চির উন্নত মম শির
কাজী নজরুল ইসলাম - ছবি : সংগ্রহ
আকাশের ধ্রুব তারকাটি কতটা উজ্জ্বল হলে পৃথিবীর বুকে তা আলো ছড়ায়! কতটা জ্বলজ্বলে হলে চোখে পড়ে খুব সহজে! এটি একটি ভাবনার বিষয় বটে। আবার সমুদ্রের ঐশ্বর্যের মাঝেও শূন্যতা দেখে কেউ কেউ। কি করে দেখে ? কেনো দেখে? হয় তো তৃষ্ণার্ত মনের আকাশজুড়ে থাকে জ্যোতির্ময় তারার অপেক্ষা। থাকে অন্তহীন প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা! এ আকাক্সক্ষা মানুষের সহজাত। মানুষ কল্পনা করে। ভাবে এবং ভাবনার আকাশে মেলা সাজায়। অসীমের মাঝে সীমার রেখা খোঁজে।
খুঁজতে খুঁজতে কখনো কখনো পেয়ে যায় কাক্সিক্ষত সেই বিষয়! তেমনই একটি আকাক্সক্ষার বিষয় হলো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সর্বকালের মানুষের মনে একটি দীপ্ত শিখা হয়েই আছেন এ বিদ্রাহী কবি ।
তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। সালটি ছিল ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। দারিদ্র্যতার মধ্যে দিয়ে সংগ্রামী জীবনের একটি মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কবি, গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক কখনো বা রাজনৈতিক কর্মী এবং নাটক সব কিছুতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। একটি বোধসম্পন্ন চাঞ্চল্যের অধিকারী এই মানুষটি জীবনের সোনালি একটি অধ্যায়ের পর নীরবতাকেও সহাস্যে গ্রহণ করার সাহসিকতা দেখিয়েছেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের একজন জাতীয় কবি হিসেবেই তাঁর চিরবিদায়। সাতাত্তর বছর বেঁচে ছিলেন। জন্ম থেকে মৃত্যুর এই সময়ে কেমন ছিলেন তিনি। বেঁচে থাকার এই সময়টাতে মনের ভেতরকার পৃথিবী কেমন ছিল তাঁর। কেমন কেটেছে তাঁর দিনমান। কেমন করেই বা আমরা তাঁকে স্মরণ করেছি। করছি! মর্যাদা কতটা দিতে পেরেছি। কতটা পেরেছি সম্মান দিতে! সত্যিকারের যে সম্মান পাওয়ার ছিল তাঁর আমরা তা দিতে কতটা নিবেদিত হয়েছি। এটি নিশ্চয় ভাবনার বিষয়।
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির
এমন উচ্চারণে চাই সাহস। চাই দৃঢ়তা। চাই প্রবল ইচ্ছেশক্তির দৌরাত্ম্য। আমরা সবাই তো দেখি আকাশ। কিন্তু ধারণ করার সাহস আছে ক’জনের। অথচ আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছেন কবি নজরুল। আর কে আছে এমন! ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। চিন্তা বিস্মিত হয়! মনে হয় এ তো কেবলি অসম্ভবকে সম্ভাবনার কাছে তুলে আনার এক বিস্ময় মাত্র!
আকাশ বা সমুদ্রকে ধারণ করার সাহসিকতা কজন দেখিয়েছেন জানা নেই। কিন্তু আমাদের নজরুল তাঁর জ্ঞান মেধার চর্চায় তার বুকের ভেতরই একটি আকাশ তৈরি করেছেন। সমুদ্রকে বেঁধে নিয়েছেন প্রবল দৃঢ়তায়। তাই তো বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণার একটি উৎস নজরুল। যিনি প্রথম ভারত উপসহাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছেন। সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। তাঁর চিন্তা ও মননশীলতাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা যা ভাবি তা তিনি করে দেখিয়েছেন। কিংবা যা ভাবি না অথবা ভাবতে পারি না, তা তিনি ভেবেছেন। একই সাথে ভাবিয়েছেনও! তাই তো তিনি সর্বকালের সেরা হতে পেরেছেন। পাখির ডানা আছে বলেই সে উড়ে বেড়ায় যত্রতত্র। কিন্তু মানুষকে কি কখনো আমরা উড়তে দেখেছি। দেখিনি। কিন্তু একজন কবি কে উড়তে জানতে হয়। মানুষের মনের ভাবনাকে পড়তে জানতে হয়। প্রকৃতির শব্দ গুনতে জানতে হয়। নইলে জীবনকে জানবে কি করে!
অন্ধকারেরও নিজস্ব শব্দ আছে। আলো আছে- তা কেবলমাত্র একজন কবিই জানতে পারে। তাই তারা শব্দের মালা গেঁথে জীবনের অর্থ নির্মাণ করে। চিন্তাশক্তিকে নিকট থেকে দূর আরো দূরে নিয়ে যান অনায়াসে। বিদ্রোহী কবির কণ্ঠে দৃঢ়তায় উচ্চারিত হয়েছে এমনই বিস্ময় বাণী-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি,
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেঁদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রির!
কালের প্রবাহে সময় হারিয়ে গেছে অনেক। সময়ের কাজই তো বয়ে চলা। কিন্তু সময়কে পরিমাপ করতে জানতে হয়। বুঝতে হয়। আমরা কি পরিমাপ বুঝি! নাকি জানি! জানলে কতটা জেনেছি। জানতে কিইবা করেছি। অনেক কিছু দেখার আছে। আমরা কি দেখেছি! নাকি দেখছি!
অমরা কতটা জানি আমাদের প্রিয় কবি নজরুলকে! না জানলে কেনো জানি না! এ প্রশ্নও কি করেছি কেন তাঁকে পাঠ করতে হবে? কিন্তু তাঁকে পাঠ করতেই হবে। কারণ সারা বিশ্ব আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। মানুষ তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। চারিদিকে হাহাকারের ধ্বনি। বিশ্বের এই ক্রান্তিলগ্নে নজরুলের সাহসী এবং বলিষ্ঠ উচ্চারণই অুনপ্রাণিত করতে পারে। পারে মানুষের ভেতর পৃথিবীকে জাগাতে। চেতনার উদয় না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মুক্তি নেই। জীবনের চড়াই-উৎরাই এবং নানাবিধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নজরুল এগিয়েছেন। তিক্ত সত্যকে দেখেছেন। গ্রহণ করেছেন। সত্যের জন্য লড়াই করেছেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য বহুবার তাঁকে কারাবন্দী হতে হয়েছিল। জেলে বন্দী হয়েও এতটুকু দমে যাননি তিনি। কারারত অবস্থায় তিনি লিখেছেন-
কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকোল পুজোর পাষাণ বেদী
ওরে ও তরুণ ঈসান
বাজা তোর প্রলয় ভিশান ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর বেদী।
আহা কি দুঃসাহসী উচ্চারণ! কি বলিষ্ঠ বাণী! জীবন সংগ্রামের এক নতুন বিস্ময়!
বিচারকের এজলাসে দাঁড়িয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন- পৃথিবীর ইতিহাসে এটিও এক বিরল ঘটনা!
‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে আজো এটি বিস্ময়কর!
জীবনে নানারকম বাধার মুখে পড়েছেন! জীবনভর ছুটেছেন বাধা পেরিয়ে। এত বিরোধিতার প্রকটেও তাঁর কলমের ধার এতটুকু কমেনি। বরং তিনি দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়নের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন-
বল বীর
বল উন্নত মম শির
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাাতসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত
নজরুলকে আমরা দেখি যখন শিক্ষার কোনো সুযোগ না পেয়েও দুর্মর গতিবেগে জীবনের পাঠ অনুধাবনে এতটুকু পিছিয়ে যাননি। বরং তাঁর যুগের থেকে এগিয়ে ছিলেন তো বটে! আজো আছেন। তাঁর প্রতিভার প্রস্ফুটন আজো দীপ্তি ছড়াচ্ছে দেশে এবং বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে। শিশু থেকে যৌবনের সময়টাতে কতভাবেই না নজরুল জীবনবোধ শিখেছেন এবং শিখিয়েছেন। মানুষকে উজ্জীবিত অনুপ্রাণিত করে দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পথ দেখিয়েছেন । যৌবন এমন একটি সময় যাকে ধারালো করতে পারলে পৃথিবীর পঙ্কিলতা দূর করায় সাহসী মানুষ হতে শেখায়। এর জন্য প্রয়োজন নজরুলের রচনা বেশি বেশি পাঠ করা। বিভিন্ন শ্রেণীতে পাঠ্য করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে প্রবলভাবে নজরুল পাঠ করানো। যৌবনের টগবগে তারুণ্যই পারে নজরুলের সঠিক উপলব্ধির ভার বহন করতে। এরই ভেতর দিয়ে ধূমকেতুর মতো জীবনের দর্শনকে একটি কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছাতে হবে। যেমন পৌঁছিয়েছেন নজরুল।
বিশ্ব আজ দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে! সভ্যতা এবং সংস্কৃতিতে আরো দ্রুতমান। অধিকারের বিষয়ে সচেতন।
প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে। অথচ পৃথিবীজুড়ে মানুষ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের অধিকার! ক্ষমতাবানরা জুলুম করছে ক্রমাগত। এসব জুলুম অত্যাচার আর স্বাধীনতার পক্ষে নজরুল রচনা আজো সবার চেয়ে এগিয়ে! আজো বিদ্রোহী কবিতার মতো রচিত হয়নি আর কোনো কবিতা। শতবর্ষ পেরিয়েও সাধারণ মানুষের হয়ে, গরিব-দুঃখীদের অধিকার, ধমীয় মতানৈক্যের ঊর্র্ধ্বে ওঠে একটি কবিতার আবেদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রয়োজন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় নজরুলকে আরো বেশি সংখ্যক রচনা সিলেবাসভুক্ত করা। তবেই কবির সত্য উচ্চারণ আরো সত্যি হয়ে মুখরিত হবে চারি অঙ্গন।
নজরুল কেমন ঘূর্ণির মতো প্রবল ছিলেন- তাঁর কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়-
আমি বাজাই আকাশে তালি দিয়া
তাত-উর- তাক’
আর সোঁও সোঁও করে প্যাচ দিয়ে খাই
চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক।
মম নিঃশ্বাস আভাসে অগ্নি-গিরিব বুক ফেটে উঠে ঘুতকার,
আর পুচ্ছে আমার কোটি নাগ- শিশু
উদগারে বিষ ফুৎকার।
নজরুল বাংলা ভাষায় একটা নতুন প্রাণ নতুন তারুণ্য নিয়ে এসেছিলেন। দেশজ বাংলার সাথে আরবি ও ফারসির সংমিশ্রণে এক নতুনত্বের জন্ম দিয়েছিলেন। সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনার জোয়ারে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের বেড়াজালে মুক্তির আহ্বান নিয়ে আসেন।
তিনি তাঁর গান-কবিতায় সেই সুধা ঢেলে দিয়ে শত কোটি প্রাণকে বেঁধেছিলেন।
সেই নজরুলকে বুঝতে দরকার দৃষ্টির গভীরতা। দরকার আকাশসম হৃদয়। তাঁর ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব অনুধাবনে প্রয়োজন গভীর অধ্যয়নের। তাঁর বিরাটত্ব, বিশালত্ব এবং জাতীয় কবি হিসেবে পরিপূর্ণ মযাদায় সোচ্চার হওয়ার সময় এখনই। সময় গড়িয়ে কেবলই বয়ে যাচ্ছে। উন্নত জাতি হিসেবে গৌরববোধ করতে সচেতনতা জরুরি। যেমনি কবি তাঁর দৃঢ়তায় উচ্চারণ করেন
আমি চির-বিদ্রোহী বীর-
আমি বিশ্ব ছড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত-শির!