চীনের ঋণ ফাঁদ কূটনীতি এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ

রুবায়েত আলম | Jun 19, 2022 02:57 pm
চীনের ঋণ ফাঁদ কূটনীতি এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ

চীনের ঋণ ফাঁদ কূটনীতি এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ - ছবি : সংগ্রহ

 

গত বছরের নভেম্বর মাসজুড়ে চীনের এনটেবা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করায়ত্ত করা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে নানা রিপোর্ট আসতে থাকে। মুসেভেনির নেতৃত্বাধীন উগান্ডা সরকারের চীনের এক্সিম ব্যাংকের সাথে করা ২০৭ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি নিয়ে সংবাদ প্রচার করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা। কারণ অন্যদিকে চীন সরকার বিমানবন্দর দখলের দাবি অস্বীকার করে।

বিপরীতে চীন স্বাধীন উন্নয়নের জন্য আফ্রিকার সক্ষমতা উন্নত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক বলে জানানো হয় উগান্ডার চীনা দূতাবাস থেকে । আর আন্তর্জাতিক ফরেন্স পলিসির অ্যানালাইসিস থেকে জানা যায় যে এ ধরনের পরিস্থিতি মোটেও প্রথমবার নয়।

জিওস্ট্রাটেজিস্ট ব্রাহমান চেলানি চীনের এই ঋণ ফাঁদ কূটনীতিকে 'China's Predatory Lending Practices' বলে অভিহিত করেন। যাইহোক, ১৮ সালের ডিসেম্বরের ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে জানা যায় যে তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন দাবি করেছিলেন যে জাম্বিয়ান সরকার তার ঋণ খেলাপি হলে চীন কিছু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিকল্পনা করে। আফ্রিকার গোপনীয় নিউজলেটারে তিন মাস আগে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি 'জেসকো' চীনা কোম্পানির দখলকৃত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করে যা জাম্বিয়ার জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং চীনা মালিকানা নিয়ে উদ্বেগ উত্থাপন করতে যথেষ্ট।

এদিকে জাম্বিয়ার বাহ্যিক ঋণ বৃদ্ধি পেতে থাকে যা জিডিপির ৩৫ ভাগ বলে ধারণা করা হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, এটি ২০১১ সালে ১.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৮ সালে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। দক্ষিণ আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম তামা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জাম্বিয়ার জন্য চীনা ঋণ একটা বড় ফাঁদ ছিল যা জিবুতি এবং কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসহ ১৫টি আফ্রিকান দেশকে প্রভাবিত করে আসছে।


উগান্ডা সরকারের ঋণখেলাপি

'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'র অধীনে উগান্ডা ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার (সর্বমোট ২০৭ মিলিয়ন ডলার) অধিগ্রহণের পর মে ২০১৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ২০১৫ সালের ৩১ মার্চে। একই সালে উগান্ডা তার পরিবহন খাত সম্প্রসারণ এবং এর অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নত করার আশায়, একটি উচ্চাভিলাষী সিভিল-এভিয়েশন মাস্টার প্ল্যান চালু করে যার মধ্যে তার একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আপগ্রেডেশন অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি নতুন টার্মিনাল, সম্প্রসারিত রানওয়ে এবং নতুন কার্গো এবং এনটেবে জ্বালানি কেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত। এই লক্ষ্যেই উগান্ডা সরকার চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের সাথে এই ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর উগান্ডা সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কয়েকজন ব্যবস্থাপক এই প্রজেক্টে অগ্রসর হতে অসম্মতি জানায়। কারণ অ্যানালাইসিস থেকে জানা যায় যে ঋণচুক্তির অধীনে ১৩টি ধারা এন্টেবে বিমানবন্দরকে চীনের কাছে হস্তান্তর করার সামিল। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ধারা যা উগান্ডার কর্মকর্তারা ঋণ চুক্তিতে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন তা হলো ইউসিএএ'র বাজেট যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চীনা ঋণদাতার কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার সাথে সম্পর্কিত।

যাইহোক, প্রকল্পটির প্রথম ধাপ একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, একটি নতুন কার্গো কমপ্লেক্স, দুটি রানওয়ে এবং তাদের সংশ্লিষ্ট ট্যাক্সিওয়ের আপগ্রেডে থামে। কিন্তু এই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় বর্তমান সরকার।

অতি সম্প্রতি উগান্ডার অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের আইনি উপদেষ্টা হিসেবে কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে সংসদ সদস্যদের নিশ্চিত করেন যে এন্টেবে বিমানবন্দর চুক্তির অবলিগেশন সরকার সম্পাদন করতে সক্ষম এবং এসক্রো অ্যাকাউন্টে কোনো ধরনের দুর্নীতি হবে না বলে নিশ্চিত করেন তিনি। কারণ বর্তমান বিমানবন্দরের আয়ের উৎস ঋণ পুনরুদ্ধারের প্রধান উপায় হিসেবে যথেষ্ট।

সবশেষে উগান্ডা এখনো ঋণ পরিশোধ শুরু করেনি জানিয়ে মুসেভেনি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল বিমানবন্দর দখল নেয়ার প্রচারণাকে ইয়েলো জার্নালিজমের দৃষ্টান্ত বলে জানান।

মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের আঞ্চলিক একীকরণের উন্নতি, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার লক্ষ্যে স্থল ও সামুদ্রিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এশিয়াকে আফ্রিকা ও ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করার বাণিজ্যিক কূটনীতির অফিসিয়ালিটিই হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ যার অধীনেই চীন আফ্রিকান দেশগুলোকে নানা প্রজেক্টে ঋণ দিয়ে আসছে। ২০১৩ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং প্রজেক্টটির নামকরণ করেন যিনি ২০০০ বছর আগে হান রাজবংশের সময় প্রতিষ্ঠিত সিল্ক রোডের (প্রাচীন বাণিজ্য রুট যা চীনকে ইউরেশিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের সাথে কয়েক শতাব্দী ধরে সংযুক্ত করেছিল) ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন।

মূলত বিআরআই সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট- একটি ট্রান্স-মহাদেশীয় উত্তরণ যা চীনকে স্থলপথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপের সাথে সংযুক্ত করে বন্দর, সড়ক, রেলপথ ও বিমানবন্দরের পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কগুলোর জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের একটি খুব বড় কর্মসূচির সাথে যুক্ত হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চীনা রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বিআরআই ঋণের পরিমাণ হ্রাস পায়। বিআরআই এখন উচ্চমানের বিনিয়োগের ওপর জোর দিচ্ছে, যার মধ্যে প্রকল্প অর্থায়ন, ঝুঁকি কমানোর ইনেশিয়েটিভ এবং গ্রিন ফাইন্যান্সের বৃহত্তর ব্যবহার অন্যতম।

বিআরআইর রিটার্ন হারের জন্য অনেকবার বাজেভাবে সমালোচিত হয়েছে এবং কেউ কখনো বিআরআই থেকে কৌশলগতভাবে অবস্থিত হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দরকে ডি-লিঙ্ক করতে পারেনি। এই বন্দরটি চীনের তহবিল মূলধন ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় শ্রীলঙ্কা সরকার ১.১২ বিলিয়ন ডলার প্রদানের মাধ্যমে ৯৯ বছরের ইজারা নিয়ে চায়না মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিংসের কাছে হস্তান্তর করে।

রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষকরা চায়না মার্চেন্ট পোর্ট হোল্ডিংস কোম্পানি (সিএমপোর্ট) এবং শ্রীলঙ্কা পোর্টস অথরিটির (এসএলপিএ) মধ্যে এই চুক্তিটিকে ওই সময় একটি অন্যায্য চুক্তি হিসেবে দেখেছিল।

চীনের বিআরআই-এর ঋণ-ফাঁদ কূটনীতির শিকার হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে উদ্ধৃত করার এটি একটি প্রধান কারণ এবং জাম্বিয়া, উগান্ডার মতো দেশগুলোর অবস্থার সাপেক্ষে, চীন সরকারের ভাষায় তাদের প্রজেক্টের ইনেশিয়েটিভগুলো আফ্রিকার দরিদ্রদেশগুলোর জন্য সহযোগিতা, যেখানে আফ্রিকানদের কাছে তা ফ্রাংকাফ্রিংকের মতো নিউকলোনিয়ালিজমেরই একেকটা কূটকৌশল।


তথ্যসূত্র :
https://m.economictimes.com/news/international/business/china-reportedly-takes-over-ugandas-airport-on-account-of-loan-default/amp_articleshow/87957646.cms

https://amp.theguardian.com/global-development/2019/dec/11/china-steps-in-as-zambia-runs-out-of-loan-options

https://www.indiatoday.in/amp/world/story/revival-hambantota-port-sri-lanka-strengthen-china-position-indian-ocean-1781171-2021-03-19

https://www.indiatoday.in/amp/world/story/revival-hambantota-port-sri-lanka-strengthen-china-position-indian-ocean-1781171-2021-03-19

https://www.parliament.go.ug/news/5460/entebbe-airport-contract-china-okay-says-kiryowa.


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us