ইমরান সুনামি
ইমরান সুনামি - ছবি : সংগ্রহ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খান সরে যাওয়ার পর বিভিন্ন শহরে যে বিশাল বিশাল সমাবেশ করে যাচ্ছেন তাতে এই পাঠান রাজনীতিবিদের প্রতি জনসমর্থনের সুনামি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। সর্বশেষ তিনি করাচিতে রেকর্ড ভাঙা সমাবেশ করেছেন মধ্যরাত অবধি। ড্রোনের পরিসংখ্যান অনুসারে, এই সমাবেশে আড়াই লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে পেশোয়ার, তারও আগে ইসলামাবাদের সমাবেশেও বাঁধভাঙা জোয়ারের সৃষ্টি হয়। লাহোরের পরবর্তী সমাবেশে একই ঘটনা ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইমরান খান পাকিস্তানের জনগণের জন্য যে বয়ান বা বক্তব্য নির্ধারণ করেছেন সেটি পাকিস্তানিদের বড় অংশ গ্রহণ করছে বলে মনে হয়। করাচির সমাবেশ চলাকালে ডনসহ কয়েকটি মিডিয়া তাৎক্ষণিক জনমত জরিপ করেছে। সেখানে ৭৬ শতাংশ মানুষ ‘বিদেশী ষড়যন্ত্রে’ ইমরানের সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। তারা শাহবাজ সরকারকে একটি বিদেশী শক্তির চাপিয়ে দেয়া ‘আমদানীকৃত সরকার’ বলেও মনে করেন। ইমরানের এই বিপুল জনসমর্থনের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, যুব সমাজের ৮০ শতাংশ ইমরান খানকে সমর্থন করছেন। তারা পাকিস্তানকে ‘প্রকৃত স্বাধীন’ করার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। পাকিস্তানে শতকরা ৬০ ভাগ যুব বয়সী হওয়ায় তাদের এই ব্যাপক সমর্থনের নানামুখী তাৎপর্য রয়েছে। ইমরানের বক্তব্যে আদর্শবাদিতা ও জাতীয়তাবাদ দুটির মিশ্রণ রয়েছে। এ দুটির সংমিশ্রণে ব্যাপক কোনো জাগরণ ২২ কোটি মানুষের একটি দেশে হলে তার ইতিবাচক সম্ভাবনা যেমন থাকে তেমনি বিচ্যুতির আশঙ্কাও থাকে।
ইমরান খানের কর্মপদ্ধতির ধরন এখন অনেকটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ ধরনের। তিনি নানা সংশয়ের পরও দলীয় এমএনএদের গণপদত্যাগ ঘটিয়েছেন। আনুগত্য লাভের জন্য ‘হর্স ট্র্রেডিং’ থেকে দূরে থেকেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যরাত অবধি করাচির মতো সংবেদনশীল শহরে জনসভা করছেন যেখানে তিনি জাতীয়তাবাদী নেতাদের মতো ভাষণ দিয়ে বলেছেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্য জীবনের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি যে ধরনের আন্দোলন সারা দেশে সংগঠিত করছেন, জনমতের যে সুনামি তার পক্ষে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তার দলের ছেড়ে দেয়া শ’ দেড়েক আসনে উপনির্বাচন করা শাহবাজ শরিফের সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পাকিস্তানের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টও এ ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।
সম্ভবত এ কারণেই আসিফ আলী জারদারি শাহবাজ শরিফকে সরকার গঠনে সামনে এগিয়ে দিলেও সরকারের দায় কাঁধে নিতে চাইছেন না। পুরোপুরি এমনকি তিনি পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবার কথা বলে মনোনয়ন প্রক্রিয়া প্রাথমিকভাবে শুরু করেছেন জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পর্যায়ে। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক খেলায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের ডিনামিক্সই রয়েছে। অগতানুগতিক সৎ রাজনীতিবিদ হিসাবে খ্যাত ইমরান খান মুসলিম লীগ ও পিপিপি দুই দলের বিরুদ্ধে একই সাথে রাজনৈতিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। মওলানা ফজলুর রহমানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও রয়েছে সে সাথে। ফলে বড় ও মাঝারি রাজনৈতিক দলগুলো ইমরান ও পিটিআইকে তাদের অস্তিত্বের জন্য আঘাত হিসাবে বিবেচনা করেছে।
আন্তর্জাতিক ডিনামিক্স
এই অভ্যন্তরীণ ডিনামিক্সের সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক হিসাব নিকাশ ও মেরুকরণ। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পক্ষ থেকে আমেরিকান প্রভাব বলয়ের অধীনে পুরো বিশ্বকে নিয়ে আসার একটি কৌশল গ্রহণ করে। এতে তাদের সামনে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড়ায় চীন ও রাশিয়া। পাকিস্তান স্নায়ুযুদ্ধের সময় চীন ও আমেরিকা দুটো দেশের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বধীন একমেরু বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি হলে ওয়াশিংটন ভারতকে তার মিত্র হিসাবে পেতে চায়। ভারতের সাথে চীনের দীর্ঘ সীমান্ত বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষ হিসাবে চীনকে ঠেকাতে দিল্লিকে পাশে পাবে বলে আশা করেছিল পেন্টাগন। কিন্তু সোভিয়েতের উত্তরাধিকার রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের গভীরতা দিল্লির এত বেশি যে, সে সম্পর্ক ছিন্ন করে ওয়াশিংটনকে সেখানে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর দিল্লি রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্কেই একাত্ম রয়ে গেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কোয়াড’ গঠনের উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়।
ভারতকে কৌশলগত মিত্র হিসাবে পক্ষে পেতে ব্যর্থ হবার কারণে পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায়। চীন-রাশিয়ার নিকটর্তী দেশ হিসাবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন জরুরি বিবেচনা করে ওয়াশিংটন। এক্ষেত্রে ইমরান খানের সরকারকে প্রতিবন্ধক হিসাবে চিহ্নিত করে পেন্টাগন। পেন্টাগন-রাওয়ালপিন্ডি বোঝাপড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক পুনস্থাপনে ইমরান খানের বিদায় অনিবার্য শর্ত হয়ে ওঠে। এর বিপরীতে, অবরোধ নিষেধাজ্ঞায় অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বকে দেশটির জন্য কল্যাণকর বিবেচনা করেনি গভীর ক্ষমতা বলয়।
ইমরান খান কৌশলগত এই পরিবর্তনের প্রয়োজনে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে অ-রাজি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসুক। সেই সরকার তিন মাসে নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি না থাকলে জরুরি অবস্থা জারি করে সময়কে দীর্ঘায়িত করতে পারে। ইমরান খান তার প্রকাশ্য বক্তব্যেও এটি উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এস্টাবলিশমেন্ট থেকে পদত্যাগ, অনাস্থা ও নির্বাচন-এ তিন বিকল্পের প্রস্তাবে আমি নির্বাচন বেছে নিয়েছি। এস্টাবলিশমেন্ট ইমরান খানের অপশনকে গ্রহণ করলেও দূরবর্তী কোনো দেশের ফোনে বিরোধী জোটের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গভীর ক্ষমতা বলয় ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়। আইএসপিআর’র বিবৃতিতে যতই বলা হোক যে, রাজনৈতিক ঘটনাবলির সাথে সামরিক প্রতিষ্ঠানের ‘কোনো যোগসূত্র নেই,’ সেটি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। অন্তত যারা পাকিস্তানের রাজনীতিকে গভীরভাবে জানেন, তাদের কাছে কোনোভাবেই নয়।