চুরির চেইন ম্যানেজমেন্ট
চুরির চেইন ম্যানেজমেন্ট - ছবি : সংগ্রহ
আমার এক ব্রিটিশ বন্ধু এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ভ্রমণে রয়েছে, বন্ধু বাংলা পড়তে পারে, লিখতে পারে না। সে ছবিটিসহ ইংরেজীতে যে কমেন্টস করেছে সেটা নিম্নরূপ : সরকারি অফিসে পোস্টার ঝোলানো রয়েছে 'দুর্নীতিমুক্ত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান।' এ ধরণের পোস্টার বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে বাঙালি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি। তুমি কি ইংল্যান্ড বা সুইডেনে এরকম পোস্টার কল্পনা করতে পার?
বন্ধু জানে আমি লিখি, সে জানে আমি বিষয়টি দেখে আর কিছু না হোক রিফ্লেক্ট করব। ফেসবুকের পেজে ছবিটি দেয়ার সাথে সাথে মেসেঞ্জারে অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু মতামত এবং মন্তব্য দেখলাম। যেমন লিখেছে 'বাংলাদেশের তুলনায় ইংল্যান্ড বা সুইডেনের প্রসঙ্গ ভিন্ন। প্রতিটি দেশের নিজস্ব উন্নয়ন স্তর রয়েছে এবং সেই উন্নয়ন স্তরের সাথে সামাজিক বৈশিষ্ট্য বিরাজমান। আপনার বন্ধুর উচিৎ আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এবং বাস্তবে এর পরিণতি বিষয়ে অধ্যয়ন করা।'
মন্তব্যটি দেখে মনে হলো একদল শিক্ষিত সমাজ বিষয়টির বিশ্লেষণ যদি এভাবে দিতে পারে সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে এটা কোনো ঘটনাই নয়, বরং দেশের সাধারণ মানুষ এসব ‘সাইনবোর্ড’ দেখে স্বস্তি পায়। তারা ভাবে যাক ভালো যে এখানে অন্তত দুর্নীতি হয় না ইত্যাদি।
আমি বিষয়টি নিয়ে আর কিছু না লিখি, বরং কয়েকটি বিষয় নিয়ে কিছু রিফ্লেক্ট করি। ইদানীং দেশে প্রায়ই দেখি একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাস করে ভাই, আপনি নামাজ পড়েন? একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে এমনটি প্রশ্ন করতেই পারে, এবং খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা একজন চাকরিজীবিকে প্রশ্ন করতে পারি না ভাই, আপনি কি দুর্নীতি করেন? বা ভাই, আপনি কি বিবাহিত এবং আপনি কি আপনার স্ত্রীর সাথে সহবাস করেন?
এখানে তিনটি বিষয়ের ওপর তিন ধরণের প্রশ্ন করা হয়েছে। মুসলমান হলেই যে সবাই নামাজ পড়ে তা নয় আবার চাকরি করলেই যে সবাই দুর্নীতি করে সেটাও সঠিক নয়। তবে বিয়ে করলে স্ত্রীর সাথে সহবাস হয় এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিয়ে করার উদ্দেশ্যই কিন্তু সহবাস করা।
এ ধরণের সহজ জিনিস বুঝতে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন এবং বাস্তবে এর পরিণতি বিষয়ে অধ্যয়ন করতে হবে এটা এর আগে কখনও শুনিনি!
আমি মনে করি রাষ্ট্রের উচিত হবে অনতিবিলম্বে এ ধরণের সমস্ত ‘সাইন বোর্ড’ তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয়া। এ ধরণের ‘সাইন বোর্ড’ জাতি তথা দেশের জন্য অপমানজনক বার্তা। এতে স্পষ্ট যে দেশে শুধু দুর্নীতি হয় তা নয়, দুর্নীতি সর্বজন স্বীকৃত। সাইন বোর্ড না থাকলেও হয়ত দুর্নীতি হবে, তবে জনসমাজে এ ধরণের ‘দুর্নীতি’ অন্তত একটি নীতিতে পরিনত হবে না!
একটি গল্প মনে পড়ে গেল। ব্যাংকে ডাকাত ঢুকে সব টাকা পয়সা নিয়ে যাবার বেলা হঠাৎ দুজন গ্রাহক ডাকাতদের দেখে ফেলে। গ্রাহক দুজন সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। তারা ব্যাংকে এসেছিল মূলত টাকা তুলতে। তো ডাকাতদের মধ্যে একজন হঠাৎ বন্দুক সামনের দিকে ধরে জিজ্ঞাসা করল, এই কে দেখেছিস আমাদের? সত্যি কথা বল, নইলে গুলি করে দুজনকেই মেরে ফেলব? স্বামী তাড়াহুড়া করে উত্তরে বলল; আমি না, আমার স্ত্রী দেখেছে।
আমরা মূলত এভাবেই সব কিছু দেখছি, শুনছি কিন্তু বোধ করেছি না, শুধু বলছি যেমন বর্তমান সরকার লুটপাট করছে ইত্যাদি। আমি নিজে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিতে নানা বিষয়ের উপর কাজ করেছি। সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট তার মধ্যে অন্যতম। সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট কী তাও অনেকে জানে তবুও সহজ করে বিষয়টি নিম্নরূপে ভাবা যেতে পারে। বীজ বপন থেকে শুরু করে সেটাকে খাবার হিসেবে শরিরে ঢোকানো এবং শেষ পর্যন্ত ধাপগুলোকে ধরতে পারি একটি প্রসেস হিসেবে। এ শুরু থেকে শেষের মাঝখানে রয়েছে বিভিন্ন ধাপ এবং তার জন্য রয়েছে কিছু মাধ্যম যেমন শ্রমিক, পানি, সূর্যের আলো, বাতাস, তাপমাত্রা, জায়গা এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ এবং তাদের সক্রিয় ভূমিকা। এ শুরু থেকে শেষ প্রসেস এবং এর বিভিন্ন ধাপের সাথে যুক্ত রয়েছে সময়। সময় আবার দুই প্রকার। পুরো সময় এবং অংশ বিশেষ সময়।
এখানে রয়েছে ল্যান্ড, লেবার, অর্গানাইজেশন এবং ক্যাপিটালসহ অর্থনীতির মূল দিকগুলো। সাপ্লাই মানে কোনো জিনিস এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেয়া। চেইন মানে যুক্ত করা যেমন স্টেপ বাই স্টেপের সমন্বয়। ম্যানেজমেন্ট মানে পুরো জিনিসগুলো যেন সিস্টেমের সাথে চলে সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। যে এই দায়িত্বে সে ম্যানেজার। যে কাজ করে সে কর্মচারি। ম্যানেজার ম্যানেজ করে এবং ম্যানেজার হতে পারে অনেক রকমের, নির্ভর করছে তার দায়িত্ব এবং কর্তব্যর ওপর।
এখন এই গ্রামের কৃষকের সেই বীজ বপন থেকে শুরু করে ভাত পেটে যাওয়া পর্যন্ত ধাপগুলোকে যদি একত্রিত করি তাহলে হয়ে গেল সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট।
এ বিষয়টি পড়তে অনেকে যায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিসনেস স্কুল বা স্টকহোম স্কুল অফ ইকোনমিক্সে। হ্যাঁ শিক্ষার জন্য যেকোনো দেশে যাওয়া যেতে পারে। তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু শেখা এবং জানা।
তবে আমার উপরের বর্ণনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার। তা হলো ইটপাথর দিয়ে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় করে কী হবে যদি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সফল না হয়!
তাই আমরা যে যেখানে আছি, যদি কিছু শিখতে চাই, তা অবশ্যই সম্ভব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বাধাবিঘ্নকে ভাবনায় ঢোকানো এবং তা থেকে সমাধান বের করাই কিন্তু আসল শিক্ষা। আমার মনে হয় প্রশিক্ষণ এমন করে অনেক জটিল বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানের আলো দিতে পারে। এর জন্য দরকার মোটিভেশন এবং ডেডিকেশন। এই একইভাবে আমরা যদি নিজেদের শরীরকে নিয়ে ভাবি তাহলে অনেক কিছুই শিখতে পারি। আমরা যারা আমাদের শরীরকে সুন্দর করে ম্যানেজ করতে শিখেছি তারা সুস্থ রয়েছি। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সমাজের নানা অসুস্থ পরিবেশকে আমরা ইচ্ছা করলে উপেক্ষা করতে পারি। এ পারা না পারার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের ওপর নির্ভর করছে। জীবনের পাঠশালা থেকে যে শিক্ষা আমরা পেয়ে থাকি তা কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষা।
আমরা কি সত্যিকারার্থে আমাদেরকে জানতে চেষ্টা করছি? এ প্রশ্নের উত্তর শুধু আমরাই জানি। ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোনের মাঝে রয়েছে সেই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পেতে পারি সব অজানা তথ্য। শেখার শেষ নেই যেমন, কৌতুহলীরও শেষ নেই তেমন। সবার আগে সর্বশেষ শেখার যেন না হয় শেষ, এবং আমাদের ধ্যানে এবং জ্ঞানে যেন সব সময় নতুন কিছু শেখার প্রবনতা বৃদ্ধি পাই এবং তা যেন সৃজনশীল এবং যুগপোযোগী হয়।
আমাদের উদ্দেশ্য একটি সোনার বাংলাদেশে গড়ার যেখানে থাকবে আইসিটি রিলেটেড প্রযুক্তি, সাথে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা কেন্দ্র যেমন প্রোটিন, আমিষ, নিউট্রিশন, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ওপর। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে গবেষণা থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং তা বাস্তবে রূপান্তরিত করা এবং সেটা শিক্ষার মূল লক্ষ্য। শুধু থিওরি নয় বাস্তবতার সঙ্গে অন দি জব ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে, লার্নিং বাই ডুইং এবং লার্নিং ফ্রম ল্যারনারস কনসেপ্টের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে পুরো জাতি।
আমরা পারিবারিক জমি এবং ফান্ডিং থেকে পুকুর কাটা, বিভিন্ন মাছের চাষ, হাঁস মুরগি, গরু ছাগল, নানা ধরণের শাকসব্জির চাষ থেকে শুরু করে, বিভিন্ন ধরণের ধানের ওপর নতুন প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে পাইলট প্লানের মাধ্যমে কাজ করেছি।
টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে বিদেশি চিকিৎসকের সাথে স্থানীয় চিকিৎসকের সমন্বয় সৃষ্টি করে নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশী প্রশিক্ষকও আনা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের প্রশিক্ষণের যে ধরণ যা সেই পুরোনো প্রথানুযায়ী চলছে, তাতে করে ঐ ধরণের অর্থাৎ বিশেষায়িত শিক্ষা পরিচালনা করার মতো পরিবেশ দেশে হয়নি তখনো। এদিকে সরকার থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা এখনো হয়ে ওঠেনি।
কোনো উপায় না দেখে যারা কিছু জমি দিয়ে সাহায্য করেছিল তাদেরকে অর্থ বা অন্য জমি ফেরত দিয়ে সমস্ত ঝামেলার অবসান ঘটাতে হয়েছে । এ ছাড়াও নানা বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয় যেমন কম্পিউটার চুরি, গরু চুরি, মাছ চুরি, ধান চুরি। চুরি আর চুরি।
শেষে বড় আকারের অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা। যে জিনিসটা আমি লক্ষ করছি সেটা হলো বাংলাদেশে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের প্রাক্টিস না হলেও চুরি চেইন ম্যানেজমেন্টেক প্রাক্টিস চলছে দেদারছে। প্রশ্ন হতে পারে সে আবার কী? অতীতে দেশে মানুষ ঘুষ নিত বিনিময়ে ভালো করুক, মন্দ করুক কাজ করত। এখন সেটাও বন্ধ। সবাই মিলে একটি প্রজেক্ট, ব্যাংক, প্রকল্প, সরকারি বা জনকল্যাণমূলক কাজ যাই বলি না কেন চুরি করে দেশকে দেওলিয়া বানিয়ে ফেলছে। তারপরও কিছু বলা যাবে না। সরা সরি চুরি চেইন ম্যানেজমেন্টের সাথে জড়িত সবাই, যার ফলে দেশের বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে চলছে। আমার প্রশ্ন রাষ্ট্র তথা জাতির কাছে, কীভাবে বন্ধ করা সম্ভব এই চুরি চেইন ম্যানেজমেন্ট?
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com