স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের চেয়ে খরচ করার সক্ষমতা জরুরি
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের চেয়ে খরচ করার সক্ষমতা জরুরি - ছবি : সংগ্রহ
বাজেট প্রস্তাবের পর বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর টানাটানি শুরু হয়। মনে হয় বাজেটের যদি রাবারের মতো বাড়তে থাকত তাহলে বিষয়টি দারুণ হতো। সাবার মন ভোলানো যেত। স্বাস্থ্য খাতেও বাজেট বাড়ানোর জন্য পুরনো দাবি নতুন করে দেখা দেয়। কিন্তু বাজেট বাড়াবে কি? প্রতিবছরই টাকা ফেরত পাঠাতে হয়। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সরকারি তহবিলে ফেরত গেছে। যা স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মোট বরাদ্দের প্রায় ৪৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরেও এই খাতে মোট বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪১ শতাংশ।
অন্যদিকে দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক পদ ফাঁকা। সেখানে নিয়োগ দেয়া হয় না দীর্ঘ দিন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালের উপরের দিকের যেমন পদগুলো আছে ঠিক তেমানি নিচের দিকের পদগুলোও অনেক বেশি। বিশেষ করে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকট স্বাস্থ্য খাতে বার বার আলোচনায় এলেও এ নিয়োগের কোনো উদ্দ্যোগ দেখা যায় না। ফলে অনেক যন্ত্রপতি থাকার পরেও সেগুলো ব্যবহার করে রোগ নির্ণয়ের মতো কাজগুলো করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় অনেক সরকারি হাসপাতলের এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিনের মতো সবসময় প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্জিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এই বঞ্চনার মধ্যে সবেচেয়ে খারাপ অবস্থা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। প্রান্তিক মানুষের সবেচেয়ে আস্থার জায়গা হওয়ার কথা ছিল উপজেরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। কিন্তু সমন্বয় না থাকায় সেই প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। এতে নির্ভর করতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে। কিন্তু বেশির ভাগ প্রান্তিক মানুষের সেই সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। তারা বাধ্য হয়েই চলে যায় হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। যেখানে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসায় অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করে। এতে চিকিৎসা ব্যয় আরো বেড়ে যায়। অসংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এই হার অনেক বেশি। কারণ এসব রোগ ধীরে ধীরে আক্রান্ত করার কারণে শুরুতে সাধারণ মানুষ গুরুত্ব দিতে চায় না। ফলে শেষ ধাপে গিয়ে যখন চিকিৎসকের কাছে যায় তখন ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে যায়। অনেক সময় সেটিই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।
অথচ আমাদের আছে অত্যন্ত চমৎকার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। এই কাঠামো কাজে লাগাতে না পারায় মানুষের আস্থা উঠে যায়। সাধারণ মানুষ একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে সেখানে আস্থা ফেরানো অনে কঠিন। আর সেটাই এখন বাস্তবে দেখা দিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দেশের বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাঙ্কিত লোকবল না থাকায় সাধারণ পরীক্ষাগুলো করানো সম্ভব হয় না। আর ওষুধ কেনার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে অনেক ওষুধ মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অপারেশন থিয়েটার থাকলে সার্জন নেই তো সার্জন থাকলে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক নেই। এসব নানা জটিলতা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে দিয়েছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
অন্যদিকে এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষার মতো সাধারণ সেবাও অনেক সাধরাণ মানুষ নিতে যায় না। এর কারণ হিসেবে বড় অভিযোগ সেখানকার নিয়োগ পাওয়া টেকলোজিস্ট বা স্যাকমোদের (সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ড কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার) ব্যাবহারের কারণে। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা চিকিৎসরা বেশির ভাগ সময়ই কোনো ভূমিকা নিতে পারেন না।
এর কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. অব্দুল হামিদ বলেন, টেকনোলজিস্ট বা এই পর্যায়ের কর্মচারিরা এক জায়গায় অনেক দিন ধরে থিতু হয়ে থাকে। ফলে তারা নিজেদের একটা বলয় তৈরি করে ফেলে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো অনেক সময়ই সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে সেখানে চিকিৎসক এবং স্বস্থ্য কর্মকর্তা আসার পরেই তাদের শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। যত দ্রুত পারে উপজেলা থেকে জেলা বা ঢাকার বড় হাসপাতালে বদলি নিতে। নবীন চিকিৎসকদের এমন উচাটন মন কখন একজন থিতু হয়ে থাকা টেকনোলজিস্ট বা স্যাকমোদের বিরুদ্ধে কিছু করার বা বলার ইচ্ছে থাকে না। তাদের অসদাচারণের কারণে স্থানীয় মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোই বেছে নেয়। আর নিম্নমধ্যবিত্তরা নিজেদের রোগ পুষে রাখে।
অন্যদিকে একটি কার্যকরা রেফারেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যপারে বার বার দাবি করে করে আসছে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এই রেফারেল ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলে সাধারণ সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের রোগীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে টার্শিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে যাওয়ার কথা। এই ব্যবস্থা না থাকয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ না থাকায় সেটিও কার্যকর করা যাচ্ছে না। এমন ব্যবস্থা গড়ে উঠলে রোগীদের বেশির অভিযোগের সুরাহা হবে। বিশষেজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগীর সংখ্যা কমে যেতো ফলে একজন চিকিৎসক আরো বেশি সময় নিয়ে রোগী দেখতে পারত। এমন হাজারো সমস্যয় জর্জরিত স্বাস্থ্য খাতের সমস্য সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
এমন সিস্টেমের সমস্যা সমাধান না করে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে খুব বেশি লাভ হবে বলে মনে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে ফাঁকা পদে লোক নিয়োগ প্রয়োজনে নতুন পদ সৃজন করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে সাধারণ মানুষের বঞ্চনা থেকেই যাবে।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী