পাকিস্তান-চীনকে টার্গেট করে ভারতের অগ্নিবীর!
পাকিস্তান-চীনকে টার্গেট করে ভারতের অগ্নিবীর! - ছবি : সংগ্রহ
ভারতে 'অগ্নিপথ' নামে সামরিক বাহিনীর একটি শাখা খোলা হচ্ছে। একে কেন্দ্র করে ভারতে তুমুল আন্দোলন হচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। কেন এই বাহিনী গঠন করা হচ্ছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশটির সাবেক সেনাপ্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখাটি এখানে প্রকাশ করা হলো-
অগ্নিপথ নিয়ে খুব গোলমাল চলছে। ভারতজোড়া সেই গন্ডগোল টনক নড়িয়েছে সরকারের। হঠাৎ করে সামরিক বাহিনীতে চাকরির এমন সুন্দর একটা প্রকল্প নিয়ে গোল কেন বাধল? কেন দেশের হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে পড়লেন? আগুন জ্বালিয়ে দিলেন রেলওয়ে সিস্টেমে? ভাবনা ধরানোর মতো বিষয়। পাশাপাশি, আরো একটা জিনিস ভাবাচ্ছে। এই তরুণ সম্প্রদায়ের পথে নেমে পড়া সরকারকে বাধ্য করেছে প্রকল্পের রূপরেখায় বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনতে। আচ্ছা, সরকার তো এটা আগেই করতে পারত? একটু আঁটঘাট বেঁধে নামা। নামতে পারত না?
মনে রাখতে হবে, সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়াটা এখনো এ দেশের একটা বড় অংশের কাছে গর্বের। আমি যখন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েছিলাম, তখনও দেখেছি, আমাদের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করত। শুধু আমার নয়। আমার সাথে সেই সময় যারা কাজ করেছেন, সকলের। পরে যখন দেশের সেনাপ্রধান হয়েছি, তখনও দেখেছি, সকলের মধ্যে কী ধরনের আবেগ কাজ করে! আর এখনকার ছবিটাও দেখলাম। একটুও বদলায়নি! গত কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে একের পর এক ছবি দেখেছি। এবং উপলব্ধি করেছি, প্রতিবাদ-বিক্ষোভের কারণটা আসলে সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়া কেন্দ্র করেই। ফলে সেই আবেগটা এই প্রজন্মের মধ্যেও বেঁচে আছে। সেটা বুঝতে এবং জানতে পেরে ভালো লাগছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়াটা কিন্তু কোনোভাবেই বাধ্যতামূলক নয়। সম্পূর্ণভাবেই ‘স্বেচ্ছামূলক’। আমরা যাকে ‘ভলান্টারি’ বলি। আমার বিশ্বাস, অগ্নিপথের আসল উদ্দেশ্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়ানো। শক্তি তখনই বাড়বে, যখন তার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সরকার সেটাই চাইছে। এবার যেটা হলো, সাধের সাথে সাধ্যের ফারাক দেখা দিলো। বাজেট কমাব আবার শক্তিও বাড়াব! দুটি একসাথে করতে গেলে যেটা হয়, সেটাই হলো। তৈরি হলো বিতর্ক। সামরিক বাহিনীর মানব সম্পদ বৃদ্ধি করতে গেলে নিয়োগে জোর দিতেই হবে। অথচ আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে চিন্তা রয়েছে। ফলে একটা বিশেষ পথ অবলম্বন করতে হল সরকারকে। চার বছরের ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ’। তার পর সেখান থেকে ২৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’কে তিন বাহিনীতে শূন্যপদ এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তি করানো হবে। বাকি ‘অগ্নিবীর’দের উপযুক্ত আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে মূল স্রোতে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এর পরেই অগ্নিপথ-বিক্ষোভ। তার পরেই একের পর এক সরকারি বার্তা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পদ্ধতি বা আধাসামরিক বাহিনীর নিয়োগে ওই ৭৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’দের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হলো।
আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখা লিখতে গিয়ে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে। আমি যখন সেনাপ্রধান, তখনও তো সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ হয়েছে। তখনো সেনাবাহিনীর পরীক্ষায় বিপুল ভিড় হতো। এখনো হয়। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর আগে কয়েকটি জিনিস বুঝে নেয়ার চেষ্টা চলত। তার এক নম্বরে থাকত, বাহিনীতে ঠিক কত সদস্যের সেই মুহূর্তে প্রয়োজন রয়েছে। এটা নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরুর প্রাথমিক শর্ত। আমার বিশ্বাস, অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণার আগে সরকার নিশ্চয়ই তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে কথা বলে সে সব নিয়ে সমীক্ষা করেছে। তার পর এই প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছে। আসলে বাহিনীর সদস্য বাড়ানোর এক এবং একমাত্র উপায় হল নতুন নিয়োগ।
কিন্তু নিয়োগের আগে কয়েকটা ভাবনাগত ধাপ থাকা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করি।
আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ১৫ লাখ। প্রথমেই বুঝে নিতে হবে, ভারতের এই মুহূর্তের পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন। সেই পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে আমাদের সর্বোচ্চ কত সৈনিক প্রয়োজন। আমরা ১৫ লাখই রাখতে চাইছি? কমাতে চাইছি? নাকি আরো বাড়ানো প্রয়োজন? এর সবটাই নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর। একটু নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, পাকিস্তান এবং চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক এই মুহূর্তে কেমন, সেটাই পরিস্থিতি মাপার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। ওই দুই দেশ কিন্তু আমাদের চিরশত্রু। কূটনৈতিক ভাবে যদি তাদের মোকাবিলা না করা যায়, তা হলে যুদ্ধ তো আবশ্যিক। তাই না! এ বার দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো— আমাদের টাকা আছে কি না। কারণ, সামরিক বাহিনীতে মানবসম্পদের অন্তর্ভুক্তি মানেই বাড়তি টাকা।
শুধু উচ্চমানের সৈনিকই নয়, বাহিনীর ব্যবহার্য হাতিয়ারের দিকটাও ভাবতে হবে। হাতিয়ার কেনার টাকা আছে কি না, সেটা গুরুত্ব-তালিকার তিন নম্বরে রাখতে হবে। হাতিয়ার প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলার আছে। অত্যাধুনিক হাতিয়ারের সবটাই আমাদের দেশে তৈরি করা যায় কি না, তা-ও এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমরা অনেকটা করতে পেরেছি। কিন্তু আরো দরকার। এখানে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা (পাবলিক সেক্টর) রয়েছে। রয়েছে বেসরকারি সংস্থাও (প্রাইভেট সেক্টর)। তাদের সাথে কথা বলে দাম-দস্তুর করে কাজটা করানো যেতেই পারে। কারণ, বিদেশ থেকে অস্ত্রপাতি কিনতে আমাদের প্রচুর ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। দেশে অত্যাধুনিক হাতিয়ার তৈরি করাতে পারলে আর্থিক সাশ্রয় হতে পারে।
তা হলে আসল কথা কী দাঁড়াল? মানবসম্পদের পাশাপাশি আরো একটা বিষয় এখানে মূল ফ্যাক্টর— অর্থ। সেই অর্থ কতটা আছে, সেটা একটা সরকারকে প্রথমেই ভেবে নিতে হয়। অর্থাৎ সরকারকে যেমন ভাবতে হবে সামরিক বাহিনীতে ঠিক কত লোক এই মুহূর্তে প্রয়োজন, তেমনই ভাবতে হবে তার কাছে কত পরিমাণ অর্থ রয়েছে এই বাবদে ব্যয় করার মতো। মূলত এই দু’টি বিষয়কে মাথায় রেখেই একটা সরকারকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ করতে হয়।
আমার মনে হয়, সরকার আর্থিক জায়গা থেকেই ‘অগ্নিবীর’দের চুক্তিকালীন সময়টা চার বছর করেছে। ওই সময় শেষে ২৫ শতাংশের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি এবং বাকি ৭৫ শতাংশকে এককালীন কিছু আর্থিক সুবিধা দিয়ে মূল স্রোতে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত- সবটার সাথেই জড়িয়ে রয়েছে সরকারের আর্থিক সঙ্গতি বা অসঙ্গতি। আরো একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আমাদের। প্রত্যেক সরকারের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকে। এই সরকারেরও হয়তো থাকবে। সেটা অস্বাভাবিকও নয়। অগ্নিপথের নেপথ্যে রাজনৈতিক কোনো কারণ থাকতে পারে। থাকতে পারে জাতীয়তাবাদী কোনো লক্ষ্যও। কিন্তু আমার মতো মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব।
এ বার একটা আশঙ্কার কথা লিখি। অগ্নি-বিক্ষোভের পর এই যে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওই ৭৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’দের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করছে, এটায় হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, আগেই লিখেছি, আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ‘অগ্নিবীর’দের বাইরে আরো লাখো লাখো তরুণ-তরুণী রয়ে যাবেন এই সমাজে। তারা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে না চাইলেও উপকূলরক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। চাকরি করতে ইচ্ছুক অন্যান্য সরকারি চাকরিতেও।
‘অগ্নিবীর’দের জন্য নতুন এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা দেশে আর এক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠবে না তো! ঘর পোড়া গরু তো! সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো লাগেই।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা