ফিতরা মালের নয় জানের সাদাকা

ডক্টর মোহাম্মদ ইদ্রিস | Apr 25, 2022 01:33 pm
ফিতরা মালের নয় জানের সাদাকা

ফিতরা মালের নয় জানের সাদাকা - প্রতীকী ছবি

 

পবিত্র মাহে রমজানের ইবাদতের মধ্যে সাদক্বাতুল ফিতর আদায় করা অন্যতম একটি ইবাদত। রমজানের সিয়াম সাধনা শেষে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং এ আনন্দে যেন মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্য শরিক হতে পারে এ জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে সাদক্বাতুল ফিতর। রমজানের রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিপূর্ণতার জন্যই আবশ্যক করা হয়েছে এটি। হজরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা. সিয়াম পালনকারীর জন্য সাদক্বাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন, যা সিয়াম পালনকারীর অনর্থক, অশ্লীল কথা ও কাজ পরিশুদ্ধকারী এবং অভাবি মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে এটা আদায় করবে, তা সাদক্বাতুল ফিতর হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা অপরাপর (নফল) সাদকা হিসেবে গৃহীত হবে। (আবু দাউদ) ইমাম ওয়াকি ইবনুল জাররাহ বলেন, রমজান মাসের যাকাতুল ফিতর নামাজের সিজদায়ে সাহুর সমতুল্য। অর্থাৎ নামাজে ত্রুটি হলে যেমন সিজদায়ে সাহু দিলে এটা পূর্ণ হয়ে যায়, তেমনি সিয়ামের মধ্যে ত্রুটি হলে সাদাক্বাতুল ফিতর দিয়ে এর প্রতিকার হয়। তাছাড়া ধনী-গরিব উভয়ে যেন অন্তত ঈদের দিন উত্তম পোশাক ও ভালমানের খাবার খেতে পারে, ঈদের আনন্দে সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে এ জন্যই ফিতরার ব্যবস্থা।

সাদাকাতুল ফিতর অর্থ
সাদকা শব্দের অর্থ দান আর ‘ফিতর’ শব্দের অপর অর্থ হলো সৃষ্টি। শব্দটি কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। যেমন পুরোহিত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও আল্লাহপাকের অনুগ্রহে হযরত ইবরাহিম আ. ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি একে একে তারকা, চন্দ্র ও সূর্য সবকিছু অস্বীকার করে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা ও মালিক আল্লাহপাককে উপলদ্ধি করে ঘোষণা প্রদান করলেন: ‘আমি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে নিয়োজিত করলাম, যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই।’ (সূরা আল আন‘আম : ৭৯) এখানে ‘ফাতারা’ এর অর্থ বলা হয়েছে সৃষ্টি করা।

ঈদ-উল-ফিতরকে বলা হয় ‘ফিতরা’ প্রদানের ঈদ। ঈদ-উল-ফিতর অর্থ যদি সৃষ্টির খুশি হয়, তা হলেও বলা যেতে পারে যে, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কঠোর আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, দান-সাদাকাহ সহমর্মিতা তথা তওবা ইস্তেগফারের অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ শেষে নতুনভাবে মুসলমানদের জীবন প্রবাহ শুরু হয়। মানুষ আল্লাহর বিধান পালন ও প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন উদ্যমে মেতে ওঠে। এ যেন ধ্বংস তথা পতনের পরিবর্তে সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্বচ্ছ সৃষ্টির দৃঢ় অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হওয়া। এ অর্থেও এ ঈদকে ঈদ-উল-ফিতর বলা যথার্থ হতে পারে। অথাৎ ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং ভালবাসা ও সহমর্মিতা জানাতে সামর্থবানরা হক হিসেবে অসহায় মানুষকে যে খাদ্যসামগ্রী বা সম্পদ প্রদান করে তাকে সাদক্বাতুল ফিতর বলা হয়।

সাদাকাতুল ফিতর কার উপর ফরজ
জাকাতের নিসাবের মতো যার মালিকানায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও ঋণ বাদে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা এর সমমূল্য কোনো সম্পদ বা টাকা থাকে, তাহলে তার ওপর সদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব। তবে জাকাতের মতো সম্পদ এক বছরকাল থাকা শর্ত নয়। সাদাক্বাতুল ফিতর মুসলমান নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের পক্ষ থেকে আদায় করা ফরজ। এ মর্মে হাদিসে এসেছে ইবনে ওমর রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. নিজ উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ পরিমাণ খেজুর বা যব জাকাতুল ফিতরা হিসেবে ফরজ করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ [সহীহুল বুখারী ও মুসলিম]

ঈদের দিন সকালেও যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তার জন্য ফিতরা আদায় করা ফরজ নয়। আবার ঈদের দিন সকালে কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরজ। [মিরআত] সাদাকাতুল ফিতর হলো জানের সাদাক্বা, মালের নয়। এ কারণে জীবিত সকল মুসলিমের জানের সাদাকা আদায় করা ওয়াজিব। কোনো ব্যক্তি সিয়াম পালনে সক্ষম না হলেও তার জন্য ফিতরা ফরজ।

সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ সা. সাদাকাতুল ফিতর আদায় করাকে আবশ্যক করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা যব বা এক ছা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটা আবশ্যক। (বুখারী) হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন ‘আমরা এক ছা’ পরিমাণ খাদ্য, যব, বা খেজুর অথবা এক সা পরিমাণ পনির বা কিশমিশ দিয়ে ফিতরা আদায় করতাম।’ (বুখারী) হাদিস শরিফে গম বা আটা, যব, কিশমিশ, খেজুর ও পনির- এ পাঁচটি দ্রব্যের যেকোনো একটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী আদায় করতে পারে তবে সবার জন্য সবচেয়ে কম দামের দ্রব্য দিয়ে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা অনুচিত; বরং যে ব্যক্তি খেজুর, কিশমিশ দিয়ে ফিতরা আদায় করার সামর্থ রাখে, সে তা দিয়েই আদায় করে।

‘ছা’ হচ্ছে তৎকালীন সময়ের এক ধরনের ওজন করার পাত্র। এর পরিমাণ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন ফসলের ছা‘ ওজনও হিসাবে বিভিন্ন হয়। নবী করীম সা.-এর যুগের ছা‘ হিসাবে এক ছা‘-তে সবচেয়ে ভালো গম দুই কেজি চার শ' গ্রাম হয়। এক ছা‘ চাউল প্রায় দুই কেজি পাঁচ শত গ্রাম হয়।। ইরাকি এক ছা‘ হিসাবে দুই কেজি চার শ' গ্রাম হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে এক ছা‘তে আড়াই কেজি চাউল হয়। রাসূলুল্ললাহ সা.-এর যুগে মদিনায় ‘গম’ ছিল না। মু‘আবিয়া রা.-এর যুগে সিরিয়ার গম মদিনায় আমদানি হলে উচ্চ মূল্যের বিবেচনায় তিনি গমে অর্ধ ছা‘ ফিতরা দিতে বলেন। কিন্তু সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি রা.-সহ অন্য সাহাবিরা মু‘আবিয়া রা.-এর এই ইজতিহাদি সিদ্ধান্ত অমান্য করেন এবং রাসূলুল্ললাহ সা.-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের উপরেই কায়েম থাকেন। ইমাম নববি রহ. বলেন, ‘যারা অর্ধ ছা‘ গমের ফিতরা দেন, তারা মু‘আবিয়া রা.-এর ‘রায়’-এর অনুসরণ করেন মাত্র’। [ফাতহুল বারী] আমাদের দেশের কোনো কোনো ওলামাগণ মু‘আবিয়া রা.-এর এই ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত মতে অর্ধ ছা‘ হিসাবে এক কেজি সাড়ে ছয় শ' গ্রাম গমের দাম হিসাবে ফিতরা দিতে বলেন। অথচ রাসূল সা.-এর সময়ে সামর্থ্যানুযায়ী সবাই উত্তম পণ্য দিয়ে ফিতরা আদায় করতেন। সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে রাসূল সা. ইরশাদ করেন, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি। (বুখারী)

সাদাকাতুল ফিতর আদায় ও বণ্টনের সময়কাল
ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। [সহিহুল বুখারী ও মুসলিম] ইবনে ওমর রা. ঈদের দু’-এক দিন আগে জমাকারীর কাছে ফিতরা পাঠাতেন। [মুয়াত্ত্বা মালেক] ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. সিয়াম পালনকারীর জন্য সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে আদায় করবে তা সাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা সাধারণ সাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে। [আবূ দাঊদ]

ফিতরা পাওয়ার হক্দার কারা
সাদাকাতুল ফিতর নিজ এলাকার অভাবি ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বণ্টন করা যাবে। কেননা ধনীদের সম্পদে গরিবের হক আছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধনীদের সম্পদে রয়েছে, ফকির, বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা আল-যারিয়াত : ১৯) এছাড়া জাকাত আদায়ের নিম্নোক্ত আটটি খাতেও সাদাকাতুল ফিতর বণ্টন করা যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাদাকা হল কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক্ব এবং তা দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।’ (সুরা আত-তওবা : ৬০) উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ যাদের কথা বলেছেন তারা প্রত্যেকেই যাকাত বা সাদাকা পাওয়ার হক্দার।
টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করার চেয়ে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে ফিতরা আদায় করা উত্তম। প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিতরা আদায় উচিত। এ মর্মে হাদিসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরি রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা জাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ছা‘ খাদ্য অথবা এক ছা‘ যব বা এক ছা‘ খেজুর অথবা এক ছা‘ পনীর অথবা এক ছা‘ কিশমিশ দিয়ে। [সহিহুল বুখারী ও মুসলিম] আমাদের এই কৃষি প্রধান দেশে প্রধান খাদ্য চাউল। সে কারণে চাল দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করাই উত্তম। রমজানের সিয়াম সাধনা শেষে ঈদের অনাবিল আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদেরকে যথাযথভাবে সাদাকায়ে ফিতর আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সাঁথিয়া, পাবনা।
ই-মেইল : drmidris78@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us