পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও ইসলাম

নাসিম ইমরান | Oct 20, 2022 03:56 pm
পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও ইসলাম

পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও ইসলাম - ছবি : সংগ্রহ

 

পানি দূষণ : অপর্যাপ্তভাবে পরিশোধিত বা অপরিশোধিত বর্জ্যের দ্রবণ যদি স্বাভাবিক জলাশয়ে জমা হয়ে দূষিত করে তাকে পানি দূষণ বলে।

সাধারণত যেসব কারণে পানি দূষণ হয় তা হলো
* খাদ্য প্রক্রিয়াকরণজাত বর্জ্য, কীটনাশক এবং ভেষজনাশক, বিভিন্ন ধরনের অর্গ্যানোহ্যালাইডস এবং অন্যান্য রাসায়নিক যৌগ পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বন, যেমন পেট্রোল, ডিজেল জ্বালানি, জেট জ্বালানি, এবং জ্বালানি তেল, মোটর তেল, অনুপযুক্ত সঞ্চয়স্থান থেকে ছড়িয়ে পড়া কারখানার দ্রাবক, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি দ্রব্য এবং প্রসাধনী দ্রব্যে উপস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ

* ড্রাগ, ওষুধ ড্রাগ, বিপাকজাত দ্রব্য, গর্ভনিরোধক বড়ির মতো হরমোন ওষুধ।

* অজৈব পানি দূষণকারী পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : শিল্পকারখানার বর্জ্য বিশেষ করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সালফার ডাই-অক্সাইড,

* খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত অ্যামোনিয়া, শিল্পকারখানার উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত রাসায়নিক বর্জ্য, নাইট্রেট এবং ফসফেট জাতীয় উপাদানযুক্ত সার যা কৃষিজমি থেকে এবং বাণিজ্যিক ও গৃহস্থ ব্যবহারের ফলেও বৃষ্টির পানির সাথে যুক্ত হয়, মোটর গাড়ির ভারী ধাতু, খনির নর্দমা, মাটিতে মানুষের দ্বারা পরিত্যক্ত আবর্জনা যেমন, কাগজ, প্লাস্টিক, অথবা নষ্ট খাবার, পরিত্যক্ত ভাঙা জাহাজ, এর সাথে রয়েছে দুর্ঘটনাপ্রযুক্ত অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে আবর্জনার স্তুপ তৈরি, যা বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে যায় এবং ভূপৃষ্ঠতলীয় পানিতে উন্মুক্ত হয়।

পানি দূষণ ও ইসলাম : পানি দূষণরোধে ইসলাম কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
'নবী করীম সা. বদ্ধ পানিতে প্রশ্রাব করতে নিষেধ করেছেন।'
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৫৪৮)

আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
'তোমাদের কারো উচিত নয়, স্থির পানি যা প্রবাহিত হয় না সেখানে পেশাব করা, অতঃপর সেখানে গোসল করা।'
(সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ২৪০)

কেননা, পেশাবের ভিতর এমন কিছু উপাদান আছে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

ওজু করার আগে পাত্রের পানি যেন দূষিত না হয় এজন্য উচিৎ হাত ধুয়ে নেয়া। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, 'তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠে হাত না ধুয়ে যেন পানির পাত্রে হাত না দেয়। কারণ সে জানে না, রাতে তার হাত কোথায় ছিল।'
(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৫৩৬)

রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা (খাবারের) পাত্র ঢেকে রাখ (পানির) মশকের মুখ বন্ধ করে রাখ, কেননা বছরে এমন রাত্রি আছে, যাতে মহামারী অবতরণ করে। সেই মহামারি যে খোলা পাত্র ও পানির মশকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তাতেই পতিত হয়।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ৫০৮৫)

পানিকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য এ হাদিস বলা হয়েছে। যদি তা খোলা থাকে তাহলে সেখানে পোকা-মাকড় বা ধূলা-বালির মাধ্যমে তা দূষিত হয়ে পড়ে। তাই পানির পাত্র ঢাকার ব্যাপারে ইসলামে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

মাটি দূষণ : মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থগুলোর উপস্থিতি যা জীব ও উদ্ভিদজগতের জন্য ক্ষতিকর তাকে মাটি দূষণ বলে। মাটি দূষণ পরিবেশ দূষণের একটি প্রধান অংশ।

ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন, অর্থনৈতিক প্রয়োজনে রাস্তাঘাট, বাড়ি নির্মাণ, খনিজ সম্পদ আহরণের ফলে ভূমিকে সরিয়ে ফেলা, তেল সংগ্রহ, কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, তেজস্ক্রিয়, আবর্জনা, পৌর ও গ্রামীণ আবর্জনা, শিল্প আবর্জনা, খনিজ আবর্জনা মাটি দূষণের অন্যতম কারণ।

মাটি, পানি, বায়ু প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুই একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। কাজেই বায়ু দূষণ, পানি দূষণ ও মাটি দূষণ একটার সাথে আরেকটা জড়িত। যা বায়ুকে দূষিত করে তা পানিকেও দূষিত করে, দূষণযুক্ত বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে মাটি দূষিত হয়ে পড়ে।

মাটি দূষণ ও ইসলাম : ইসলাম মাটি দূষণকে নিন্দা করে, পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
'যখন সে প্রস্থান করে তখন সে যমীনে অশান্তি সৃষ্টি করে এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণী ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না।'
(সুরা বাকারা, আয়াত : ২০৫)

আয়াতে কৃষিক্ষেত্র ও প্রাণীর ধ্বংসকে বিপর্যয় সৃষ্টির সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায়, ভূমি দূষণ পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি কারণ। শুধু কারখানা, বসত-বাড়ি, কৃষিক্ষেত্রের বর্জ্য দ্বারাই মাটি দূষিত হচ্ছে না বরং আধুনিক চাষ পদ্ধতিও অনেকাংশে দায়ী। মাটির বুননে অনেক বিষয়ও উৎপাদন ও মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাসের জন্য দায়ী, যা মাটিকে ধ্বংস করছে। পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত এখানে অনুধাবনযোগ্য,
'যে শহর উৎকৃষ্ট, তার ফসল তার প্রতিপালকের নির্দেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে অল্পই ফসল উৎপন্ন হয়। এমনিভাবে আমি আয়াতগুলো কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য ঘুর্ণায়মান করি।'
(সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৮)

জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধির জন্য ইসলাম মানুষকে যেসব কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করে তার অন্যতম হলো কৃষি কাজ, যা পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় মৌলিক উৎস। এবং শিল্প বিপ্লবের জোয়ারে কৃষি বিমুখ জাতির অনাগত খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের একমত সমাধানও এই কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা 'শিল্পবিপ্লব ও কৃষি : ইসলামী অন্বেষা' শিরোনামে অন্যত্র করেছি।) ইসলাম একে গুরুত্ব দিয়েছে এবং একে ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছে। রাসুলুল্লাহ সা. সাগ্রহে কৃষি কাজ ও বৃক্ষ রোপণে উদ্বুদ্ধ করেছেন, যাতে উদ্ভিদ সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হয়। যেমন আনাস রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন-
'যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে আর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তবে তা তার জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হবে।'
(সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৩৮২৯)

অপর হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন-
'যে ব্যক্তি কোনো মৃত (অনাবাদী) ভূমিকে জীবিত (চাষযোগ্য) করবে, তা তারই জন্য।'
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর : ৩০৬৩)

উপরোক্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিসগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায়, আল্লাহর নির্দেশিত নিয়মনীতি মেনে চলা প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুর জন্য জরুরি। কোন একটি দূষিত হলে প্রকারান্তরে গোটা সৃষ্টিতে বিপর্যয় ডেকে আনে।

লেখক : গবেষণা বিভাগ, সেন্টার ফর ইসলামিক থট এ্যান্ড স্টাডিজ
nasimuzzamanimran@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us