আবার আটলান্টিকের তীরে
আবার আটলান্টিকের তীরে - ছবি : সংগ্রহ
আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল, তারপর বাড়ি থেকে পালানোর অভ্যাসও সেই ছোটবেলা থেকেই। এক জায়গা একটানা বসবাস করতে ভালো লাগেনা তাই হুট করে উড়াল দেই যখন যেখানে যেতে মন চায়। 'I have climbed highest mountains
I have run through the fields
Only to be with you
But I still haven't found what I'm looking for!'
বউও পাইছি মাশাআল্লাহ, তিনিও একই রকম। যার ফলে দ্বন্দ্ব-ফন্দ নেই, যা খুশি ইচ্ছে দুজনে তা মিলে মিশে করি। গত সপ্তাহে হঠাৎ সুইডেন ছেড়ে সোজা আফ্রিকা মহাদেশে, তাও আটল্যান্টিক মহাসাগরের মাঝখানের এক দ্বীপে এসে উঠেছি। ওই যে বললাম না, এটা ছোটবেলার অভ্যাস। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে মাঝে মাঝে হুট করে ঘর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে আসি! তবে সবার পক্ষে সবকিছু হয়ে ওঠে না। তাছাড়া অর্থনৈতিক ব্যাপার আছে, তারপর অর্থ থাকলেই কি সবকিছু সবাই করতে পারে? না, পারে না বা করে না। একেকজনের একেক চিন্তাভাবনারও ব্যাপার রয়েছে, যেমন সু্যোগ আর সময়ের অপেক্ষায় থাকলে অনেক সময় দেখা যায় তা সহজে মেলে না, বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও দেখা যায় অনেক কিছু করা হয়না! একটা সময় দেখবেন নিজের ঘরবাড়ি, পাশের বা কাজের মানুষগুলোকেও বিরক্তিকর লাগবে। তখন সেখান থেকে নিজেকে ছুটি দিতে হয়। এমন সময় যদি জীবনে আসে, খুব বেশি ব্যস্ততা আর চাপের মাঝে অস্থির হয়ে মন খারাপ করে বসে না থেকে সোজা বেরিয়ে পড়ুন দেখবেন ভালো লাগবে।
কোনো শহর, দেশ বা জাতিকে জানতে আর তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-জীবনযাত্রা-রুচিবোধ সেখানকার মিউজিয়াম, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, গার্ডেন, পাহাড়, সমুদ্র, ঝর্ণা সহ প্রাকৃতিক স্থানগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে। অতএব সময় সুযোগ আর সঙ্গিনী সাথে থাকলে তো কথা নেই, মন মতো ঘুরতে পারা কোনো ব্যাপারই না। তবুও বলি, এখন থেকে সব ছেড়ে ছুঁড়ে মাঝে মাঝে পালিয়ে যান, দুনিয়াটা আর দেখবেন কবে? কত সু্ন্দর এবং কত কিছুইতো দেখার আর জানার আছে, একটু তো দেখে যেতে ইচ্ছে হবার কথা!
প্রকৃতির সাথে না মিশলে প্রাকৃতিক হওয়া সম্ভব নয়, তার প্রমাণ দেখবেন আর্ট মিউজিয়ামে গেলে। সবকিছু ল্যাংটা কারণ এটাই প্রাকৃতিক। তখনকার আর্টতো এমনই ছিল, সমস্যা নেই, তখন তো আর আমাদের মতো হাতে হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না, তাই অনেক কষ্ট করে মাসের পর মাস বছরের পর বছর সময় দিয়ে ছবি এঁকে সেগুলো পাথরে, মেটালে খোদাই করে স্মৃতি বা কল্পনাগুলোকে ধরে রাখতো, যা আমরা এ যুগে মনের আনন্দে দেখছি।
তবে এসব আর্ট দেখে আমার শুধু মনে হয় যে তখনকার ছবিগুলোতে শিশু-নারী-পুরুষ-পশু সবার শরীর দেখতে এত তরতাজা কেন? আর কারো মুখে হাসি নেই কেন? সব অন্যমনস্ক, উদাসীন, নরম দৃষ্টির, বিমর্ষ কেমন যেন অসুখী চেহারায় রাজা-রানিরাও। কী কারণ বিষয়টি জানতে হবে!
তার আগে যেখানে এসেছি তার ওপর কিছু বলি। আটল্যান্টিক মহাসাগরের মধ্যে কয়েকটি আইল্যান্ড, যা স্পেনে ক্যানেরি আইল্যান্ড বলে পরিচিত। আফ্রিকান কন্টিনেন্টের মধ্যে পড়া সত্ত্বেও আইল্যান্ডগুলো স্পেনের অধীনে। অতীতে ব্রিটিশদের মতো ফ্রান্স এবং স্পেনও বিশ্বের অনেক দেশ দখল করে। গড়ে তোলে তাদের কলোনি। সেভাবেই আইল্যান্ডগুলোর মালিক এখনো স্পেন। মূলত মোট সাতটি বড় আইল্যান্ডের সমন্বয়ে এই ক্যানেরি আইল্যান্ড গঠিত। অন্যান্য আইল্যান্ডের মধ্যে রয়েছে গ্রান ক্যানেরি, লানসারটে, লা পালমা, লা গোমেরা, ফিউরেতেভেন্টুরা ও এল হিয়েরো। এছাড়াও আরো ছোট ছোট ছয়টি আইল্যান্ড রয়েছে এখানে। আমি এসেছি বেড়াতে টেনেরিফ আইল্যান্ডে। এই আইল্যান্ডের রাজধানীর নাম সান্টাক্রুস টেনেরিফা। ল্যান্ড করেছি দুপুরে -প্লাইয়া ডে লাস আমেরিকাসে। প্লেন থেকে নেমেই সরাসরি ট্যাক্সি নিয়ে উঠেছি সমুদ্রের তীরে পোয়ের্টো ডে লা ক্রুসের একটি হোটেলে। বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছি সকাল তিনটেয়, বেশ ঘুম চেপে বসেছে দুই চোখে। সাগরে পাড়ে বালুর উপর একটু ঘুমিয়ে নিয়েছি পরে ঘুম থেকে উঠেই দ্বীপের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ, বিমোহিত। আহ্ কী অপরূপ সৌন্দর্য!
আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত স্পেনের দক্ষিণ টেনেরিফ। স্রষ্টার সৃষ্টি কত বৈচিত্র্যময় তা সরাসরি না দেখলে বোঝা যাবে না। সাগরের নীল পানি। তার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে জনবসতি, নানা ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। টেনেরিফের দক্ষিণে উপকূল রেখার বেশিরভাগ অংশ বালুকাময়। দ্বীপের সৈকতগুলো কে কতটা সুন্দর, তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সুন্দর মনোরম আবহাওয়া এবং সারাবছর রোদ-জলের উষ্ণতা ছুটি কাটানোর এটি এক চমৎকার জায়গা।
টেনেরিফ দ্বীপটি আয়োতনে প্রায় ৭৯০ বর্গমাইল মতো, স্প্যানিশসহ অনেকের মতে আরামপ্রকাশের দ্বীপ নামে অভিহিত। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের মধ্যমণি টেনেরিফের আকৃতি-প্রকৃতি সবই আগ্নেয়গিরির দাক্ষিণ্যে। পাহাড়ি এই দ্বীপে যেসব ফলমূল পাওয়া যায় তার মধ্যে কলা, কমলা, টমেটো, আঙুর, খেজুর, তালজাতীয় গাছ আর ক্যাকটাস উল্লেখযোগ্য। সারা বছরে বৃষ্টি প্রায় হয়না বললেই চলে, মাটির পরিমাণ খুবই সামান্য হলেও উর্বরতার কারণে এখানে প্রচুর ফল, সবজি চাষ হয়। ফুলের কথা বলতে গেলে ফুরোবেনা। বাংলাদেশের বাইরে এই প্রথম কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, পলাশ, কলকে, সন্ধ্যামণি, করবী ফুল দেখলাম। তাছাড়া নানা রঙের নাম না জানা আধিপত্য সারা দ্বীপজুড়ে রয়েছে।
টেনেরিফের যে ছোট্ট শহরটিতে এসে উঠেছি তার নাম পোয়ের্টো ডে লা ক্রুস এবং এখান থেকে টেইডি ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বার বেশ কাছে। টেইডি ন্যাশনাল পার্ক জিওলজির এক বিশাল পরীক্ষাগার। টেনেরিফ দ্বীপের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৯ কিলোমিটার চওড়া ক্যালডেরা (বিশাল আকৃতির আগ্নিয়গিরির জ্বালামুখকে ক্যালডেরা বলা হয়)। আমার হোটেল থেকে খুব কাছে টেইডি ন্যাশানাল পার্ক। কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়েছি এই পার্কে।বাংলাদেশের কাঁঠাল গাছসহ আম, জাম, বটগাছ তারপর শাপলা ফুলসহ কত কিছু দেখলাম সাথে ছবিও তুলেছি অনেক। কোকিলের ডাক শোনা ও দেখা মিলেছে এই পার্কে।
একদিন বাসে করে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। শুরু হলো জার্নি, লাস ক্যানাডাস (Las Canadas) ক্যালডেরার এক দেওয়াল ২ কিলোমিটার মতো চওড়া। ক্যালডেরার দেওয়াল ভেদ করে বাস যখন ঢুকলো তখন নিজেকে স্থির রাখা খুবই কঠিন ছিল। ভাবা যায় কয়েক লক্ষ বছর ধরে স্তরে স্তরে লাভা জমে যে বিশাল জ্বালামুখ তৈরি করেছে তাকে আমরা স্পর্শ করতে পারছি! প্রখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ ভন হামবোল্ট থেকে শুরু করে বর্তমানের গবেষকদের কাছে এ এক তীর্থক্ষেত্র। অগ্নি উৎপাতের ফলে সৃষ্টি সব রকম ভূমিরূপের সমাবেশ এখানে এবং তার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে টেইডি যা নিজে একাই একটা আগ্নেয়গিরি। উচ্চতার দিক থেকে স্পেনের উচ্চতম শৃঙ্গ, সমুদ্র তলদেশ থেকে উচ্চতার বিচারে টেইডি পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম আগ্নেয়গিরিও বটে। উচ্চতার কারণে এখানেও বরফ জমা হয়। শুধু ভৌগোলিক নয় পদার্থবিদদের কাছেও টেইডি আকর্ষণীয় অঞ্চল।
টেনেরিফ দ্বীপে টেইডি ছাড়াও আরো বহু আগ্নেয়গিরি রয়েছে। লাভার নদী আটলান্টিকের জলে ঠান্ডা হয়ে ন্যাচারাল পুল তৈরি করেছে এখনকার পর্যটকদের জন্যে। নেমে গেলাম সেখানে গোসল করতে। কী আছে জীবনে, হলো মনে থাকার মতো গোসল। টেনেরিফে এসে গোসল না করে গেলে কি হয়?
একদিন গেলাম বেড়াতে এখানের মাসকা নামে একটি গ্রামে, গ্রামটি এ দ্বীপের সবচেয়ে একটি সুন্দর গ্রাম এবং গ্রামের লোকসংখ্যা ১০০ জনের কম। উত্তরপশ্চিমের আগ্নেয়গিরি টেনোর টপ থেকে এই গ্রামের দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর। এই টেনো পাহাড়ের ঢালে মাসকা গ্রামের অবস্থান। একের পর এক গিরিখাতের গা ঘেঁসে চলতে পথে রাস্তায় সৌন্দর্য দেখার ইচ্ছে ধরে রাখা খুবই মুশকিল। মাসকা গ্রামে এসে দম ছেড়ে বুঝলাম কতক্ষণ ভয়ে দমবন্ধ করে ছিলাম। বিকেলের পড়ন্ত রোদে মাসকা গ্রামে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাস ছাড়ায় সময় গাইড যখন বলেছিল সিট আঁকড়ে ধরে বসতে তখনো বুঝিনি, পরে টের পাই সেই ভয়ংকর মুহূর্ত যা দুঃস্বপ্নকে হার মানিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমি বেশিরভাগ সময় চোখ বুঁজে ছিলাম। ঘোর ভাঙলো যখন ড্রাইভারকে সবাই করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালো চরম বিপদজ্জনক রাস্তা অতিক্রমের জন্যে। টেনো জাতীয় পার্কের এই রুদ্ধশ্বাস রাস্তা চরম দক্ষ ড্রাইভার ছাড়া পার হওয়া অসম্ভব। এই অভিজ্ঞতার পর জীবনের কোন পথই কঠিন লাগার কথা নয়। তারপরও জীবন চলার পথ কঠিন হবে এ বিশ্বাস আমি করি।
যাইহোক অতীতে ছেলে-মেয়েসহ ভ্রমণ করেছি, এখন থেকে আমি আর আমার সহধর্মিণী, এ এক নতুন জীবন। ছেলে-মেয়ে তাদের মতো করে ম্যানেজ করতে শুরু করছে, আমরাও একে অপরকে সময় দিতে চেষ্টা করছি। হোটেলের পরিবেশটা কিছুটা ভিন্ন। অনেক জায়গা নিয়ে কী সুন্দর পরিবেশ। খাবারের মেনু প্রতিদিনই ভিন্ন। কিচেনের স্টাফদের সাথে প্রথম দিনই সুন্দর বন্ধুত্ব হয়েছে। আমি যা খেতে পছন্দ করছি সেটাই তারা রান্না করে দিচ্ছে। অনেকেই আমি যা খাচ্ছি সেটা খেতে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছে। এদিকে মাত্র এক সপ্তাহের ছুটি কত কিছু করতে এবং দেখতে হবে, সকাল থেকে সন্ধ্যা ব্যস্ততার মাঝে চলছে আমাদের দিনগুলি। অতীতের ভ্রমণ আর এবারের ভ্রমণ বেশ ভিন্ন কারণ এখন যেমন ন্যাচারকে উপভোগ করছি ঠিক তেমন করে সেটা হয়ে উঠেনি। বয়স হয়েছে, এখন কী আর সেই তখনকার মতো? এখন যেভাবে টেনেরিফকে উপভোগ করছি অতীতে সেভাবে করিনি। বিশ্বাস না হয় ঘুরে আসুন যেখানে অতীতে গেছেন দেখবেন পরিবর্তন।
যাহোক ঘুরাঘুরির ফাঁকে কথা বললাম কিছু আফ্রিকান নতুন প্রজন্মের সাথে, কিভাবে তারা আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। যতটুকু মনে হলো কোনো ভাবনা নেই, ভাবনা একটাই কিভাবে আমাকে পটাবে এবং কিছু বিক্রি করবে। আজ যদি আফ্রিকানদের একতা থাকত তবে তারা পুরো ক্যানেরি অ্যাইলান্ডগুলো কিভাবে তাদের হবে সেটা নিয়ে ভাবতে পারত! দরিদ্র জাতির স্বপ্নগুলোও সময়ের সাথে দরিদ্র হয়ে যায় মনে হলো, তারপর বিশ্বেনেতা এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাব তা নাহলে যেভাবে বিশ্ব চলার কথা সেভাবেই চলত। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাচ্ছে। যাইহোক বাংলাদেশের সাথে কিছু কিছু ফল এবং ফুলের বেশ মিল পেলাম এখানে, যার ফলে ভ্রমণে বেশ আনন্দ উপভোগ করছি। আমি আবার ফিরব নতুন কোনো জগৎ নিয়ে ততদিন ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন যেখানেই থাকুন।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com