হে মহান তুমি এবারের ঈদে পৃথিবীর সব মানুষের হৃদয়ের দ্বার খুলে দাও
হে মহান তুমি এবারের ঈদে পৃথিবীর সব মানুষের হৃদয়ের দ্বার খুলে দাও -
পবিত্র মাহে রমজান শেষ হয়েছে। এসেছে পবিত্র ঈদ। গোটা বিশ্বের মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য এ এক মহা আনন্দের দিন। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ। রমজান মাস ত্যাগের মাস। ত্যাগ করা এবং দিতে শেখার মাস, আত্মত্যাগের মাস। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহ পাকের নির্দেশে সব ধরণের পানাহার থেকে মুক্ত থাকা। এভাবে এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদ।
প্রতি বছর ঈদের এই আসা যাওয়ার মাঝে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শুনেছি, অনেক কিছু ভেবেছি, অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি। শুধু প্রশ্ন করিনি ‘কেন’? কেন এই ঈদ এবং কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে?
কেন বা কী কারণ এ বিশ্লেষণ যদি সঠিকভাবে না জানা যায় তবে তৃপ্তি বা আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে না বোধ। ভালোবাসার বোধ, ভ্রাতৃত্বের বোধ, ক্ষমার বোধ, ত্যাগের বোধ, বিবেকের বোধ, নৈতিকতার বোধ।
তাই তো প্রশ্ন জেগেছে মনের মাঝে কবে হবে বোধগম্য? আমার প্রচুর আছে কিন্তু তার কিছুই নেই এটা আমার বোধগম্যে এসেছে, কিন্তু আমি কী ভাবছি যার কিছু নেই তার জন্য কিছু করতে? উত্তর হ্যাঁ বা না হতে পারে। কিন্তু বোধগম্যতা যদি সেই ‘কী ভাবছি’ অনুভূতির মূল্যায়ন না দিতে পারে তখন হ্যাঁ বা না উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বিশ্ব সমাজে যারা প্রভূত অর্থ সম্পদের মালিক তাদের অনেকেই স্ব-অর্থায়নে সমাজসেবামূলক কাজ করে। কিন্তু যাদের সম্পদ কম তারা এলাকায় কোনো মসজিদ, মন্দির, ক্লাব, বা পাঠাগার গড়ার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে।
এ ধরনের সমাজসেবা হলো নিজের খেয়ে সমাজের জন্য কাজ করা। এদের প্রাপ্তি বলতে মানুষের জন্য কাজ করার আনন্দ বৈ আর কিছু না। এসব কাজ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনে সবসময় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রমজান মাসে আমরা অনেকেই এ ধরনের কাজ করে থাকি জাকাতের একটি অংশ হিসাবে।
থাকি শীতের দেশে, বছরের প্রায় নয় মাসই ঠাণ্ডা। শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাইরের তাপমাত্রা কখনো মাইনাস ৫০ ডিগ্রি কখনো প্লাস ৩০ ডিগ্রি। শ্বাস প্রশ্বাসের কারণে আমার শরীর প্রতিক্ষণ যে পরিমাণ শক্তি ব্যয় করছে সেটা নিয়ে ভাবছি। এও ভাবছি কী চমৎকারভাবে শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সক্রিয়ভাবে কাজ করে শরীরের তাপমাত্রা সারাক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। একই সময় রক্ত পা থেকে মাথা অবধি চলাচল করছে এবং অক্সিজেন থেকে শুরু করে যেখানে যা দরকার সেটা সময় মত পৌঁছে দিচ্ছে।
শরীরের স্নায়ুতন্ত্র সময় মত যখন যে বার্তা যেখানে দরকার পাঠিয়ে চলছে। ভাবনা তার গতিতে কাজ করে চলছে। পাকস্থলী খাবারকে হজম করা থেকে শুরু করে যথাযথভাবে তার দায়িত্বে অটুট। চোখ, কান, নাক, ব্রেন শতভাগ দায়িত্ব পালনে অটুট। আমি স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ, আমি পৃথিবীর শুধু শ্রেষ্ঠ জীব নই আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোম্পানি।
কীভাবে বুঝব আমার কোম্পানি শ্রেষ্ঠ? যখন সবকিছু চমৎকারভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যখন আমি ফিলিং গুড তখন মনে হচ্ছে আমার কোম্পানি শ্রেষ্ঠ। কিন্তু যখন ফিলিং ব্যাড তখন সাহায্যের জন্য ছুটি। এমনও সময় মাঝে মধ্যে দেখা দেয় যখন কোন উপায় থাকে না সমাধানের, তখন কি করি? স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি। সে প্রার্থনা হতে পারে এক বা একাধিক। তবে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তার রহমতের প্রশংসা করি কখন জানেন?
নানা জনের নানা উত্তর হতে পারে। তবে প্রতিদিন পাঁচ বার নামাজে প্রতিটি রাকাতে যে সুরাটি পাঠ করি সেটা হচ্ছে সুরা ফাতিহা। মূলত সুরা ফাতিহা সেই সত্যিকার মোনাজাত যেখানে রয়েছে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং তার রহমতের প্রশংসার চাবিকাঠি।
স্রষ্টা সুরা ফাতিহার মাধ্যমে জানিয়েছেন কিভাবে মোনাজাত করতে হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনেও রোজা চলছে। সুইডেন মূলত একটি লম্বা দেশ,
প্রচণ্ড শীত এখানে এবং শীতে দিন ছোট রাত বড় হয়ে থাকে। এবছর রোজা পড়েছে চমৎকার একটি সময়ে, সূর্য অস্ত এবং উদয়ের টাইম টেবিলটিা বেশ সমান সমান যার ফলে এ বছর রোজা রাখা জটিল বলে মনে হচ্ছে না। তবে জটিল মনে হচ্ছে যখন দেখছি, সারা বিশ্বে রমজান মাসে খাবারে পিছে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে! খাবার এমন একটি জিনিস যা সবারই প্রয়োজন। চাহিদানুযায়ী খাবার না পাওয়া গেলে খাবারে সঙ্কট দেখা দেয়। সঙ্কটের কারণে দামও চড়া হতে থাকে।
যাদের টাকা আছে তারা চড়া দামে সেটা কেনে। পরে এমন একটি সময় আসে তখন অর্থ থাকলেও খাবার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে আর তখনই শুরু হয় ক্রাইসিস; পরিবার, সমাজ, দেশ এবং গোটা বিশ্বে কিন্তু রমজান মাসে খাবারে ক্রাইসিস বুঝতে পারছি না! আমরা প্রকৃতপক্ষে রোজা পালন করার যে তাৎপর্য সেটা কি সঠিকভাবে মেনে চলছি? ভাবছি!
সুইডিশদের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে তা সত্ত্বেও কেন যেন মনে হয় সমাজব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মের অনেক রীতিনীতির সাথে বেশ মিল খুঁজে পাই। যেমন এরা বেতনের এক তৃতীয়াংশ ট্যাক্স দেয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ইদানীং সুইডেনেও ইউরোপের অনেক দেশের মতো মসজিদ তৈরি এবং কমিটি নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে।
ইসলাম ধর্মকে সুইডেন এবং ইউরোপে আগের তুলনায় উদারভাবে দেখা হচ্ছে। যদিও মাঝে মধ্যে নানা সমস্যা দেখা যায়। ইউরোপ খ্রিস্টানপ্রধান হলেও এখানে মুসলমানের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
আমার মনে হয় এজন্যই রমজান মাসের আবির্ভাব হয়েছে। আল্লাহ পাকের হুকুম পালন করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার জন্য রমজান মাসে রোজা থাকার তাৎপর্যের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এখন সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার বোধ যদি হৃদয়ে না আসে তবে সে জীবনে সুখ আসবে বলে মনে হয় কি? আমি জানি না, আছে কি কেউ যে জানে? বড় সাধ জাগে একবার তাকে দেখার।
এতক্ষণ অনেক কথাই জানালাম এখন বলি আমার অনুভূতি ‘ঈদ তখন’। প্রথমেই মনে পড়ে গেল সেই ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ কথাটি।
ছোটবেলায় আমার কাছে ঈদের আগের রাতেই ঈদ মনে হতো। সে যে কী আনন্দ যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ঈদের আগের দিন রাতে শত চেষ্টা করে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কেন জানি ঘুমের ক্নান্তি শরীরে স্পর্শ করেনি। বিছানায় এদিক সেদিক গড়াগড়ি করতে করতে হঠাৎ সকাল হয়েছে। ঈদের খুশিতে সবকিছু উলোট-পালোট হয়ে যেত। তবুও সব কিছুতে দ্বিগুণ আনন্দের অনুভূতি ঈদকে ঘিরে। রমজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদ নিয়ে যত সব করণীয় পরিকল্পনা বেড়ে যেত। বিশেষ করে বাসাবাড়ির চাকচিক্য করা এবং নতুন পোশাক সবার জন্য যার ছিল ব্যাপক চাহিদা।
মনে পড়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি ঈদের নামাজের পূর্বে মিষ্টিমুখ অর্থাৎ সেমাই খেয়ে নামাজে যাওয়া যেন একটা সামাজিক রেওয়াজ। না খেলেও জোরপূর্বক খাওয়াতেন মা। এরপর নতুন পোশাক পরে সালামি নিতে অপেক্ষায় থাকতাম। বাবা মা আত্মীয় পরিবার পরিজন বড় সবাইকে সম্মান করলে টাকা হাতে তুলে দিতেন। সেই টাকা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম বন্ধুদের নিয়ে।
পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াতাম। সবার বাসায় গিয়ে ক্ষীর, সেমাই খেতে খেতে একটা সময় আর খাওয়ার কোনো রুচি থাকত না। সব মিলে ছেলে বেলার ঈদ ছিল পরিপূর্ণ বিনোদনে ভরা। যা এখন শুধু স্মৃতি, তবুও মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে। সেই আগের মতো আনন্দ এখন আর হবে না, হবে কী করে বাবা-মা নেই, কোথাও কেউ নেই সেই ছোটবেলার মতো। তিন যুগেরও বেশি প্রবাসে ঈদ করছি। বিদেশে অর্থের পিছুটান না থাকলেও আনন্দ উল্লাসের অনেক ঘাটতি রয়েছে যা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।
দেশের টানে, নাড়ির টানে মন ছুটে চলে সব সময় দেশের পানে। বিশেষ করে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে দেশকে অনেক বেশি মনে পড়ে। কারণ সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে বোধগম্য হয় ঈদ হচ্ছে। তবু সব কিছু মেনেই চলতে হয়। দুঃখ আর বেদনার আরেক নাম প্রবাসীদের ঈদ উদযাপন।
পবিত্র ঈদের খুশি ধনী, গরিব সবার জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।
এবারের ঈদে আমাদের মধ্যে কি বোধগম্য আসতে পারে না? যে বোধগম্য দিতে পারে সমাধান, জীবনের সমাধান! যার প্রচুর আছে এবং যার কিছু নেই এরা কি পারে না বন্ধু হতে? যার কিছু নেই এবং যার সব আছে এদের মধ্যে কি মিলন ঘটানো সম্ভব?
ঈদ আমাদের জীবনের শূন্যতাকে পূর্ণ করুক। এবারের ঈদ উদযাপন বয়ে আনুক দেয়া নেয়ার অঙ্গীকার। ঈদ পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের হৃদয়ের মানবতার দ্বার খুলে দিক তেমনটি কামনা করছি।
কেন বা কী কারণ এ বিশ্লেষণ যদি সঠিক ভাবে না জানা যায় তবে তৃপ্তি বা আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে না বোধ- ভালোবাসার বোধ, ভাতৃত্ববোধ, ক্ষমাবোধ, ত্যাগের বোধ, বিবেকের বোধ।
এতোটা বছর পার হয়ে গেল অথচ তারে (বোধ) আমি চিনতে পারিনি আজও। আলো বা অন্ধকারে মাথার ভেতরে হাজার বার যে জিনিসটি কাজ করে সে স্বপ্ন নয়, শান্তি নয় এমনকি ভালোবাসাও নয়। হৃদয়ের মাঝে জন্ম নিয়েছে বোধ তারে এড়াতে পারা বড্ড কঠিন।
তাই তো প্রশ্ন জেগেছে মনের মাঝে কবে হবে বোধগম্য? আমার প্রচুর আছে কিন্তু তার কিছুই নেই এটা আমার বোধগম্যে এসেছে, কিন্তু আমি কী ভাবছি যার কিছু নেই তার জন্য কিছু করতে? উত্তর হ্যাঁ বা না হতে পারে। কিন্তু বোধগম্যে যদি সেই 'কী ভাবছি' অনুভুতির মূল্যায়ন না দিতে পারে তখন হ্যাঁ বা না উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন!
মনে হচ্ছে বার বার সুরা ফাতিয়াকে অনুসরণ এবং অনুকরণ করি।
পরম করুণাময় অতীব দয়ালু আল্লাহর নামে।
সমস্ত প্রশংসা জগত সমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে।-
অনন্ত দয়াময়, অতীব দয়ালু।
প্রতিফল দিবসের মালিক।
আমরা শুধু আপনারই দাসত্ব করি এবং শুধু আপনারই নিকট সাহায্য কামনা করি।
আমাদের সরল পথনির্দেশ দান করুন।
তাদের পথে, যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন।
এবং তাদের পথে নয় যারা আপনার ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট ।
এবারের ঈদে আমাদের মধ্যে কি সুরা ফাতিয়াকে অনুসরণ এবং অনুকরণ করার বোধগম্য আসতে পারে না? যে বোধগম্য দিতে পারে সমাধান- জীবনের সমাধান! যার প্রচুর আছে এবং যার কিছু নেই এরা কি পারে না বন্ধু হতে? যার কিছু নেই এবং যার সব আছে এদের মধ্যে কি মিলন ঘটানো সম্ভব?
ঈদ আমাদের জীবনের শূন্যতাকে পূর্ণ করুক। এবারের ঈদ উদযাপন বয়ে আনুক দেয়া নেয়ার অঙ্গীকার। ঈদ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের হৃদয়ের মানবতার দ্বার খুলে দিক তেমনটি আশা কামনা করছি।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন