বিরহের চিঠি সে লিখে পাঠাল
বিরহের চিঠি সে লিখে পাঠাল - ছবি : সংগ্রহ
খাবারের অভাবে অনেককে কষ্ট পেতে দেখেছি, খেতে না পারার কারণে কাউকে মরতে দেখিনি। তবে সঙ্গিনীর অভাবে অনেককে জীবন যন্ত্রণায় বিছানধরা হতে দেখেছি। শুনেছি ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়, তবে নিজ চোখে ভালোবাসা জানালা দিয়ে আসতে দেখেছি, সেটা ছিল মনের জানালা।
পল নিলছন নামটি পরিচিত নয়। কারণ এ নামটি বাংলাদেশী নয় এটা একটি সুইডিশ নাম। পল সুদর্শন চেহারাধারী সুইডিশ ছাত্র। সে আমার সমবয়সী, আমরা তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং থাকিও একই ডর্মিটরিতে। আমার সাবজেক্ট তখন কম্পিউটার এবং তার রসায়ন। আমাদের প্রথম দেখা ডর্মিটরিতে।
আমি পল নিলছন, সাউথ অফ সুইডেন থেকে এসেছি।
তুমি?
আমি রহমান মৃধা, সুদুর বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
বল বললো, তা ইংলিশ কান্ট্রি ছেড়ে সরাসরি সুইডেনে?
আমি বললাম, মানে?
পল বলল, না, মানে সুইডিশ ভাষা তারপর ঠাণ্ডা দেশ, কারণটা কী জানতে পারি?
আমি ভাবছি, সুইডিশ জাতি শুনেছি কিউরিয়াস কিন্তু সরাসরি এভাবে প্রশ্ন করতে পারে তাতো কখনো শুনিনি! যাই হোক প্রথম পরিচয়, এ কথা সে কথা শেষে বিদায় নিয়ে নিজ রুমে চলে এলাম।
আমার ডর্মিটরিতে আরো ছয়জন ছেলেমেয়ে থাকে তবে পল কিছুটা ভিন্ন। সময় পেলেই আমার সঙ্গে মিশতে চায়। তার ক্লাসে ছেলের থেকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। সে ফ্রি সময়ে মেয়েলি কাহিনী নিয়ে আলোচনা করতেই বেশি পছন্দ করে।
আমাদের সাবজেক্ট ভিন্ন, ক্লাস আলাদা, বন্ধু-বান্ধবীও আলাদা। তবে একই ডর্মিটরিতে থাকি সেক্ষেত্রে আমরা দুইজনে অবসর সময়ে এক সঙ্গে আড্ডা দিতে শুরু করি। সুইডেনে তখন বিজ্ঞান বিভাগের সাবজেক্টগুলোর মধ্যে যারা রসায়ন পড়তো তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল বেশি। পলের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা নব্বই শতাংশ আর আমার কম্পিউটার ক্লাসে একেতো বেশির ভাগ বিদেশি এবং তার প্রায় নব্বই শতাংশই ছেলে। মেজাজ যেতো খারাপ হয়ে, দেশে থাকতে শুধু ছেলেদের সাথে পড়েছি। প্রাইমারি, হাইস্কুলে মেয়ে বন্ধু ছিল বটে তবে খোলামেলাভাবে না, মেয়েরা শিক্ষকদের সাথে ক্লাসে আসতো, ক্লাস শেষে শিক্ষকের সাথে চলে যেতো। পরে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যন্ড কলেজে ভর্তি হলাম। ওমা, মেয়ের কোনো বালাই নেই! এমনকি শিক্ষকরাও সব পুরুষ। লেখাপড়ায় ঠিকমতো মনই বসে না! পরে একজন মহিলা শিক্ষক এসেছিলেন, তিনি বাংলা পড়াতেন। সে আরেক কাহিনী, অন্য কোনো এক সময় লিখবো সে বিষয়ে হয়তো। তবে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক না কেন বাংলা দুই সাবজেক্টের রেজাল্ট কিন্তু ভালো ছিল।
যাই হোক ভাগ্য সুইডেনে আসার পরও একই থেকে গেল। কী আর করা বিদেশে পড়তে এসেছি লেখাপড়া গোল্লায় গেলে তো মান-ইজ্জত যাবে। ছোট বেলা থেকে জেনেছি সবাই বিদেশে আসে উচ্চ শিক্ষার্থে তাও দেশের সব লেখাপড়া শেষ করে। আমি এসেছি এইসএসসি পাশ করে। বিশাল চ্যালেঞ্জ, ঠিকমতো লেখাপড়া না হলে তো খবর হয়ে যাবে।
১৯৮৫ সালের কথা বলছি। আজ যেমন দেশের মানুষ বিদেশে আসে চাকরি করতে আমার সময় বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বিদেশে আসত শুধু উচ্চশিক্ষার্থে আর কিছু আসত তাদের নাকি দেশে থাকলে জীবননাশের আশঙ্কা তাই। যাইহোক লেখার মূল বিষয়ে ফিরে যাই এখন।
আমি পলের ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। বলেছি আগেই সমবয়সী তারপর একই ডর্মিটরিতে থাকি। উইকেন্ডে পার্টি হলে আমি ওর বন্ধু বান্ধবীদের সাথেই বেশি মিশতাম, নিজ ক্লাসের বন্ধুদের সাথে না মেশার পেছনে দুটো কারণ ছিল, প্রথমত, সবাই বলতে গেলে ছেলে এবং দ্বিতীয়ত, দেখা হলে ইংরেজিতে কথা। থাকি এখন সুইডেনে, পড়ি সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, এমনিতেই যথেষ্ট ইংরেজি রয়েছে, তারপর টোফেল পাশ করে এসেছি দেশ থেকে। মোটামুটি ম্যানেজবল, কিন্তু সুইডিশ তো ম্যানেজবল হলে চলবে না? তো পলের গ্রুপেই সুযোগ সুবিধা বেশি তারপর মজা আছে বান্ধবীদের সাথে মিশে। তখন আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা 'লজ্জা'। আমার লজ্জা লাগে কথা বলতে। মেয়েদের সাথে কখনো তো কথাই বলিনি দেশে থাকতে। গোপনে গোপনে একটু আধটু চিঠি লিখেছি তাতেই খবর হয়ে গেছে। এখন নতুন জীবন, কী করি! বড়ই বিপদ।
এদিকে পল সুইডিশ সে শালার লজ্জা আমার থেকে আরো বেশি, ল্যাও ঠ্যালা। হাতে হারিকেন সেখানে বাঁশ। পল এদিকে ক্লাসের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে বাঙালিদের মতো। আমি বললাম পল তোর অবস্থা তো বাংলাদেশিদের মতো হবে শেষে, শালা তুই তো দেবদাস হবি পরে। ও বললো দেবদাস কী? আমি মনে মনে বল্লাম ধরা তো ভালো মতো খাইছি, সুইডিশ ভাষার যে অবস্থা সবে মাস খানেক হইছে এসেছি, কিভাবে এখন দেবদাস কী তা বুঝাবো? পরে বল্লাম ওই ধর রোমিও এবং জুলিয়েটের প্রেম। শালা তৎক্ষণাৎ বলে যে তাদের তো পারিবারিক সমস্যা ছিল, আমাদের তো সে সমস্যা না।
আমি বল্লাম, তোর আবার কী সমস্যা। পল বললো যে আমার লজ্জা লাগে, আমি তো তারে বলতেই পারছিনে যে আমিও তাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি। কী বিপদ, নিজেই যে রোগে ভুগছি, কিভাবে বন্ধু পলকে সাহায্য করবো? বন্ধু মানুষ কিছু একটা না করলেও তো হবে না। বল্লাম বন্ধু শোন, লজ্জা হচ্ছে নারীদের জন্য আমাদের লজ্জা মানায় না। পল তখন বলল, তাহলে তুই কেন লাজুক? আমি বললাম, আমি লাজুক তোকে কে বলল?
পল বলল, আমার ক্লাসের একটি মেয়ে বলেছে। আমি এবার শুধু বিপদ নয় মহাবিপদে পড়লাম, মুহূর্তে মনের মধ্যে ঘণ্টার কাঁটা বাজতে শুরু করলো, কে সেই সুন্দর কে?
সেদিন শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে পড়ছি। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন একটু চিমটি দিয়ে বললো রহমান কী করো? চেয়ে দেখি সুফিয়া।
বল্লাম, একটু সুইডিশ পড়ছি। সুফিয়া বলল, তা কেমন চলছে? বল্লাম, কী মনে হয়? মোটামুটি বলেই সুফিয়া জিজ্ঞেস করলো, What is the secret of love?
আমি আন্দাজে জোক করে বল্লাম, Close your eyes and just love, এটাই সিক্রেট।
কথাটি শুনে সে অবাক হয়ে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আমি বল্লাম কী দেখছ?
সে বলল, তোমাকে।
আমি বল্লাম, এত দিন ধরে তাহলে কী দেখেছো?
সে তারও উত্তরে বল্লো, তোমাকে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে?
উত্তরে সে বল্লো, তোমার মতো এত সুন্দর মনের মানুষ এর আগে অন্য কাউকে দেখিনি, বলেই চোখ বন্ধ করে মুখে মুখ লাগিয়ে লাইব্রেরিতে জন সমুদ্রের সামনে একটি চুম্বন লাগিয়ে দিব্বি চলে গেল।
তারপর?
তার আর পর নেই, কিছু দিন পরে বিরহের কথা লিখে একটি চিঠি এসেছিল। কে লিখেছিল, কী লিখেছিল, কাকে লিখেছিল? সুফিয়া লিখেছিল আমাকে। পল সম্পর্কে, সেও নাকি মনে প্রাণে পলকে ভালোবাসত। কিন্তু পল এত লাজুক ছিল যে ভালোবাসার ফুল তাদের মাঝে ফোটেনি তখন। পরে সুফিয়া অন্য একজনকে বিয়ে করে এতটুকু শুনেছি।
বহু বছর পর আজ পল হঠাৎ টেলিফোন করেছে আমাকে। আমি স্টকহোম আরলান্ডা এয়ারপোর্টে বসে আছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার প্লেন ছাড়বে লন্ডনের উদ্দেশ্যে। ফোন ধরে হ্যালো বলতেই জানলাম পল। কী ব্যাপার পল কেমন আছো, কোথায় আছো, কী করছ?
পল বিনা দ্বিধায় বলে গেল, রহমান আমার বউ নেই, সন্তান নেই, পরিবার নেই, আছে একটি অ্যাপার্টমেন্ট, থাকি একা, কেউ নেই, কিছু নেই। আমি চুপ হয়ে গেলাম, আমার বলার কিছু ছিলো না। আজো সেই সুফিয়ার অপেক্ষায় পল, যার ফলে সে জীবনে বিয়ে করেনি!
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com