সুখী মানুষ হঠাৎ কেন দুখী হয়ে পড়ে?
সুখী মানুষ হঠাৎ কেন দুখী হয়ে পড়ে? - ছবি : সংগ্রহ
মানুষের যেটুকু নৈতিকতা ছিল তাও প্রযুক্তির কারণে ধ্বংস হতে চলেছে। প্রযুক্তি ভালোর ভালো এবং খারাপের খারাপ। আমরা চেষ্টা করি শুধু ভালো দিকগুলো নিয়ে কথা বলতে, ভাবতে, লিখতে ইত্যাদি কিন্তু খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করার দরকার পড়ে না কারণ সেগুলো নিজ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে। যদি বলি, এক চামচ মাটিতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জাতির চেয়ে হাজার বা লাখোগুণ বেশি। অনেকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যাবেন, থমকে যাবারই কথা। বাস্তবে যেটা বলেছি সেটাই কিন্তু সঠিক।
ঠিক তেমনিভাবে যদি বলি প্রযুক্তির কারণে বর্তমানের জীবনযাপনে যে সুযোগ সুবিধাগুলো আমরা পাচ্ছি তার চেয়ে হাজারও গুণ সমস্যা আমাদের জীবনে এসে সবকিছু ধ্বংস করছে, যেমন বিবেক ধ্বংস, শান্তি ধ্বংস ইত্যাদি ইত্যাদি। অল্পতে তুষ্ট থাকার উপায় নেই। প্রযুক্তির কারণে লোভ-লালসা থেকে শুরু করে সবকিছু এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে সেখান থেকে বের হবারও উপায় নেই। বিশ্বে যা কিছু ঘটছে তা কিন্তু ইদানীং মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, তা সত্ত্বেও আমরা সব সময় সব কিছু নিয়ে ভাবি না, যতক্ষণ না পর্যন্ত ঘটনাটি সরাসরি আমাদের প্রভাবিত করছে। যেমন সেই কবে রাশিয়া ইউক্রেনকে হামলা করেছে এবং এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে শুর করেছে বিশ্বে সেই শুরু থেকে তবে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এই প্রথম সবার টনক নড়েছে যখন জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। তাহলে সরকারও কি উদাসীন ছিল এত দিন? আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে যদি কোনো কিছুতে সরাসরি প্রভাবিত না হই তাহলে বুঝি না অন্যের সমস্যা, এটাই মানুষের চরিত্র। এটা যে শুধু বাংলাদেশে তা নয় বলতে গেলে সারা বিশ্বে লক্ষণীয়। আজ সুইডেনের একটি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলাম তারই অংশ বিশেষ শেয়ার করি। হয়তো মনের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য সাড়া দিবে, এবং এমন গল্প হয়তো বা অতীতেও শুনেছেন তবে বিষয়টি নিয়ে কি তেমন কোনো ভাবনা ঢুকেছে হৃদয়ের মাঝে?
আমার এক সুইডিশ বন্ধু শিল্পপতি। শিল্পপতিদেরও আমাদের মতো কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ থাকে। এসময় যখন যুদ্ধ চলছে ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে, আমার মতো যাদের ঋণ রয়েছে তাদের মুহূর্তের জন্য শান্তি নেই। আমরা সারাদিন ব্যস্ত কাজের পেছনে। গতকাল এসেছিল আমার বন্ধু ঘরের একটি দেয়াল ভাঙ্গতে, কাজ শেষে লাঞ্চ করলাম একসাথে। এমন সময় তার এক কর্মচারী ফোন করেছে তার বেশ কিছু টাকার দরকার। সংসারের অভাবের কথা বলতে শুরু করল, তখন আমার বন্ধু হেসে বলল, 'শুধু নিজের অভাবের কথাই বললি যদি আমার অভাবের কথা শুনতি তখন দেখতি আমার কম্পানিতে আমার চেয়ে অভাবি আর কেউ নেই। শুনে আমিও একটু অবাক হয়ে গেলাম।
আমি তাকে বললাম, তোর এতো সম্পদ তারপরও অভাব? আমার বন্ধুর নাম রিকার্ড, রিকার্ড একটি গল্প শোনাল। রিকার্ডের বাবা একজন বিশাল ব্যবসায়ী, তার সবই আছে শুধু শান্তি নেই। তাঁর শুধু হাহাকার আর টেনশন। চিন্তায় মাথার চুল সব পড়ে গেছে। রিকার্ডের বাবা একদিন দেখলেন তার অফিসের পিয়ন টেবিল মুছছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। সে পিয়নকে ডেকে বললো 'এই যে তুমি মনে মনে গান গাও, তোমার কি অনেক সুখ, তোমার মনে কি কোনো দুঃখ নেই, কোনো হতাশা নেই?'
পিয়ন উত্তরে বলল, '“না, হতাশা কেন থাকবে স্যার, আপনি যা বেতন দেন তা দিয়ে আমার ভালোই চলে যায়। আমার কোনো অভাব নেই।' কথা শুনে রিকার্ডের বাবা আরো টেনশনে পড়ে গেলেন। পরে তার ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, আমার সব আছে কিন্তু শান্তি নেই, আর আমার পিয়ন যাকে আমি সামান্য কিছু বেতন দেই, সে আছে মহা সুখে, এর রহস্যটা কী বল তো?
ম্যানেজার বলল, রহস্য বললে আপনি স্যার আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবে যদি সত্যই জানতে চান তাহলে, আপনার পিয়নকে প্রমোশন দিয়ে একটা বড় পোস্টে কাজ দিন। আর তাকে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে দিন। এরপর দেখুন কী ঘটে।
রিকার্ডের বাবা তাই করল। এতগুলো টাকা, আর এতবড় চাকরি পেয়ে পিয়ন আনন্দে আত্মহারা। বাসায়ও সবাই খুশি। যেহেতু এখন অফিসার হয়ে গেছে, এখন তো আর যেসে ভাবে বসবাস করা যায় না। কলিগরা কী মনে করবে। প্রথমেই বাসা পরিবর্তন করে আরেকটু অভিজাত এলাকার এপার্টমেন্টে উঠল। দেখল, বিল্ডিংয়ের সবাই সন্তানকে বড় স্কুলে পাঠায়, তাই বাচ্চার স্কুলও চেঞ্জ করতে হবে। কিছুদিন পর বউ ঘ্যান ঘ্যান শুরু করতে লাগলো যেমন সবার বাসায় কত দামি আসবাব পত্র, ফ্রিজ, টিভি, আর আমাদের বাসায় কিচ্ছু নেই। ওগুলোও কিনতে হোল। এরপর শুরু হলো বাচ্চার প্রাইভেট টিউশন, নানা রকম দাবি দাওয়া। যেহেতু সে এখন বড় চাকরি করে, পরিবারের সবার তার কাছে প্রত্যশাও অনেক। সাধ্যমত চেষ্টা করে, তাও সবার চাহিদা মেটাতে পারেনা। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব তার অহংকারী ভাব দেখে দূরে সরে যেতে লাগলো। নানাবিধ টেনশন আর দুশ্চিন্তায় তারও মাথার চুল আস্তে আস্তে কমে যেতে লাগল।
রিকার্ডের বাবা লক্ষ করতে শুরু করলেন ব্যপারটা। উনি বললেন কী ব্যাপার, তোমাকে এত বড় প্রমোশন দিলাম, এত টাকা দিলাম, আর এখন দেখি তুমি আগের মতো আর প্রাণবন্ত নেই। ঘটনা কী? সে উত্তরে বলল, স্যার, কিছু সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু তার সাথে যে এত চাহিদা আর অভাব আসবে তাতো আগে বুঝিনি। আগে আমার কিছুই ছিল না, অভাবও ছিল না। আর এখন যেদিকেই তাকাই, শুধু নেই আর নেই। আগে আমার অভাব পড়লেও সেটা ছিল এক দুই হাজার টাকার ব্যাপার। কোনো না কোনো ভাবে মেটানো যেত। আর এখন আমার অভাব লক্ষ কোটি টাকার। এটা কিভাবে মেটাবো সে চিন্তায় আমার এখন আর রাতে ঘুম আসে না স্যার। রিকার্ডের বাবা নিজেকে বললেন, এত দিনে বুঝলাম, আমার মূল অসুখটা কী!
গ্রীডি বা লোভ জীবনের এই সমস্যার জন্য দায়ী। একটি নতুন চাহিদার জন্য দশটা অন্যায় করতে হয়। যতই দুনিয়ার মানুষ সম্পদের জন্য ছুঠছে ততই আরো চাই এমনটি চিন্তা মাথায় ঢুকছে যার ফলে অবস্থা এখন শোচনীয়। আমাদের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, তাতেও আমরা সন্তুষ্ট হবো না, বরং আরেকটি উপত্যকা কামনা করব। আমাদের পেট ভরে তো চোখ ভরে না, চোঁখ ভরে তো মন ভরে না, মন ভরে তো আশা ফুরায় না।
পৃথিবী প্রকৃতপক্ষে ছোট্ট একটি ভূখণ্ড তাকে খণ্ড খণ্ড করে ভাগ বন্টন করার পরও চলছে প্রতিযোগিতা কিভাবে পুরোটাই গ্রাস করা যায়। আমরা মানবজাতি হয়ে গেছি দানব। সামান্য একটি মোবাইলের কারণে পরিবারের মধ্যে নেই সুসম্পর্ক। আমরা সবাই মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়না, কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলার সময় নেই। ফলে সবার ওপর থেকে সম্মান, স্নেহ, ভালোবাসা সবই কমে যাচ্ছে। আমরা পরের জন্য ভাবতে ভুলে গেছি। আমরা এখন শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। প্রযুক্তি দিয়েছে বিলাস, করেছে অলস, কেড়েছে সুখ, শিখিয়েছে নিতে, ভুলিয়েছে দিতে, করেছে মোদের অসুখ!
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com