নূপুরদের সংযত রাখা : মধ্যপ্রাচ্যেরই আছে সক্ষমতা
নূপুরদের সংযত রাখা : মধ্যপ্রাচ্যেরই আছে সক্ষমতা - ছবি : সংগ্রহ
আমরা ভারত বিরোধিতার কথা বলছি, বিশেষ করে আলেমসমাজ। উপমহাদেশের আলেমদের জ্ঞানতীর্থ ভারতের দেওবন্দ। সারা পৃথিবীতে দেওবন্দী আলেম রয়েছেন। মূলত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের শিক্ষা প্রদান করাই হয় ভারতের দেওবন্দ থেকে। ভারত বিরোধিতা করলে আমাদের দেওবন্দের কী হবে? অনেকে বলছেন, ভারতের সাথে সম্পর্ক বাতিল করতে! তাহলে দেওবন্দে যাবেন কিভাবে? আজমির শরিফে কিভাবে যাবেন? উপমহাদেশের মুসলমানদের ইসলামের মূল শিকড় সবই ভারতে। আলেমদের উস্তাদের উস্তাদ ভারতীয়। আমরা কি ভুলভাবে কথা বলছি কি না এটা ভেবে দেখে উচিত।
এরপর ভারতীয় পণ্য বয়কটের কথা বলছি। আসলেই কি আমরা ভারতের পণ্য বয়কট করতে সক্ষম? ভারত ছাড়া আমরা দৈনন্দিন জীবনে স্বয়ংসম্পূর্ণ! কথা বলার ক্ষেত্রে হুঁশ থাকা দরকার। রাজনৈতিক সমস্যা ও সঙ্কটকে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে সমাধান করা নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব। আবেগের ঝড় সবসময় ক্ষণস্থায়ী এতে হুজুগ বাড়ে কেবল, বরং সমস্যার সমাধান হয় না। সস্তা হুজুগের চাষাবাদ কোনো কাজের কাজ নয়।
ইরানের পূর্ব-নির্ধারিত দিল্লি সফরে সাম্প্রতিক ইস্যু (প্রাণপ্রিয় নবী সা.-এর কটুক্তির বিষয়) যুক্ত করেছে ইরান। দিল্লিতে বসে অজিত দোভালের চোখ চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করেছে, ব্যাখ্যা চেয়েছে। ভারতের সাহস হয় নাই তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া। তারা যেকোনোভাবে অন্যায় স্বীকার করছেন, স্টেপ নিচ্ছেন। আমরা জানি সেটা যথেষ্ট না এবং বিজেপি যে মুসলিমবিদ্বেষী উগ্র দল এটা প্রমাণিত। কিন্তু যেসব মুসলিম দেশ ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে তারা যদি এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয় যে মুচলেকার মতো কিছু একটা করতে হবে বিজেপি সরকারের সেটার কোনো ফলাফল ভারতের মুসলমানেরা পাবে। কার্যকরী কিছু না করে আবেগী চিৎকার সাময়িক ভালো লাগা হলেও বিজেপি কাজের কাজ কিছুই করবে না। বিজেপি তাদের জনগণের জন্য তেমন কিছুই করে নাই। আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি নিশ্চিত। এখন একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো ছাড়া নির্বাচনী বৈতরনি তাদের পার হওয়া সম্ভব না। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, ধারাবাহিক মুসলমান অত্যাচারের মতো এবারও দুনিয়া তাদের সহ্য করবে। অবশ্য বিজেপির ধারাবাহিক মুসলিম অত্যাচারের পরোক্ষভাবে নেপথ্য নায়ক আরব দেশগুলোই। আরবে গরিব মুসলিম দেশের শ্রমিকদের ডাকা হয় মিসকিন নামে। বেতন, সুযোগ, সুবিধাও কম।
২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর মুম্বাইয়ে গরুর গোশত থাকার দায়ে আখলাক নামের এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলে গেরুয়াবাদী হিন্দুরা । এরপরে সারা ভারতজুড়ে গরুর গোশতের রাজনীতি শুরু হয়। সেটা বিজেপির মুসলমানদের পিটিয়ে মারার রাজনীতি। জম্মু-কাশ্মিরে আইন করে গরুর গোশত নিষিদ্ধ করা হয়। সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গায় বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার হতাহত হয়। এসব বিষয়ে আরব দেশগুলোর তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। বরঞ্চ মাত্র পাঁচ মাস পরে সৌদি আরব, ভারতের বিজেপিপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সৌদির সর্বোচ্চ রাজকীয় পদকে ভূষিত করেন। তাকে কিং আব্দুল আজিজ পদকে ভূষিত করা হয় এবং সৌদি আরবের মিডিয়ায় তাদের সম্পর্ককে একটা টার্ম দিয়ে পরিষ্কার করা হয়, 'সিমেন্ট বাইলেটারাল টাইস' (Cement Bilateral Ties)। তাহলে আরবের মিসকিনদের অত্যাচার করতে বিজেপি কেন ভয় পাবে?
কিন্তু এইবার মিসকিনদের নবী সা.-এর দিকে হাত দিয়ে ফেলেছে। যার জন্য মুসলমানেরা নিজের জীবন কুরবানি দেয়। স্বভাব পরম্পরায় গেরুয়াবাদকে গ্লোরিফাই করতে গিয়ে উস্কানি দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ফেঁসে গেছে। তাদের উপর যদি দৃষ্টান্তমুলক এমন কোনো বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি করা যায় যাতে আগামীতে যারাই আসুক মুসলিমদের নিয়ে হিংসার রাজনীতি করার সাহস করবে না। তাহলেই কেবল সাফল্য। নাহলে এইসব মিটিং মিছিলের কানাকড়িও দাম নেই। মিটিং মিছিল হোক, তবে এজেন্ডা একটাই ভারত সরকার কখনো কোনো ধর্ম ও ধর্মকে (যেকোনো ধর্ম) নিয়ে হিংসা সৃষ্টি এবং হিংসার রাজনীতি করবে না।
বৈশ্বিকভাবে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এরকম কোনো লিখিত ওয়াদা এই পরিস্থিতিতে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। এটা কেবলই মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষে সম্ভব। মোটাদাগে বললে কেবল কাতার, আমিরাত আর সৌদি আরবের পক্ষেই সম্ভব। তাদের তরফ থেকে এরকম কিছু বলুক, ভারত মানতে বাধ্য। আরবের জ্বালানি তেলের যোগান ভারতের প্রধানতম উৎস। এই দেশগুলোর অভিজাত বাজার ভারতের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ২০২০ সালে কোভিডের মধ্যে ভারত কাতারে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে এবং কাতার ভারতে ৭.২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পাঁচ বছরে রেকর্ড ৬০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে যাচ্ছে। আর সৌদি গেজেটের ভাষ্য অনুযায়ী ভারত সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক সহযোগী। ২০২০ সালে ভারত সৌদি আরবে ৬.৩৭ বিলিয়ন ডলার এবং সৌদি আরব ভারতে ১৬.৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ভারত জিসিসি দেশগুলোতে ২০২০-২০২১ সালে ৪৪ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে এবং আমদানি করে ১১১ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৯ বিলিয়ন ডলারের মতো যার আট বিলিয়ন ডলার ভারত রফতানি করে।
অতএব মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পক্ষ থেকে এরকম কোনো মুচলেকা চাওয়ার সক্ষমতা আছে। সেটা তারা না করে শুধুমাত্র ক্ষমার বিনিময়ে ছেড়ে দিলে ভবিষ্যতে এই অপরাধ আর ক্ষমা চাওয়ার ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে।
মহানবী সা. ইস্যুতে মুসলমানদের ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহবান জানানো হচ্ছে তাহলে ভারতীয় মুসলমানেরা কোথাকার পণ্য ব্যবহার করবে, তারা কোথায় যাবেন? ভারত বলতে কি আমরা ভারতীয় মুসলমানদেরকেও খারিজ করে দিচ্ছি নাকি ভেবে দেখা দরকার।
ভারতে আন্দোলন হচ্ছে, এই ইস্যুতে মুসলমানদের বাইরে হিন্দু, শিখ, দলিতরাও আন্দোলন করছে বিজেপির বিরুদ্ধে। তাদের সাথে তো একাত্মতা ঘোষণা করা দরকার নাকি তাদের এই আন্দোলনকে আমরা বাতিল করে দেবো। আমাদের আন্দোলনে যারা স্বেচ্ছায় শরিক তাদের কি পরোক্ষভাবে বাতিল করে দিচ্ছি?
আমি যা বলতে চাই, ভারতের আধিপত্যের বিরোধিতা করা যায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে হয়। কিন্তু এক দেশের জনগণ কখনোই আরেক দেশের জনগণের শত্রু হয় না, বিবেচনা করাও ঠিক না। হিস্যা বুঝে নেয়ার জন্য নিজেদের মেরুদণ্ড শক্ত হতে হয়। মেরুদণ্ড শক্ত না করলে কোনো ইস্যুতেই কেউ এসে কিছু দিয়ে যাবে না।