তবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী যারা তারা নিশ্চয়ই জানেন হযরত মোহাম্মদ সা. মনের সফরের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে তেমন একটি ভ্রমণ করে পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে গেছেন। এখন তিনি যখন পেরেছেন আমরা কেন পারব না? এ ধরনের প্রশ্ন আমার মনে এসেছে, কারণ আমার মনের কল্পনায় এটা সম্ভব, তাহলে বাস্তবে কেন সম্ভব হবে না? আমার মনে হয়, মনের সফরের মতো দ্রুত সফর আমরা মানুষ জাতি বাস্তবে কোনো দিন রূপ দিতে পারব না। তারপরও আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে এটা বিরাজ করছে। জানি না স্রষ্টা কেন এতবড় একটা শক্তি দিয়েছেন! নিশ্চয়ই সৃষ্টির সব কিছুতে রয়েছে রহস্য, তবে আমার মনে হয় মনের গতি এত দ্রুত থাকার কারণ হয়তবা আমরা যেন সারাক্ষণ এবং সর্বক্ষণ চেষ্টা করি দ্রুততার সাথে সব কিছুর সমাধান করতে।
যাইহোক হুট করে কোপেনহেগেনে এসেছি মূলত বন্ধুর টানে। আমার এলাকার অনেকে বলে- বাংলাদেশে যারা আমার বন্ধু তারা সবাই নাকি আমার ছোট বেলার বাল্যবন্ধু। ঘটনাটি সত্য এ কারণে, আমি সেই কৈশোর পার করেই বিদেশ পাড়ি দিয়েছি। আমার সাথে আমার বন্ধুদের মানবতায় ঘুন ধরেনি, হৃদয়ে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু বাসা বাঁধেনি। আমাদের ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা। আমরা যখন বন্ধু ছিলাম আমাদের একটি পরিচয় ছিল সেটা হলো 'উই আর যাস্ট ফ্রেন্ডস'। বন্ধু ধরা বা ছোঁয়ার বিষয় নয় এটা যেন শুধু অনুভবে হৃদয় চেনে গো হৃদয়ের বন্ধুরে।
এ যুগের নতুন প্রজন্মদের মাঝে এমন বন্ধুর কলরব বা ঢেউ উঠুক আমি সেটাই দেখতে চাই।
আমি আমার বন্ধুদের সাথে কখনো সব বিষয়ে একমত নই, আমাদের শিক্ষাগত, কর্মগত যোগ্যতা ভিন্ন, আমরা অনেক সময় এগ্রি ট্যু ডিজ-এগ্রি তারপরও আমরা একে অপরের বন্ধু। আমরা একে অপরকে ফিল করি।
চল্লিশ বছর পার করেছি ভিন জগতে এবং সেই নতুন পরিবেশে গড়ে উঠেছি তা সত্ত্বেও একে অপরকে দেখে মনে হয়েছে সারা জীবনের চেনা।
এবার আসি ভ্রমণের ওপর কিছু ঘটনা নিয়ে।
নাজমুল গ্লোবাল হেলথ রিলেটেড বিষয় নিয়ে বিশ্বের নানা দেশের দক্ষ এবং যোগ্য গবেষকদের সাথে এবারের কনফারেন্সে যোগ দিয়েছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে (ব্রি. জেনারেল নাজমুল পেশায় সেনাবাহিনীর চিকিৎসক, তারপর সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডিজি)। কথা ছিল কনফারেন্স শেষে সে এবং তার সহধর্মীনি (তিনিও পেশায় ডাক্তার এবং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর) কনফারেন্স শেষে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরবে, আমি এবং আমার সহধর্মীনি হোস্ট ফামিলি হিসেবে তাদের সাথে আমাদের যৌথ সময় কাটাব। শর্ট টাইমের ভিসা এবং কিছু জটিলতা থাকায় এবারের সফর পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী না হবার কারণে আমি শেষে এক দিনের জন্য কোপেনহেগেনে যাই।
কোপেনহেগেনে পৌঁছে তাড়াহুড়ো করে অল্প সময়ে দুই বন্ধু পরিকল্পনা করলাম হেঁটে হেঁটে যতটুকু সম্ভব কোপেনহেগেন ঘুরব, দেখব এবং দেখাব। ছোট ছোট কয়েকটি ভিডিওসহ বেশ কিছু ছবি তুলেছি এবং সেগুলো শেয়ার করেছি।
ডেনমার্কে দিন আর শেষ হতে চায় না, নাজমুলের মুখে কথা একটিই -কখন সন্ধ্যা হবে! রমজান মাস, রোজার মাস, তাও পড়েছে ইংরেজি এপ্রিল মাসে, যখন অন্ধকারের বিদায়ের সময়, এ সময় বরফের অবসান ঘটিয়ে সামারের আগমন হতে শুরু করে।
স্বাভাবিকভাবেই নর্ডিক দেশগুলোর দিন এখন রাতের তুলনায় দীর্ঘ হতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা মাইনাস থেকে প্লাসে যেতে শুরু করেছে। নর্ডিক জাতির গায়ের কাপড় ঝরতে শুরু করেছে। অতীতে বলেছি, আমার লেখা -শীতে ল্যাংটা গাছ আর গরমে ল্যাংটা নারী- সেটা এখন ঘটতেও শুরু করেছে।
আগের দিন কোপেনহেগেনে সেহেরির সময় ছিল রাত ২.৩০ এবং ইফতারের সময় ছিল ৮.৩০। এটা একটা বেশ লম্বা সময় তবে নর্ডিক দেশগুলো অনেকটা লম্বা থাকায় রোজার টাইমটেবিল ভ্যারি করে বেশ, তারপরও এবারের রোজা চমৎকার সময়ে হয়েছে যখন দিন রাত বেশির ভাগ সময় সমপরিমাণ ছিল।
আমরা আমাদের ইফতার এবং ডিনার এক সাথেই শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে অতীতের ভাইকিংদের নৌকাগুলো দেখতে সমুদ্রের পাড়ে এসে হাজির হলাম।কিছুক্ষণ যেতে যেতে পুরো শহর অন্ধকারে ঢলে পড়ল, সেইসাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে শহর আকাশের ওই মিটি মিটি তারার মতো একটু আলো জ্বালিয়ে রেখেছে যাতে বিদ্যুতের অপচয় না হয়।
আমি বিদেশ ভ্রমণে হারিয়ে যেতে পছন্দ করি। কারণ ছুটি হবে সেই মধুময় সময় যখন থাকবে না কোন চাপ শুধু ঘুরব আর দেখব যা কিছু ইচ্ছে মনের আনন্দে করব, মাঝে মধ্যে ভুল পথে যাব এবং দুই বন্ধু মিলে দুজন দুজনকে গালিগালাজ করব এবং বলব -শালা তোর কারণে এহন হারাই গিছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই করতে করতে হঠাৎ হেটেলে এসে হাজির হবো।
পথেই পরিকল্পনা করেছি, দুজনের কেউ ঘুমাবো না সারা রাত গল্প করব। নাজমুল বলল, নামাজ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে পুরোনো কাহিনীর ওপর স্মৃতিচারণ করব। আমি বললাম, ঠিক আছে। নামাজ শেষ করে সে বিছানায় সবে শুয়েছে, হঠাৎ টেলিফোন। তার ছেলে ফোন করেছে নিউইর্য়ক থেকে। ছেলের গলা শুনছি, কিন্তু নাজমুলের হাল্কা পাতলা নাকের শব্দ। অবাক হবার কিছু নেই, দুই বন্ধু সেই দুপুর থেকে হাঁটতে শুরু করেছি তো হাঁটছি রাত ১১টা অবদি। রুমের বাতি না অফ করে কখন ঘুমিয়ে গেছি তার নেই ঠিক।
এদিকে রাতে হোটেলে এসেই আমরা টেলিফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছি, যেন সেহেরি মিস না হয়। নাজমুল এলার্ম বাজার কয়েক মিনিট আগেই ঘুম থেকে উঠে রুমের বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করছে, না পেরে আমাকে বলছে, মৃধা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কি পুরো হোটেলের বাতি বন্ধ করে দিয়েছে? এখন কী হবে? ফোন দিলাম লবিতে, রিসিপসোনিস্ট বলল, অ্যাডাপ্টার নষ্ট হয়েছে, সরি। আমি বললাম, সরি দেখবোনে সকালে, আগে টেকনিশিয়ান এনে আলোর ব্যবস্থা করো, সেহেরি খেতে হবে।
রিসিপসোনিস্ট তাড়াহুড়ো করে টেকনিশিয়ানের খোঁজে লেগে গেল। নাজমুল বলে বসল, এত বাংলাদেশের মতো ঘটনা বন্ধু? একটু তামাশা করে বলল, বিল দেইনি তাই কি কারেন্ট বন্ধ করে দিলো? এদিকে রিসিপসনিস্ট জানাল, আধা ঘন্টার মধ্যে লাইট জ্বলে উঠবে। আমরা দেরি না করে টেলিফোনের লাইট নিয়ে রাতের আনা কলা, রুটি এবং পানি দিয়ে সেহেরি শেষ করতেই কিছুক্ষণ পর দেখি লাইট এসেছে। আবার ঘুমের আগে নতুন করে আলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম, সকাল দশটা ত্রিশে নাজমুলের ফ্লাইট। সাতটায় ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে টাক্সি করে এয়ারপোর্টে হাজির হতে হবে।
ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে টাক্সি করে রওনা হলাম। যেতে যেতে পথে দুজনেই বেশ রিফ্লেক্ট করলাম রেডিসন চার তারকা হোটেল অথচ কিভাবে বাতি ছাড়া দিব্বি চুপচাপ রয়েছে! যাক কোপেনহেগেন এয়ারপোর্ট প্রচণ্ড ট্রাফিক, চলছে কড়াকড়ি সিকিউরিটি কন্ট্রোল। বেশ কিছুক্ষণ পর আমাদের চেকিং পর্ব শেষ করে ব্যাগ এবং টিকিট কনফার্ম করতেই নাজমুলের কাছে কোভিডের সনদপত্র চেয়ে বসল যা এখন কোথাও ডিমান্ড করছে না। অথচ তার্কিশ এয়ার লাইন্সে বাংলাদেশ সরকারের অতীতের রিকয়ারমেন্ট এখনো থাকায় তারা কোভিড সনদপত্র ছাড়া চেকিংয়ের কাজ করবে না বলে জানিয়ে দিলো। নাজমুল ঢাকাতে ফোন করে ওয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে সেটা ম্যানেজ করে কর্তৃপক্ষেকে দিয়ে ঝামেলা শেষ করল এবং আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। মূলত তার্কিশ এয়ারলাইন্স তাদের হোম পেজ আপডেট করেনি, এটাই ছিল সমস্যার কারণ। গোটা বিশ্বে একটি জিনিস লক্ষণীয় সেটা হলো, যার যে কাজ সেটা না করে অন্য কাজ যখন করে তখন এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
বন্ধু নাজমুলের বিদায় পর্বে মনে পড়ে গেল সেই ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা, যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগের সেরা ছাত্ররা এসে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এবং কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক অচেনা, অজানা মুখ চেনা হয়েছিল। কিছু কিছু স্মৃতি অল্প সময়ের মধ্যে বড় দাগ ফেলে জীবনে। আমার ছোট বেলার সময়গুলো বাংলাদেশে বাকি জীবনে সত্যিকারে সুন্দর মধুময় স্মৃতিভরা ভালোবাসা, যা যাবে না ভোলা কোনো দিন।
নাজমুলের সাথে ২০ ঘণ্টার কোপেনহেগেন ভ্রমণ ছিল এক স্মৃতিমাখা সময়। বিদায় বেলা বলেছি দুজনে দুজনাকে- আবার হবে দেখা, হয়ত লন্ডনে নয়তো সুইডেনে।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com